ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বিধান নাগরিক অধিকার নিশ্চিতে প্রতিবন্ধক নয় কি?

বিধান নাগরিক অধিকার নিশ্চিতে প্রতিবন্ধক নয় কি?

প্রত্যেক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সংবিধান থাকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে— “বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যাহা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হইবে।” যদিও বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সংসদীয় ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে, সংবিধানে উল্লেখ আছে—রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। তাই প্রজাতন্ত্র না বলে ‘মালিকের প্রতিনিধিতন্ত্র’ বলা যৌক্তিক।

বাংলাদেশীরা ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় বা শিথিল কনফেডারেশন কাঠামোর ক্ষুদ্র স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে বাস করেছেন। বর্তমানে আমরা এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় আছি।

১৯৭২ সালের সংবিধানের চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে গৃহীত। অনেকেই মনে করেছিলেন এগুলো রাষ্ট্রের আদর্শিক স্তম্ভ ও অর্জনের প্রতীক, যা কখনো পরিত্যক্ত হবে না। কিন্তু বাস্তবে এগুলো নিয়ে পথ এগোনো সম্ভব হয়নি, কারণ সংবিধানের নানা জায়গায় অসঙ্গতি রয়েছে।

সংবিধান প্রণয়নের সময় সাধারণ মানুষের মতামত গ্রহণ করা হয়নি। প্রণেতারা ছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। তাই জনগণের আকাঙ্ক্ষা যথাযথ প্রতিফলিত হয়নি। পরবর্তীতে বারবার সংশোধনী আনা হলেও সেগুলোর বড় অংশই ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক স্বার্থে, ফলে মৌলিক অধিকার সংকুচিত হয়েছে।

গণতন্ত্র সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি। গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা—এসব গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু বাংলাদেশে সভা-সমাবেশ করতে পুলিশের অনুমতি প্রয়োজন হয়— যা গণতান্ত্রিক চর্চার পরিপন্থী।

এছাড়া বহুবার জাতীয় নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেননি। অতীতে ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। পরবর্তীতে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে পুনরায় বহুদলীয় ব্যবস্থা চালু করা হয়।

সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ উল্লেখ থাকলেও বাংলাদেশে বহু জাতিগোষ্ঠী রয়েছে— সাঁওতাল, ওঁরাও, চাকমা, মারমা, বিহারি ইত্যাদি। ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালি-অবাঙালি সকলে অংশ নিয়েছিল। তাই একক বাঙালি জাতীয়তাবাদ যুক্ত করে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে অবজ্ঞা করা প্রশ্নবিদ্ধ।

সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতাও মূলস্তম্ভ করা হয়েছে। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র পরস্পর সাংঘর্ষিক। ধর্মপালনের স্বাধীনতা সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত—তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতা কীভাবে বাস্তবায়নযোগ্য? গণতন্ত্রচর্চার সুযোগ না থাকলে এসব নীতি তাত্ত্বিক রয়ে যায়।

প্রথম সংশোধনী আনা হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে, কিন্তু পরেই ৯৩ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং পাকিস্তানের রিজার্ভ ফান্ড দাবি করা হয়নি—যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। দ্বিতীয় সংশোধনীতে জরুরি অবস্থা ও মৌলিক অধিকার স্থগিতের বিধান যুক্ত হয়।

চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল চালু হয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। পরে পঞ্চম সংশোধনীতে বহুদলীয় ব্যবস্থা চালু ও ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ যুক্ত করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীতে জাতির পিতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবিধানে যুক্ত করা হয়। কিন্তু বাঙালি জাতি কয়েক হাজার বছরের পুরোনো—তাই জাতির পিতা সংজ্ঞা ও যুক্তির প্রশ্ন আসে। বহু জাতিগোষ্ঠীর দেশে একজনকে জাতির পিতা বলা কতটা যৌক্তিক তা আলোচনার দাবি রাখে।

সংসদীয় গণতন্ত্রে ক্ষমতার ভারসাম্য জরুরি—নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার বিভাগ। কিন্তু ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সাংসদরা দলের বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারেন না। এতে কার্যত দলীয় একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রপতির বেশিরভাগ ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শসাপেক্ষে—ফলে নির্বাহী ও আইনসভা একই ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকে। বিচার বিভাগও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। যদিও বর্তমান সরকার বিচারবিভাগের পৃথক সচিবালয়ের উদ্যোগ নিয়েছে—এটি আশার বিষয়।

মন্টেস্কুর ক্ষমতার বিভাজন নীতিতে বলা হয়েছে—একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে আইন, নির্বাহী ও বিচার ক্ষমতা থাকলে স্বাধীনতা নষ্ট হয়। সে অনুসারে দেখা যায়—বাংলাদেশে গণতন্ত্রচর্চা বাধাগ্রস্ত।

প্রতিবন্ধক নয় কি,নাগরিক অধিকার নিশ্চিত
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত