জীবনযাত্রার মান সহজ করতেই এবারের বাজেট এমন মন্তব্য করে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধি থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের জীবনযাত্রার মান সহজ করার বিষয় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বাজেটে। নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট দেওয়া হয়েছে। সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে বাজেট করিনি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি; ব্যাংক ও জ্বালানি খাতের সমস্যা এবং রাজস্ব আদায়ের খারাপ পরিস্থিতি- এসব কিছুর মধ্যেই বাজেট করতে হয়েছে। প্রথমবারের মতো বাজেটের আকার বাড়ানো হয়নি। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পরদিন গতকাল মঙ্গলবার বিকালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এসব কথা বলেন। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আবদুর রশীদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান এসময় উপস্থিত ছিলেন। দর্শনার্থীর কাতারে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন। গতকাল বেলা ৩টায় শুরু এ সংবাদ সম্মেলনের প্রথম ৩০ মিনিট কথা বলেন অর্থ উপদেষ্টা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা। এরপর শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব, যা চলে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। সাধারণত এ সংবাদ সম্মেলন দুই ঘণ্টা ধরে চলে।
অর্থ উপদেষ্টা শুরুতেই বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নেই। তাই জাতির সামনে বাজেট উপস্থাপন করেছি। কারণ, আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ তিনি বলেন, ‘যে সময়ে আমরা দায়িত্ব নিয়েছি, তা এক কঠিন সময়। আমরা ক্ষমতা নিইনি, দায়িত্ব নিয়েছি। তাও দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে।’
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘অনেকেই বলেছেন দেশ আইসিইউতে ছিল, খাদের কিনারে চলে আসছিল, বিশেষ করে আর্থিক ব্যবস্থাপনায়। সে সময় যদি আমরা দায়িত্ব না নিতাম, তাহলে কী যে হতো...! দেশের অবস্থা আরও খারাপ হতো। সবাই মিলে দেশটাকে এখন একটা স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসতে পেরেছি।’
সম্পদ সীমিত, চাহিদা অনেক বেশি। বাইরে থেকে সম্পদ আনা, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, পুঁজিবাজারের অবস্থা, ব্যাংকের অবস্থা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি- সব মিলিয়ে একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা ছিল। এর ভেতরেই কাজ করতে হচ্ছে। এসব কথা জানিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘যে সংস্কারগুলো আমরা হাতে নিয়েছি, সেগুলো চলমান। যতটুকু পারি করব। তবে আমরা একটা পদচিহ্ন রেখে যাব। আশা করছি, পরে যারা আসবেন, তারা বাকিগুলো বাস্তবায়ন করবেন।’
সাংবাদিকদের উদ্দেশে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আপনারা এত দিন তো প্রবৃদ্ধির বয়ান শুনেছেন, তার সুবিধা কে পেয়েছে? সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আমরা মানুষের জীবনমান উন্নয়ন হয়, ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য যাতে চালিয়ে যেতে পারে, সেসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাজেট সাজিয়েছি।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জনগণের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতেই রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি এবং এনবিআর সংস্কার করছি। প্রাথমিকভাবে মনে করি জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব বাজেট হয়েছে। অনেকে বলেছেন আমরা আগের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছি। আসলে চট করে বিপ্লবী একটা বাজেট দিয়ে দেব, দারুণ একটা রাজস্ব আয় করে ফেলব, তা সম্ভব নয়। আমরা কিছু পদাঙ্ক অনুসরণ করে সামনে এগোচ্ছি।’
ক্রান্তিলগ্নে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে সবাই মিলে চেষ্টা করে দেশটাকে একটা স্থিতিশীল অবস্থান নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে এমন মন্তব্য করে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা ক্ষমতা নেইনি, দায়িত্ব নিয়েছি। দায়িত্বটা একটা কঠিন সময়ে নিয়েছি। সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংসদ না থাকায় আমরা জাতির সামনে বাজেট উপস্থাপন করেছি। অর্থ বিলে রাষ্ট্রপতি সই করেছেন। সেটা দ্রুতই হবে। সেখানে যদি কিছু থাকে সেটাও আমরা চেষ্টা করব নিতে। তিনি বলেন, আমরা ক্ষমতা নেইনি, দায়িত্ব নিয়েছি। দায়িত্বটা একটা কঠিন সময়ে নিয়েছি। দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে। অনেকেই বলেছেন দেশ আইসিইউতে ছিল, খাদের কিনারে চলে আসছিল, বিশেষ করে আর্থিক ব্যবস্থাপনায়। সে সময় যদি আমরা দায়িত্ব না নিতাম তাহলে কি হতো। যা-ই হোক আমরা চেষ্টা করে সবাই মিলে দেশটাকে একটা স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসতে পেরেছি। তিনি আরও বলেন, যে সংস্কারগুলো আমরা হাতে নিয়েছি সেটা চলমান। আমরা যতটুকু পারি করব। আমরা যে পদচিহ্ন রেখে যাব (ফুটপ্রিন্ট) আশা করছি পরে যারা আসবে তারা সেটা বাস্তবায়ন করবে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বাজেটের প্রেক্ষিত আপনারা জানেন যে, আমাদের সম্পদ সীমিত, চাহিদা অনেক বেশি। বাইরে থেকে সম্পদ আনা, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, পুঁজিবাদের অবস্থা, ব্যাংকের অবস্থা, আইনশৃঙ্খলা অবস্থা সব মিলিয়ে একটা বিশৃঙ্খলা। এর ভেতরেই আমাদের কাজ করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, কথার ফুলঝুড়ি ছড়িয়ে কিন্তু আমরা বাজেট করিনি। আমাদের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ ছিল যেমন- মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাত, জ্বালানি খাত, রাজস্ব আদায় এসব কিছুর মধ্যেই বাজেট করতে হয়েছে। তারপরও আমাদের প্রথমবারের মতো বাজেটের আকার বাড়েনি।
তিনি আরও বলেন, এতদিন তো আপনারা প্রবৃদ্ধি প্রবৃদ্ধির ন্যারেটিভ শুনেছেন। গ্রোথ হয়েছে অনেক বেশি কিন্তু সেটার সুবিধা কে পেয়েছে। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আমরা মানুষের জীবনমান উন্নয়ন হয়, ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য যাতে চালিয়ে যেতে পারে সেসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাজেট সাজিয়েছি।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এত চ্যালেঞ্জের মধ্যে আমাদের প্রতি একটু সমবেদনা নিয়ে কাজ করেন, একবারেই একপেশে কিছুই হয়নি, গুণগান গাইব সেটাও আমরা চাই না। আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। মোট কথা আমরা সবার সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে বাজেট দিয়েছি, যা বিশ্বের অন্য দেশের কাছে যেন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। তিনি বলেন, প্রতিকূল অবস্থা থেকে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। মাঝখানে থমকে গিয়েছিল, এখন আবার সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য। মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা, সামাজিক নিরাপত্তার দিকে নজর দিতে চেষ্টা করেছি। তিনি আরও বলেন, বাইরের প্রতিটা দেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে অত্যন্ত ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। প্রত্যেকের পজিটিভ মনোভাব রয়েছে সেটা আরও একটু সুসংহত করতে দেশের ভেতরের মানুষের যেন একটু ইতিবাচক মনোভাব দেখায়। যদি আমরা নিজেরাই বলি খারাপ, তাহলে অন্যরা তো করবেই। কাজেই দেশের ভেতরের মানুষের যদি দেশের প্রতি দরদ ও সরকারে প্রতি সহযোগিতার মনোভাব থাকে আমরা সেই প্রত্যাশাই করছি।
এবারের প্রস্তাবিত বাজেট জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমদ। যারা বাজেটকে গতানুগতিক বলছেন তাদের উত্তরে বলেছেন, হুট করেই একটা বিপ্লবী বাজেট দেওয়া সম্ভব নয়। বাজেট প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আমি মনে করি আমরা একটি জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব বাজেট দিতে পেরেছি। অনেকে বলছে, তোমরা আগের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছ। হুট করেই যে আমরা একটা বিপ্লবী বাজেট দিয়ে দেব, সেটা তো সম্ভব না। বাজেটে একেবারে যে ইনোভেশন নেই, তা কিন্তু নয়। গতকাল (সোমবার) বাজেট দিয়েছি, এটা ওপেন থাকবে। কিছু সাজেশন আসবে। পরবর্তী সময়ে ফাইনাল বাজেটটা আসবে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের সামনের পথ কঠিন। আমরা চেষ্টা করছি এনবিআরকে রিঅর্গানাইন করতে, বাইরে থেকে ঋণ আনার প্রক্রিয়াটাও মোটামুটি নেগোশিয়েট করে ফেলেছি?
উপদেষ্টা বলেন, সার্বিকভাবে আমি মনে করি চ্যালেঞ্জের মুখে একটু কোলাবোরেটিভ, সিমপেথেটিক হয়ে কাজ করবেন। সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। আমরা চাই একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যে, এত প্রতিকূলতার মধ্যেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাজেটের নির্যাস হলো সবার জীবনযাপনকে স্বচ্ছ করা, সামাজিক নিরাপত্তা। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা এমন একটা সময় বাজেট পেশ করেছি যখন দেশের অর্থনীতিকে আইসিইউতে রাখার মতো অবস্থা। আমরা একটা বাজেট দিয়েছি। বাস্তবায়নের চেষ্টা করব। সংস্কারের চেষ্টা করছি। আপনাদের সবার সহযোগিতা চাই। প্রসঙ্গত, এর আগে গত সোমবার বিকালে রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বিটিভিসহ অন্যান্য বেসরকারি গণমাধ্যমে একযোগে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম বাজেট। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের (৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা) তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম, যা দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাজেটের আকার হ্রাস পাওয়ার ঘটনা।