ঢাকা মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি

শাহবাগ ব্লকেড, উত্তাল দেশ

* আ.লীগ নিষিদ্ধে দ্রুত সিদ্ধান্ত না এলে আবারও ‘মার্চ টু ঢাকা’ : নাহিদ * ‘শাহবাগ ব্লকেড’ কর্মসূচির ঘোষণা দিলেন হাসনাত আব্দুল্লাহ * আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি সকল দেশপ্রেমিক মানুষের : ড. মাসুদ * ঐক্যবদ্ধ শাহবাগ বিএনপির অপেক্ষায় : সারজিস আলম * জাতি আ.লীগের তওবার ধোঁকায় আর পড়বে না : হেফাজত
শাহবাগ ব্লকেড, উত্তাল দেশ

হত্যা, নির্যাতন, টেন্ডারবাজি, সহিংসতা, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িত থাকায় সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হলেও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। ফলে গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি করে আসছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), হেফাজতে ইসলাম, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), গণঅধিকার পরিষদ, ইনকিলাব মঞ্চ, জুলাই মঞ্চ, জুলাই ঐক্যসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। কিন্তু আট মাস পেরিয়ে গেলেও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়নি, উল্টো গড়িমসি চলছে। বাধ্য হয়ে, গত বৃহস্পতিবার থেকে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার ও দলটি নিষিদ্ধের দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনের পর শাহবাগ সমাবেশ করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। রাজধানীর শাহবাগ মোড় ‘ব্লকেড’ কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছোট-বড় মিছিল এসে যুক্ত হয়েছে শাহবাগে। সমাবেশকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা লক্ষ্য করা গেছে। যমুনা ঘিরে পুলিশ, সেনাবাহিনী, র‌্যাব, বিজিবি ও এপিবিএনের সদস্যরা মোতায়েন রয়েছেন।

গতকাল সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলন ও অভ্যুত্থানে পতন হওয়া ফ্যাসিস্ট দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগ এলাকায় জনস্রোতে উত্তাল হয়ে উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে টানা অবস্থানের পর গতকাল শুক্রবার শাহবাগ অবরোধ করেছেন আন্দোলনকারীরা। বিকাল ৫টায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে থেকে শাহবাগ চত্বরে এসে রাস্তা ‘ব্লক‘ করেন। এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ। ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে চলছে বিক্ষোভ। বিভিন্ন স্লোগানে মুখরিত শাহবাগ।

আন্দোলনকারীদের কণ্ঠে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের জোরালো দাবি করা হয়েছে। মঞ্চ থেকে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে, ‘ব্যান ব্যান, আওয়ামী লীগ ব্যান’ ‘২৪ এর বাংলায়, আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই’ ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ ‘কণ্ঠে আবার লাগা জোর, আওয়ামী লীগের কবর খোঁড়’ ‘গড়িমসি বন্ধ কর, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ কর’ ‘ব্যান ব্যান আওয়ামী লীগ, ‘লীগ ধর জেলে ভর’ ‘ওয়ান টু থ্রি ফোর, আওয়ামী লীগ নো মোর’ ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’ ‘গোলামি না আজাদী, আজাদী আজাদী’ ‘নাহিদ, আক্তার আসছে, রাজপথ কাঁপছে’ ‘আওয়ামী লীগের আস্তানা, ভেঙে দাও ঘুরিয়ে দাও’ ইত্যাদি স্লোগান দিচ্ছেন। শাহবাগ মোড় এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই ‘ব্লকেড’ যেন ফিরে এসেছে ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ের উত্তাল দিনগুলো, যা ‘জুলাই আন্দোলন’ নামে পরিচিত। রাজধানীর পুরানা পল্টন মোড়ে অবস্থান নিয়েছেন নুরুল হক নুরু নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীরা। দলের নেতা আবু হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার আগ পর্যন্ত তারা মোড়ে অবস্থান নেবেন।

দেশজুড়ে বিক্ষোভণ্ডমিছিল : আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভণ্ডমিছিল করা হয়েছে। নোয়াখালী, খুলনার শিববাড়ি, কুষ্টিয়া, রংপুর এবং কিশোরগঞ্জে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিল ও সড়ক অবরোধ করেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জামায়াতে ইসলামী, গণঅধিকার পরিষদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে সমাবেশে আসা এনসিপি ও ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ একটি গণহত্যাকারী দল। তারা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে। তাদের দুঃশাসনের সময় দেশের মানুষ অতিষ্ঠ ছিল। তাই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগে এসেছি। সরকারের পক্ষ থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত না আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের স্পষ্ট বার্তা আসছে, ততক্ষণ আন্দোলন চালাবেন বিক্ষোভকারীরা। এদিকে, মিছিল ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে মিছিল নিয়ে যমুনার সামনে যান এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্যসচিব আখতার হোসেন ও দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। রাত ২টায় নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম দায়িত্ব ছিল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা। আমরা সরকারের বাইরে এবং ভেতরে সেই দাবি বলেছি। কিন্তু আজকে ৯ মাস পরেও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের জন্য আমাদের আবার রাজপথে নামতে হয়েছে।’

এদিকে শাহবাগ ‘ব্লকেড’ করায় চারপাশের রাস্তায় যানজট সৃষ্টি হয়েছে। সায়েন্সল্যাব, টিএসসি এবং বাংলামোটরের দিকে যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। আন্দোলনকারীরা তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এব্যাপারে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ইন্টেরিমের (অন্তর্বর্তী সরকারের) কানে আমাদের দাবি পৌঁছায়নি। আমরা শাহবাগ ব্লকেড করব। যতক্ষণ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা না হবে না, ততক্ষণ আমরা শাহবাগ ছাড়ব না। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠন ছাড়া সব রাজনৈতিক দল এখন শাহবাগে। বিএনপি এলে জুলাইয়ের ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ শাহবাগ বিএনপির অপেক্ষায়। আজকের এই শাহবাগ ইতিহাসের অংশ এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতির মানদ-।’

হেফাজতে ইসলামের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব সাজেদুর রহমান বিবৃতি বলেছেন, শাপলা ও জুলাইর গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে দ্রুত নিষিদ্ধ ও বিচার করার দাবি জানাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। অতীতে আওয়ামী লীগ তওবা করে ফিরেছিল উল্লেখ করে সংগঠনটি জানায়, জাতি নতুন করে তাদের তওবার ধোঁকায় আর পড়বে না।

আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করা ও দলটি নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নিয়ে জামায়াতের ঢাকা দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেছেন, শুক্রবার দুপুরের মধ্যে সব রাজনৈতিক দলকে ডেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। আমরা আশা করি এই সরকার ছাত্র-জনতার দাবি পূরণ করবে। মাসুদ বলেন, আওয়ামী লীগ শুধু ৫ আগস্ট গণহত্যা করেনি, তারা ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর গণহত্যা করেছে, ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে শাপলা চত্বরে গণহত্যা করেছে, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি আমাদের চৌকস ৫৭ সেনা অফিসারকে হত্যা করেছে। ২০১৩ সালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে ২৫০ এর বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। ২০২১ সালে নরেন্দ্র মোদিকে আনার জন্য ২৫ জনকে হত্যা করেছিল আওয়ামী লীগ। তিনি আরও বলেন, শত শত নয়, হাজার-হাজার ভাইকে হত্যাকারী আওয়ামী লীগকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পতনের পর জনমানুষের দাবি ছিল তাদের নিষিদ্ধ করা। এই দাবি শুধু কোনো রাজনৈতিক দল বা ছাত্রদের নয়, এটি সারাদেশের সকল দেশপ্রেমিক মানুষের দাবি।

তীব্র গরমে স্বস্তি পেতে স্প্রে ক্যানন : আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে শুক্রবার পৌনে তিনটায় রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনের সমাবেশ শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। সমাবেশ শুরু হওয়ার পর প্রচণ্ড রোদে সমাবেশস্থল গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন আন্দোলনকারীরা। পরে সমাবেশস্থলের পরিবেশ ঠান্ডা রাখতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) স্প্রে ক্যানন দিয়ে পানি ছিটানো শুরু হয়। স্প্রে ক্যানন দিয়ে পানি ছিটানোর পর সমাবেশস্থলে উপস্থিত থাকা আন্দোলনকারীদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি লক্ষ্য করা যায়। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পানি ছিটিয়ে স্বস্তি দেওয়ায় আন্দোলনকারীরা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এমন উদ্যোগকে ধন্যবাদ জানায়। সরেজমিনে দেখা যায়, ইসলামি বিভিন্ন দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা মিছিল সহকারে সমাবেশস্থলে আসছেন। সাধারণ ছাত্র-জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন।

শাহবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খালিদ মনসুর বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেছেন। ঘটনাস্থলে পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এর মাধ্যমে পতন হয় আওয়ামী লীগ স্বৈরশাসনের। জাতিসংঘের হিসাব মতে, ওই অভ্যুত্থানে হাসিনার নির্দেশে নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলাসহ সহিংসতায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তাদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার অভ্যুত্থানে সক্রিয় ছাত্র-জনতা।

আ.লীগ নিষিদ্ধে দ্রুত সিদ্ধান্ত না এলে আবারও ‘মার্চ টু ঢাকা’ : আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত না এলে আবারও ‘মার্চ টু ঢাকা’র মতো কর্মসূচি দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।

গতকাল শুক্রবার চলমান ‘শাহবাগ ব্লকেড’ কর্মসূচির মধ্যেই নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে এ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা ফেসবুক পোস্টে বলেন, শাহবাগের অবস্থান চলমান থাকবে। দলমত নির্বিশেষে আওয়ামী লীগ ও দেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে জুলাইয়ের সকল শক্তি এক থাকবে, এটাই প্রত্যাশা। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ব্লকেড চালু হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত না এলে সমগ্র বাংলাদেশ আবারও ঢাকা শহরে মার্চ করবে। নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, দেশের সার্বভৌমত্ববিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী, জুলাইবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী, ইসলামবিরোধী, নারীবিরোধী, মানবতাবিরোধী ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসী মুজিববাদী সংগঠন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধকরণে বাংলাদেশপন্থি সকল শক্তি ঐক্যবদ্ধ হই।

আওয়ামী লীগ,শাহবাগ,নিষিদ্ধ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত