ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

রাজস্ব আহরণে সর্বোচ্চ জোর

রাজস্ব আহরণে সর্বোচ্চ জোর

দেশের সাধারণ মানুষ কয়েক বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দিশাহারা। দেশের অর্থনীতির মন্দায় আক্রান্ত। অর্থ পাচার, ডলার সংকট, রিজার্ভের বড় ক্ষয়সহ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বিপদে ছিল বাংলাদেশ। এরপরও অর্থনীতির কোনো সূত্র না মেনেই প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়িয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্যও রেকর্ড ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই বাজেট বাস্তবায়ন শুরুর এক মাস পরই গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতা হারায় শেখ হাসিনা সরকার। সেই বাজেটই টেনে নিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। মাঝপথে এসে সংশোধন করে বাজেটের আকার ৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছিল। যদিও সংশোধিত এ বাজেটও বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কেননা, অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই (জুলাই-এপ্রিল) রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ঠেকেছে ৭১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকায়। রাজস্ব আহরণের নাজুক এই পরিস্থিতির মধ্যেই আজ সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে এদিন বিকেল ৪টায় বাজেট ঘোষণা করবেন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, নতুন অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এটি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ঘোষিত বাজেটের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম হলেও সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা বেশি।

দেশের অর্থনীতিতে স্থবিরতার পাশাপাশি বর্তমানে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের অবস্থাও নাজুক। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কার ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে রাজস্ব কর্মকর্তারা। এই পরিস্থিতিতেও এনবিআরকে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এনবিআর ও কর-বহির্ভূত রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ পালিয়ে যাওয়া অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর দেওয়া বাজেটের মতোই ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে এই ঘাটতি পূরণ করবে অন্তর্বর্তী সরকার।

শেখ হাসিনার গড়ে তোলা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় অপ্রয়োজনীয় অনেক মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। উন্নয়নের কথা বলে ঋণনির্ভর সেসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও এক্ষেত্রে লুটপাটই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বলে অন্তর্বর্তী সরকারের তৈরি করা শ্বেতপত্রে তুলে ধরা হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন বাজেটে এডিপি বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরের এডিপি বরাদ্দও ১৪ হাজার কোটি টাকা বেশি। নতুন বাজেটে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে পরিচালন ও নন-এডিপি খাতে। চলতি বাজেটে এ খাতে ৫ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, সংশোধিত বাজেটে যা কমিয়ে ৫ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়।

রাষ্ট্রের নাগরিকদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, সুরক্ষা, মৌলিক সেবার নিশ্চয়তা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সর্বোপরি বৈষম্য নিরসনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রণীত বাজেটগুলো পরিচিত জনকল্যাণমুখী বাজেট হিসেবে। অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষ বহু বছর ধরে জনকল্যাণমুখী বাজেটবঞ্চিত হয়ে আসছে। এতদিন বাজেট মানেই ছিল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে জনগণের অর্থের যথেচ্ছ তছরুপ। আর পরিচালন ব্যয়ের নামে সরকারি কর্মকর্তাদের অপব্যয় ও দুর্নীতি। অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে সুযোগ ছিল জনকল্যাণমুখী বাজেট দিয়ে জনগণকে স্বস্তি দেওয়ার; দেশি-বিদেশি ঋণনির্ভর ঘাটতি বাজেট থেকে বেরিয়ে আসার; শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে বৈষম্য কমিয়ে আনার। কিন্তু এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, তাতে স্বস্তির কোনো আভাস মেলেনি। রাজনৈতিক কোনো চাপ না থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকার জনতুষ্টির বাজেটের দিকেই হাঁটছে।

গুণগত মানকে বিসর্জন দিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারও পরিমাণকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী। ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার এখনও বাজেট ঘোষণা করেনি। কিন্তু এখন পর্যন্ত যেটুকু আভাস পাওয়া গেছে, তাতে এটি গতানুগতিক একটি বাজেটই হতে যাচ্ছে। বিগত সময়ে আমরা যেসব অবাস্তব বাজেট দেখেছি, এটি তারই ধারাবাহিকতা হবে বলেই মনে হচ্ছে। গত বছরের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে সরকারের কাছে যে বিপুল প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, সেটি অন্তত অর্জিত হচ্ছে না।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী আরও বলেন, ‘আগে যেভাবে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হতো, এবারের বাজেটেও একইভাবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতিতে স্থবিরতা চলছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। নতুন বিনিয়োগ কিংবা কর্মসংস্থানের পরিস্থিতিও খুবই খারাপ। তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসা উচ্চ মূল্যস্ফীতিও চলমান। অথচ এনবিআরকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়ার ক্ষেত্রে এগুলোকে বিবেচনায়ই নেওয়া হয়নি। একটি স্বাভাবিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এনবিআরকে যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হতো, সেভাবেই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। অতীতের মতো আগামী অর্থবছরের বাজেটও অবাস্তবায়িতই থেকে যাবে।’

গত দেড় দশকজুড়ে ঘোষিত বাজেট ছিল অনেকটাই ঋণনির্ভর। প্রতিবারই আকার বাড়িয়ে বাজেট ঘোষণা করা হলেও কোনো অর্থবছরেই তার পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাজেট বাস্তবায়নের গড় হার ছিল ৮৬ শতাংশ। অর্থাৎ অর্থবছরের শুরুতে যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল, বছর শেষে এর ১৪-১৫ শতাংশ অবাস্তবায়িত থেকে গেছে। পরে এ অবাস্তবায়িত বাজেটের অংশ আরও বড় হয়েছে।

বছরের পর বছর ধরে ঘাটতি বাজেট ঘোষণা করায় সরকারের ঋণের বোঝা কেবলই স্ফীত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত বছরের জুন শেষে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের স্থিতি ছিল অন্তত ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন সরকারের ঋণ স্থিতি মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা ছিল। সেই হিসাবে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলেই সরকারের ঋণ স্থিতি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা বেড়েছে, যা সরকারের মোট ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ। সরকারের নেওয়া এসব ঋণের সুদ পরিশোধেই চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ৯৬ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। এর মধ্যে ৮১ হাজার ৫৩১ কোটি টাকার সুদ পরিশোধ হয়েছে দেশি উৎস থেকে নেওয়া ঋণের বিপরীতে। বাকি ১৪ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকার সুদ বিদেশি ঋণের জন্য পরিশোধ করতে হয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাজেটের আকার দ্বিগুণ-তিন গুণ হলেও আনুপাতিক হারে বরাদ্দ কমেছে জনগুরুত্বপূর্ণ খাত স্বাস্থ্য ও শিক্ষায়।

শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৮৮ শতাংশ। ওয়াসার পানির দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশের কাছাকাছি। অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দামও। জনগণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা এসব গণদ্রব্যের দাম কমানোর সুযোগ ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে। অথচ বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেল ও পানির মতো গণদ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ চলছে আগের পদ্ধতিতেই।

২০০৭ ও ২০০৮ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দুটি বাজেট ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমরা সামাজিক নিরাপত্তা বরাদ্দ ও ব্যাপ্তি বাড়িয়েছিলাম। স্থানীয় শিল্প সংরক্ষণে শুল্ক কাঠামোয় পরিবর্তন ও কিছু ক্ষেত্রে করহার কমানো হয়েছিল। সরকারের অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করেছি। আমার সময়ের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। এখন দেশের ব্যাংক খাত ও পুঁজিবাজার খুবই দুর্বল। আবার সরকারের ঋণের বোঝাও অনেক বড়। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ কমিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ জনগুরুত্বপূর্ণ খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া।’

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে প্রায় তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চাপে দিশাহারা দেশের সাধারণ মানুষ। তাই মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদহার বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও একই নীতি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে নীতি সুদহার উন্নীত করা হয়েছে ১০ শতাংশে। যদিও এখন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি।

অতিসংকোচনমূলক মুদ্রানীতির প্রভাবে বেসরকারি খাত, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প তীব্র তারল্য সংকটে পড়েছে। ঋণের সুদহার উঠে গেছে ১৫-১৬ শতাংশে। আর তৈরি পোশাক খাতসহ প্রায় সব শিল্পেই অসন্তোষ ও স্থবিরতা চলছে। গত দেড় দশকে দেশে পরিবহন ব্যয় বহুগুণ বেড়েছে। এক্ষেত্রে অভিযোগ ছিল বিপুল অংকের চাঁদাবাজির। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ শ্রমিক নেতা পালিয়ে গেলেও পরিবহন ভাড়া কমেনি। এখনও বহাল রয়েছে জমি, প্লট-ফ্ল্যাটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগও। নতুন অর্থবছরের বাজেটেও একই সুযোগ বহাল রাখা হচ্ছে বলে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এবারের বাজেট দর্শন হলো- একটা সমতাভিত্তিক কল্যাণরাষ্ট্র গড়ে তোলা। আমাদের লক্ষ্য হলো একটা বাস্তবভিত্তিক বাজেট করা। সীমিত সম্পদ নিয়ে উচ্চাভিলাষী বাজেট প্রণয়ন করব না। বড় কোনো প্রকল্প নেওয়া হবে না। মানুষের প্রত্যাশা বাড়াতে চাই না। এবারের বাজেট দর্শন হলো একটা সমতাভিত্তিক কল্যাণরাষ্ট্র গড়ে তোলা। এতদিন আমরা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির কথা বলে এসেছি; কিন্তু এ প্রবৃদ্ধির সুফল জনগণ ন্যায্যভাবে পায়নি। কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হওয়ার পথে আমরা এগোতে পারিনি। এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে জোর দিতে চাই। তরুণ ও যুবকদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে আমরা মনোযোগ দিতে চাচ্ছি, উন্নয়নশীল দেশে যা খুবই প্রয়োজন। এসব প্রেক্ষিত মাথায় রেখে নিজস্ব সম্পদ এবং বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানসহ সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে।’

সূত্রমতে, মূল্যস্ফীতি চড়া। মানুষের প্রকৃত আয় কমছে। কিন্তু ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সাধারণ করদাতাদের আয়করে বড় কোনো ছাড় দেওয়ার পরিকল্পনা নেই সরকারের। গত শনিবার পর্যন্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমায় কোনো পরিবর্তন আসছে না। অর্থাৎ করমুক্ত আয়সীমা বাড়ছে না।

সূত্রমতে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য কর বাড়তে পারে। পুঁজিবাজারে অনিবন্ধিত কোম্পানির ক্ষেত্রে বাড়বে করপোরেট করহার। আবার লাভ হোক, লোকসান হোক, নির্দিষ্ট হারে যে কর দিতে হয়, সেটা এবার বাড়তে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর ছাড় দেওয়া হতে পারে। যেমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে ন্যূনতম কর কিছুটা কমবে। জমি কেনাবেচায় কর কমানো হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হতে পারে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা ২০২৫-২৬ করবর্ষে অপরিবর্তিত থাকছে। তবে করস্তরগুলোর সর্বোচ্চ স্তরে ধনীদের জন্য সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ কর বসানোর প্রস্তাব থাকতে পারে, যা এখন ২৫ শতাংশ।

বর্তমানে ব্যক্তি করদাতার করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা। অর্থাৎ, বছরে এই পর্যন্ত আয় হলে কর দিতে হয় না। আবার মোট আয় থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা বাদ দিয়ে করের পরিমাণ হিসাব করা হয়। এ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হলে মানুষ স্বস্তি পায়। বাংলাদেশে করমুক্ত আয়সীমা কম এবং মূল্যস্ফীতির হার চড়া- এ দুই বিবেচনায় ছাড় দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন অনেকেই।

সূত্র জানায়, এবার কোনো ছাড় দেওয়ার পরিকল্পনা গতকাল পর্যন্ত ছিল না। তবে বাজেটে পরের দুই করবর্ষে করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা রাখার ঘোষণা থাকবে। সে ক্ষেত্রে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত গেজেটভুক্ত ব্যক্তিদের করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা করা হতে পারে।

ন্যূনতম করে ছাড় দেওয়া হতে পারে নতুন করদাতাদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে। বর্তমানে এলাকাভেদে ন্যূনতম কর ৩ তিন থেকে ৫ হাজার টাকা, যা নতুন করদাতাদের জন্য কমিয়ে এক হাজার টাকা করা হতে পারে।

বর্তমানে সারা দেশে ১ কোটি ১১ লাখ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। এর মধ্যে বছরে গড়ে ৪০ লাখের মতো টিআইএনধারী রিটার্ন দেন। মানে হলো, কর দেন অনেক কমসংখ্যক মানুষ।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হলে তা নিচের দিকে থাকা করদাতাদের জন্য স্বস্তি নিয়ে আসত। এমনিতেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

আগামী অর্থবছরে আয়কর রিটার্নের প্রমাণপত্র দেখানোয় বড় ছাড় আসছে। বর্তমানে ৪৫ ধরনের সেবা নিতে আগের অর্থবছরের রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র লাগে। সঞ্চয়পত্র কেনাসহ বেশ কিছু খাতের এই বাধ্যবাধকতা থাকছে না। তবে ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা থাকছে।

করমুক্ত দানের আওতায় স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা ও সন্তানের পাশাপাশি আপন ভাই ও বোনকে অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। বেসরকারি চাকরিজীবীদের করযোগ্য আয় গণনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বাদযোগ্য অঙ্কের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। এখন নানা ধরনের ভাতাসহ সাড়ে চার লাখ টাকা পর্যন্ত আয় বাদ দেওয়া যায়। এই অঙ্ক বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা করা হতে পারে। এতে কিছুটা ছাড় পাবেন চাকরিজীবীরা।

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের আয় এবং জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সর্বজনীন পেনশন স্কিম বা কর্মসূচি থেকে প্রাপ্ত সুবিধাভোগীর আয় করমুক্ত থাকবে।

বাজেটে করপোরেট কর বাড়তে পারে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে করপোরেট কর সাড়ে ২৭ শতাংশ করা হতে পারে। ব্যাংকসহ আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থায় লেনদেনের শর্তে করপোরেট কর ২৫ শতাংশই থাকবে। তবে সে শর্ত পূরণ কঠিন হতে পারে।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য ২০ শতাংশ করপোরেট কর অব্যাহত থাকছে। মার্চেন্ট ব্যাংকের করহার সাড়ে ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করার প্রস্তাবও করতে পারেন অর্থ উপদেষ্টা। এ ছাড়া সিকিউরিটিজ লেনদেনের মোট মূল্যের ওপর ব্রোকারেজ হাউসগুলোর ওপর করহার কমানো হতে পারে।

বর্তমানে বছরে তিন কোটি টাকার বেশি টার্নওভার (বছরে লেনদেন) হয় এমন প্রতিষ্ঠানকে লাভণ্ডলোকসান নির্বিশেষে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ কর দিতে হয়। এটি বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হতে পারে।

বর্তমানে জমি কেনায় করহার বেশি। এই করহার কমানোর প্রস্তাব করতে পারেন অর্থ উপদেষ্টা, যাতে কালো টাকা তৈরি না হয়। এখন কর ফাঁকি দিতে অনেকেই জমির মূল্য কম দেখান। এতে কালো টাকা তৈরি হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, জমি কেনাবেচার ওপর কর এলাকাভেদে ৬, ৪ ও ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে, যা এখন ৮,৬ ও ৪ শতাংশ। ফ্ল্যাট ও জমি কেনায় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বর্তমানে যে করহার আছে, তা এলাকাভেদে কয়েক গুণ বাড়ানো হবে বলে জানা গেছে। এমনকি অর্থের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করার সুযোগও রাখা হতে পারে।

বাজেট বক্তৃতায় পাচার অর্থ ও সম্পদের ওপর কর ও জরিমানা আরোপ করার ঘোষণা দিতে পারেন অর্থ উপদেষ্টা। জানা গেছে, জন্মসূত্রে বাংলাদেশি ছিলেন, কিন্তু পরে নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেছেন, এমন ব্যক্তিরা যদি বাংলাদেশে অর্জিত আয়ের ওপর যথাযথভাবে কর না দেন এবং নানা উপায়ে বিদেশে পাচার করেন, তাহলে ওই অর্থের ওপর কর ও জরিমানা আরোপ করা হতে পারে।

বাজেটে আবগারি শুল্ক বসানোর সীমা বাড়তে পারে। বর্তমানে এক লাখ পর্যন্ত ব্যাংক হিসাবের স্থিতিতে কোনো আবগারি শুল্ক দিতে হয় না। এটি বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা করার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। আবগারি শুল্ক আরোপের স্তরও পুনর্বিন্যাস করা হতে পারে। প্রতিবছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে কোনো ব্যাংক হিসাবে আমানতের পরিমাণ যদি একবার আবগারি শুল্ক আরোপের সীমা অন্তত একবার স্পর্শ করে, তাহলে নির্দিষ্ট হারে আবগারি শুল্ক দিতে হয়।

বাজেটে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) বাড়ানোর কারণে রেফ্রিজারেটর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) ও মুঠোফোনের দাম বাড়তে পারে।

শুল্ক হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে দাম কমতে পারে বাস, মাইক্রোবাস, চিনি, বিদেশি মাখন, ড্রিংক, সিরিশ কাগজ, ক্রিকেট ব্যাট ইত্যাদির। দাম বাড়তে পারে রড, ফেসওয়াশ, লিপস্টিক, চকলেট ইত্যাদির।

বাজেটের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) এরই মধ্যে সরকার জানিয়েছে। সেখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়নি। বাজেটে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ও অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সুপারিশের প্রতিফলনও খুব একটা থাকছে না। করের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, বড় কোনো পরিবর্তন নেই।

এ কঠিন সময়ে সাধারণ মানুষ নিত্য ব্যবহার করে এমন সব জিনিসপত্রে শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে নতুন করে শুল্ক বাড়ানো হলে আরেক দফা দাম বাড়তে পারে। এতে মানুষের জীবনযাপনের ব্যয়ও বাড়বে। প্রতিবছর বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের ভ্যাট ও শুল্ক-কর বাড়িয়ে থাকে। এতে বাজারে সেসব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। যেসব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে সেগুলো হলো-

ফ্রিজ-এসি : অব্যাহতির সংস্কৃতির পরিহার করতে রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনারের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এতে দেশীয় ফ্রিজ-এসির দাম বাড়তে পারে। পাশাপাশি বিদেশি ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী আমদানি বাড়তে পারে।

মোবাইল ফোন : মোবাইল ফোন উৎপাদন ও সংযোজনে হ্রাসকৃত ভ্যাটহার বাড়ানোর হচ্ছে। উৎপাদনের ক্যাটাগরিভেদে ২ থেকে আড়াই শতাংশ ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। এতে দেশে তৈরি মোবাইল ফোনের দাম বাড়তে পারে।

ব্লেড : সেলুনে শেভিং কাজে ব্যবহৃত ব্লেডের দাম বাড়তে পারে। কারণ স্টেইনলেস স্টিলের স্ট্রিপ থেকে প্রস্তুত ব্লেড এবং কার্বন স্টিলের স্ট্রিপ থেকে প্রস্তুতকৃত ব্লেডের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ শতাংশ করা হচ্ছে।

বাস-ট্রাক ; বাস-ট্রাকের চেসিস বিদেশ থেকে আমদানির পর দেশে বডি প্রস্তুত করে রাস্তায় চলাচলের উপযোগী করা হয়। বাস-ট্রাকের বডি বানানোর ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। এতে বাস-ট্রাকের দাম বাড়বে।

টেবিলওয়্যার : বাসা-বাড়িতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের তৈরি টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, গৃহস্থালি সামগ্রী, হাইজেনিক ও টয়লেটসামগ্রী উৎপাদনে ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে এসব পণ্যের দাম বাড়বে।

সুতা : দেশীয় টেক্সটাইল মিলে উৎপাদিত সুতার ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। প্রতি কেজি কটন সুতা ও ম্যান মেইড ফাইবারে তৈরি সুতার সুনির্দিষ্ট কর তিন টাকা থেকে বাড়িয়ে পাঁচ টাকা করা হচ্ছে। এতে দেশীয় সুতায় তৈরি গামছা, লুঙ্গিসহ পোশাকের দাম বাড়তে পারে।

রড: রড, এঙ্গেল বার তৈরির প্রধান কাঁচামাল স্ক্র্যাপের সুনির্দিষ্ট করের পরিমাণ এক হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ২০০ টাকা করা হচ্ছে। এছাড়া বিলেট-ইনগট সুনির্দিষ্ট কর এবং স্ক্র্যাপ গলানোর রাসায়নিকের ফেরো ম্যাঙ্গানিজ ও ফেরো সিলিকা ম্যাঙ্গানিজের শুল্ক-কর বাড়ানো হচ্ছে। বিধায় নির্মাণসামগ্রীর প্রধান উপকরণ রডের দাম বাড়তে পারে।

হেলিকপ্টার : নতুন অর্থবছরে হেলিকপ্টার আমদানিতে ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসানো হতে পারে। তাতে হেলিকপ্টার আমদানির খরচ বাড়বে।

কসমেটিক্স : নারীদের সৌন্দর্যবর্ধনে ব্যবহৃত লিপস্টিক, লিপলাইনার, আইলাইনার, ফেসওয়াশ, মেকআপের সরঞ্জাম আমদানির ন্যূনতম মূল্য বিভিন্ন হারে বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে প্রতি কেজি লিপস্টিক আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কায়নের ন্যূনতম মূল্য ২০ ডলার আছে। সেটি বাড়িয়ে ৪০ ডলার করা হতে পারে। একইভাবে অন্য সব কসমেটিক্সের ন্যূনতম মূল্য বাড়ানো হচ্ছে। বিধায় বাজেটের পর এসব সৌন্দর্যবর্ধক সামগ্রীর দাম বাড়তে পারে।

বিদেশি চকোলেট : চকোলেটের দামও বাড়তে পারে। চকলেট আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কায়নের ন্যূনতম মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব থাকছে বাজেটে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের চকলেটের শুল্কায়নের ন্যূনতম মূল্য চার ডলার। এটি বাড়িয়ে ১০ ডলার করা হচ্ছে। এতে আমদানি করা সব ধরনের চকোলেটের দাম বাড়তে পারে।

খেলনা : স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে বাজেটে বিদেশি খেলনার ট্যারিফ মূল্য বাড়ানো হচ্ছে। এতে বিদেশি খেলনার দাম বাড়বে।

মার্বেল-গ্রানাইট : বাসা-বাড়ির মেঝেতে ব্যবহৃত মার্বেল-গ্রানাইড পাথর আমদানির সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শাতংশ করা হচ্ছে। এতে মার্বেল-গ্রানাইডের দাম বাড়তে পারে।

মোটর : ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণে এতে ব্যবহৃত ৭৫০ ওয়াটের ডিসি মোটরের আমদানি শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে।

এছাড়াও দাম বাড়তে পারে- মাখন, তারকাঁটা, সব ধরনের স্ক্রু, নাট-বোল্ট, ইলেকট্রিক লাইন হার্ডওয়্যার, পোল ফিটিংস, সেল্ফ কপি পেপার, ডুপ্লেক্স বোর্ড-কোটেড পেপার, প্লাস্টিকের তৈরি ওয়ান টাইম গ্লাস, বাটি, প্লেট, তামাক বীজ, মোটরসাইকেল ও সাইকেলের যন্ত্রাংশ, গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের ফুড সাপ্লিমেন্ট, বেভারেজ আইটেম, দরজার তালা ইত্যাদি।

এবার বাজেটে মূল্যস্ফীতি ও শিল্পখাতের ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে কিছু পণ্যের শুল্কহার কমানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে। ফলে কিছু পণ্যের দাম কমতে পারে। যেসব পণ্যের দাম কমতে পারে সেগুলো হলো-

আইসক্রিম : সব বয়সি মানুষের পছন্দ আইসক্রিম। আগামী বাজেটে সরবরাহ পর্যায়ে আইসক্রিমের সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এ কারণে বাজারে আইসক্রিমের দাম কমতে পারে।

বাস-মাইক্রোবাস : যানজট কমাতে ১৬ থেকে ৪০ আসনবিশিষ্ট বাস আমদানিতে শুল্ক কমতে পারে। বর্তমানে এ ধরনের যানবাহন আমদানিতে ১০ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক আছে। এটি কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এছাড়া মাইক্রোবাসের সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে বাস-মাইক্রোবাসের দাম কমতে পারে।

লবণ : আয়োডিনযুক্ত লবণ উৎপাদনের ব্যবহৃত পটাশিয়াম আয়োডেট দাম বাড়ায় বাজারে লবণের দাম বাড়ছে। তাই আগামী বাজেটে পটাশিয়াম আয়োডেটের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এতে বাজারে লবণের দাম কমতে পারে।

চিনি : পরিশোধিত চিনি আমদানিতে সুনির্দিষ্ট শুল্ক টনপ্রতি সাড়ে ৪ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে চার হাজার টাকা করা হচ্ছে। এতে চিনির দাম কমতে পারে।

শিরিশ কাগজ : শিরিশ কাগজের কাঁচামাল ফেনোলিক রেজিন এবং স্যান্ড পেপার কোটিং ম্যাটেরিয়ালের আমদানি শুল্ক কমানো হচ্ছে। এতে বাজারে শিরিশ কাগজের দাম কমতে পারে।

ক্রিকেট ব্যাট : দেশে ক্রিকেট ব্যাট তৈরি কারখানার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে বিদেশি ক্রিকেট ব্যাটের আমদানিনির্ভরতা কমেছে। দেশীয় এই শিল্পকে আরও উৎসাহ দিতে ব্যাট তৈরির প্রধান কাঁচামাল কাঠ আমদানির শুল্ক ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৬ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে বাজারে ক্রিকেট ব্যাটের দাম কমতে পারে।

এছাড়াও দাম কমতে পারে- মাখন, পোড়ামাটির প্লেট ও পচনশীল উপাদানে তৈরি গ্লাস, প্লেট ও বাটি ইত্যাদি, জাপানের জনপ্রিয় সী-ফুড স্ক্যালোপ, হোস পাইপ ইত্যাদির। পাশাপাশি জাপানি সিফুড স্ক্যালোপ আমদানিতে আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হতে পারে। এতে স্ক্যালোপের দাম কমতে পারে। এ ছাড়া দাম কমতে পারে বিদেশি মাখন, ড্রিংক ইত্যাদির। অন্যদিকে দাম কমতে পারে দেশি সিরিশ কাগজের।

বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যেতে হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে আগামী বাজেটে সরকার বেশকিছু কর ও শুল্ক ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে। আগামীকাল সোমবার ২ জুন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করার কথা আছে। সেখানে প্রস্তাবিত উদ্যোগগুলোর কথা তিনি জানাবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এর মধ্যে থাকছে ব্যবসার খরচ কমানো ও উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করনীতি ঘোষণা।

বাজেটে মূল প্রস্তাবগুলোর মধ্যে থাকছে ৬২২ পণ্যের ওপর থেকে সম্পূরক শুল্ক তুলে নেওয়া বা কমানো এবং বাণিজ্য বাড়াতে আরও ১০০ পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক কমানো। এর মধ্যে আছে হিমাগারের যন্ত্রপাতি, কাগজের পণ্য, বাস, নিউজপ্রিন্ট, ক্যানসারের চিকিৎসার সরঞ্জাম এবং ওষুধ ও পরিবেশবান্ধব পণ্যের কাঁচামাল।

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি ও ওষুধের কাঁচামালে শুল্ক ছাড় দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতে আমদানিতে ভুল ঘোষণার জরিমানা বর্তমানের ৪০০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০০ শতাংশ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর বাংলাদেশের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে এসব উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মার্কিন শুল্ক প্রতিক্রিয়া : যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্ভাব্য বাণিজ্য সংকট মোকাবিলায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অতিরিক্ত ১০০ পণ্যে শূন্য আমদানি শুল্কের প্রস্তাব করতে যাচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিগত পরিবর্তনের পর বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ৩৭ শতাংশ শুল্কের প্রভাব কমাতে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এই তালিকায় থাকছে বস্ত্র খাতের কাঁচামাল, সামরিক সরঞ্জাম ও শিল্পকারখানার যন্ত্রপাতি। নতুন শুল্কের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে এবং বাজারে মার্কিন পণ্য বাড়াতে শুল্কমুক্ত পণ্যের তালিকা বাড়াতে চায় সরকার।

ওষুধ শিল্পে সহায়তা : ওষুধ খাতকে শক্তিশালী করতে এবং স্বাস্থ্যসেবার খরচ কমাতে বাজেটে ওষুধের কাঁচামাল ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ওপর শুল্ক কমানো হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে ক্যানসার, কিডনি ও রক্তনালীর রোগের ওষুধ প্রস্তুতকারকদের জন্য অতিরিক্ত ৭৯ পণ্য শুল্কমুক্ত করা হতে পারে। এই উদ্যোগটি দেশে চিকিৎসা খরচ কমাবে এবং স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

হিমাগার, খেলনা ও ক্রিকেট ব্যাট তৈরিতে সুবিধা : কৃষিপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে ও ফসল কাটার পর লোকসান কমাতে হিমাগারের যন্ত্রপাতির ওপর শুল্ক মওকুফ করার পরিকল্পনা করছে সরকার।

খেলনা ও ক্রিকেট ব্যাট উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের ক্ষেত্রেও শুল্ক কমানোর সম্ভাবনা আছে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমদানি করা ফিনিশড টয়গুলোর শুল্ক প্রতি কেজি চার ডলার ও ক্রিকেট ব্যাট তৈরিতে ব্যবহৃত উইলো কাঠের শুল্ক ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৬ শতাংশ করা হতে পারে।

গণপরিবহন ও মাইক্রোবাসের শুল্ক : যানজট দূর করার লক্ষ্যে ১৬-৪০ আসনের বাসের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করা হচ্ছে। একইভাবে মাইক্রোবাসের (১০-১৫টি আসন) সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে।

চিনির আমদানি শুল্ক : দেশে উৎপাদিত চিনির দাম স্থিতিশীল রাখতে ও রাজস্ব আয় বাড়াতে সরকার পরিশোধিত চিনির আমদানি শুল্ক টনপ্রতি সাড়ে চার হাজার টাকা থেকে কমিয়ে চার হাজার টাকা করতে পারে।

সফটওয়্যার রপ্তানিতে উৎসাহ

দেশে তৈরি সফটওয়্যার রপ্তানি বাড়াতে সরকার ডেভেলপমেন্ট টুলস, অপারেটিং সিস্টেম, ডাটাবেজ ও সিকিউরিটি সফটওয়্যারের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করতে পারে।

বিলাসবহুল পণ্যে শুল্ক : অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের শুল্ক কমানোর পাশাপাশি সরকার কয়েকটি বিলাসবহুল পণ্যের শুল্ক বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। যেমন, লিপস্টিক ও ফেসওয়াশের ন্যূনতম শুল্ক দ্বিগুণ বাড়িয়ে প্রতি কেজি ৪০ ডলার করা হতে পারে।

হেলিকপ্টার আমদানিতে শুল্ক : আমদানি করা হেলিকপ্টারের শুল্ক এক শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই উদ্যোগে পরিবহন ও জরুরি প্রয়োজনে হেলিকপ্টারের ওপর নির্ভরশীল ব্যবসা ও পরিষেবার খরচ বাড়তে পারে।

এলএনজি আমদানিতে ভ্যাট ছাড় : বাজেটে এলএনজি আমদানিতে বিদ্যমান ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন করে (ভ্যাট) ছাড় দেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কারখানার জ্বালানি খরচ কমাতে সহায়তা করবে।

করপোরেট ও আয়করে পরিবর্তন : রাজস্ব বাড়াতে সরকার ধনীদের আয়করের হার ৩০ শতাংশ করে বেশ কয়েকটি আয়করের সমন্বিত ব্যবস্থা চালু করতে পারে। গতিশীল কর কাঠামো চালু করে অন্যান্য আয়কর হার সামঞ্জস্য করা হতে পারে।

প্রসঙ্গত, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামীকাল সোমবার আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেট দেবেন। তিনি টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণের মাধ্যমে এবারের বাজেট উপস্থাপন করবেন। এটা হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট। দেখা যাচ্ছে, সরকার বাজেটের কর খাতে বড় কোনো পরিবর্তন আনছে না। কিছু হেরফের করা হচ্ছে।

রাজস্ব আহরণ,মূল্যস্ফীতির চাপ,অর্থ পাচার,ডলার সংকট
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত