সালেহা হাসপাতালের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে কাজ থাকলেও অনুসন্ধানী দৃষ্টি তার চলমান মানব স্রোতের দিকে। দীর্ঘকাল ধরে এভাবে তাকিয়ে আছেন। সে যেন হাসপাতালের ইট-কাঠ বা কাঠামোর মতো অবিচ্ছিন্ন অংশে পরিণত হয়েছে। তাকে নিয়ে এখন আর কেউ মাথা ঘামায় না। সে উপস্থিত না থাকলে বরং অনেকেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সে দিকে ফিরে তাকায়। প্রথমদিকে সালেহার চোখে মুখে উদ্বেগের চিহ্ন ছিল। এখন আর তেমন নাই, বয়সের ভারে নুজ্ব্য, ক্লান্ত অবসন্ন দৃষ্টি। তাকে দেখে আজ আর কেউ বলবে না একদিন তার রূপ ছিল যৌবন ছিল। সালেহার মাথার চুল সব সাদা, চোখের নিচে কালি পড়েছে শরীরের চামড়া কুঁচকে গেছে। চা বিক্রিতে চলছে তার টানাটানির জীবন। হাজারো মানুষের গমনাগমন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে সবাই।
কারো দিকে কারো তাকানোর সময় নাই। সালেহা বুক ভরা আশা নিয়ে আজও এই হাসপাতালের সামনে বসে আছেন। কী আশায় তাঁর এই বসে থাকা তা শুধু সেই জানেন। অন্য কেউ আর তা জানতে চায় না। রুবেল এই হাসপাতালের ডাক্তার। এখানে জয়েন করার পর থেকেই দেখে আসছে এই বৃদ্ধাকে। প্রায় সময় বৃদ্ধা মহিলার চোখে চোখ পড়ে রুবেলের। মহিলার অভিব্যক্তিতে বোঝা যায় তিনি কাউকে খুঁজছেন। মহিলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন রুবেলের দিকে। রুবেল কোন কিছু না বলে চেম্বারে ঢুকে যান। আজ তার মনে কৌতূহল জাগে, ওই বৃদ্ধ মহিলা তার দিকে অমন করে তাকিয়ে থাকেন কেন। সে এসে জিজ্ঞেস করেন, কী গো মা আপনি আমাকে দেখলে তাকিয়ে থাকেন কেন? সালেহার দু’চোখ অশ্রু প্লাবিত হয়। আপনি কাঁদছেন কেন? আমি আপনাকে কোন কষ্ট দিয়েছি?
না বাবা আপনি কোন কষ্ট দেন নাই বরং শান্তি দিয়েছেন, মা ডেকে আমার পরানটা শান্ত করে দিয়েছেন। তাই দুঃখে না সুখে কাঁদছি বাবা! আমার দিকে কারও ফিরে তাকানোর সময় নেই। রুবেল বলেন, মা কর্মময় জীবনে সবাই ব্যস্ত। তাই হয়তো কেউ সময় পায়না। আপনি চা বিক্রি করেন, দেন এক কাপ চা আমাকে। সালেহা উৎসাহ নিয়ে বলেন, বাবা আপনি চা খাবেন? সে পরিপাটি করে চা ঢেলে রুবেলের দিকে এগিয়ে দেন। এই নাও বাবা চা। রুবেল চা খায়। বাহ! আপনার চাটা তো বড় স্বাদের। হ্যাঁ বাবা আমি নিজ হাতে চা বানিয়ে নিয়ে আসি।
আপনি থাকেন কোথায়? আমার আবার থাকা। একটা বাড়ির সিঁড়ির কাছে একটু জায়গা আছে আমাকে সেখানে থাকতে দিয়েছে। সেখানেই থাকি। ও আচ্ছা। আমি আপনার ছেলের মতো আমাকে তুমি করে বলবেন। আমার নাম রুবেল, আমাকে নাম ধরে ডাকবেন। ঠিক আছে বাবা। মা এখন আমি যাই আবার আসব। সালেহা বলেন, ঠিক আছে বাবা রুবেল। সে রুবেলের গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মনের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠে। দীর্ঘকাল যেন এমন কোন কণ্ঠস্বর শোনার অপেক্ষায় ছিল সে। আজ যেন সার্থক হয়েছে তার এই কষ্টের অপেক্ষার। রুবেলও অবাক হয়ে পিছনে তাকান। তার নাম ধরে তো কতজনই ডাকে কোনোদিন এমন প্রশান্তি লাগে নি। সে পেশেন্ট ওয়ার্ডে ঢুকে যায়। বারবার সালেহার চেহারা তার মুখের সামনে ভেসে ওঠে। রুবেল ঠিকমতো কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না। সে ভাবে, কেন অস্থির হয়ে উঠছে তার মনটা। বারবার ওই বৃদ্ধ মহিলার কাছে তার যেতে ইচ্ছা করছে কেন। কেন ওই মহিলার জন্য তার এতো মায়া লাগছে।
রুবেল হাসপাতালে ঢোকার আগে সালেহার কাছে যান। মা কেমন আছেন? মা ডাক শুনে চমকে তাকায় সালেহা। এইতো বাবা আছি। আপনার ব্যাপারে আমার জানতে ইচ্ছা করে। এই অভাগিনীর কী জানবা বাবা? আপনার ছেলে মেয়ে স্বামী এইসব। সালেহা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বাবা এমন কথায় জিজ্ঞেস করলা। যার জ্বালা বইয়ে বেড়াই আমি। রুবেল আশ্চর্য হন, জ্বালা বয়ে বেড়ান মানে! আমার ছিল সুখের সংসার।
আমার স্বামীর ছিল দশ গ্রামের মাতব্বর। একদিন অনেক রাতে দরজা খট খট করে। আমার স্বামী জিজ্ঞেস করলেন, কে? বাহিরে অনেক লোকের শব্দ। তারা বলল, মাতবর সাহেব আমরা আপনার কাছে এসেছি। আমার স্বামী দরজা খুললেন। তারা অনুরোধ জানায়, মাতবর সাব আপনাকে দিয়ে আমাদের একটু কাজ আছে। এখনই আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। মাতবর বলে কথা, দেরি না করে রওয়ানা দিল তাদের সঙ্গে। তখন আমার গর্ভে সন্তান। ভূমিষ্ঠ হতে দুই মাস বাকি। আমি অপেক্ষা করি স্বামী আসবে। স্বামী আর ফিরে আসে না। যারা আমার স্বামীকে ডেকে নিয়েছিল তাদের কাছে স্বামীর কথা জানতে চাই।
তারা বলে, আমার স্বামীর কথা যদি তাদের কাছে জিজ্ঞেস করি অথবা এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলি তারা আমাকে জানে মেরে ফেলবে। আমি হুমকি-ধামকির পরোয়া না করে বিভিন্ন জায়গায় স্বামীর খোঁজ করি। কোথাও তাঁর খোঁজ পাই না। আমার স্বামী নিখোঁজ হওয়ার দুই মাসের মাথায় বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হবে। আমি এই হাসপাতালে ভর্তি হই। বাচ্চা হওয়ার সময় আমার ওপর দিয়ে খুব ধকল গেল। বাচ্চা পৃথিবীতে আসলো। সেই অবস্থাতেও আমার ছেলের কান্নার শব্দ আমার কানে আসল। তারপর আমাকে একটা ইনজেকশন দিল। আমি অচেতন হয়ে গেলাম। যখন জ্ঞান ফিরে আমি বেডে দেখি বাচ্চা নাই। মনে অজানা আশঙ্কা। চিৎকার কইরা ডাক্তার, নার্স জোড়ো করলাম, জিজ্ঞেস করলাম আমার বাচ্চা কই? তারা বলল, চিৎকার করে হাসপাতাল মাথায় উঠিয়ে ফেলেছে।
তোমার বাচ্চা কই আমরা কী জানি! আমার কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হলো। কিন্তু কারো হৃদয়ে মায়া জাগলো না আমার জন্য। হারিয়ে ফেললাম আমি আমার বাচ্চাকে।
স্বামী হারালাম, বাচ্চাা হারালাম। আমি হলাম সর্বহারা। সেই থেকে আমি এখানে প্রতিদিন অপেক্ষা করি। প্রতিটি মানুষকে খুঁটে খুঁটে দেখি। আমার সন্তানের যদি দেখা পাই। জীবনটা শেষ করে দিলাম হাসপাতালের এইখানে। তোমারে দেখার পর আমার দেখা মনে হয় শেষ হইল। আপনার কথা শুনে আমার বড়ই খারাপ লাগল। আজ থেকে আপনার এখানে আর বসতে হবে না, আপনি আমার কাছে থাকবেন। যতদিন আল্লাহ আপনাকে বাঁচিয়ে রাখেন, ততদিন আপনি আমার কাছে থাকবেন। না বাবা আমি কারো প্রতি নির্ভরশীল হতে চাই না। আমি আমার ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে চাই। তুমি আসা যাওয়ার পথে আমার সঙ্গে শুধু একটু দেখা করে যেও। তাতেই আমি শান্তি পাব। আপনাকে শান্তি দেওয়ার জন্যই আমি আমার কাছে রাখতে চাই।
আজ যদি আপনার ছেলে আপনাকে বলতো তাহলে তার কথা কি ফেলতে পারতেন। রুবেল অনুনয় করেন। সালেহা তখন মনের গভীরে ডুবে আছেন। ?ছেলে যখন বলছো ছেলের কাছে না গিয়ে থাকি কেমন করে। রুবেলের বাবা-মা এক সড়ক দুর্ঘটনায় একসঙ্গে মারা যান। মৃত্যুর আগে মা তাকে জরুরি একটা কথা বলতে চেয়েছিলেন। ব্যস্ততায় সেটা আর শোনা হয়ে ওঠেনি। মৃত্যু চিরদিনের মতো, সেই কথারও মৃত্যু ঘটিয়েছিল। রুবেল ভাবে- কী ছিল সেই জরুরি কথা।