সাঈদের রক্তের শপথ
আমি দেখেছিলাম সেই দুপুরের
যেখানে রাজপথে পড়ে ছিল এক শরীর,
না, সে ছিল না কেবল একজন ছাত্র,
সে ছিল রাষ্ট্রের বুক চিরে বের হয়ে আসা বিবেক,
যার রক্তে লেখা হচ্ছিল একটি প্রশ্নপত্র
প্রশ্ন একটাই’ ন্যায় কাকে বলে?’
তার বুকে ছিল গর্ত,
সে গর্তে জন্ম নিচ্ছিলো একেকটি প্রতিবাদী ফুল,
যার পাপড়িতে লেখা ছিল ‘মেধা নয়তো মৃত্যু’,
সে শরীর পিচঢালা সড়কের সীমানা পেরিয়ে
ঢুকে পড়েছিল আমাদের ঘরের ভিতর,
আমাদের ঘুমের ভিতর,
আমাদের বিবেকের ভিতর।
তার হাতের মুঠোয় ধরা ছিল
একটি কাগজ,
তাতে লেখা ছিল
‘আমার রক্ত যেন কখনও নীরব না হয়।’
আমি এক টুকরো ব্যানার
একদিন আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম টিএসসির মোড়ে
চারদিকে মুখ, কণ্ঠ, শব্দ, লাঠি, চোখ, গ্যাস,
আর আমি
আমি হয়ে গেলাম ব্যানার।
এক কিশোরী বলছিল
‘আমার ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে,
সে শুধু বলেছিল, ‘কোটা বাতিল করো’।’
তার চোখে ছিল না কান্না,
তবে সেই শুষ্ক চোখে
আমি দেখেছিলাম মেঘ জমা আকাশ
যেটা গর্জে না,
তবু বিদ্যুৎ ছড়ায়।
আমিও মিশে গেলাম দেয়ালে
লিখে দিলাম,
‘এই দেশ মেধার,
এই রাস্তা আমাদের।’
জুলাইয়ের আগুন পথ
জুলাইয়ে পা ফেলা মানে
ইতিহাসের বুকের ওপরে আগুন পায়ে হাঁটা
জুলাইয়ে প্রতিটি বাতাসে মিশে ছিল
প্রশ্নপত্র না পাওয়া এক যুবকের দীর্ঘশ্বাস।
ঢাকার এক কোণে
একটা ছেলেকে লাঠি দিয়ে কুচকে দেওয়া হচ্ছিল,
সে ছেলেটি প্রশ্ন করেছিল,
‘আপনারা আমাদের জন্মের জন্য শাস্তি দিচ্ছেন কেন?’
আরেক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ে বলছিল
‘আমার ভাইয়ের রোল নম্বর মেধাতালিকার শীর্ষে ছিল,
কোটা তাকে পিছনে ঠেলে দিয়েছে।’
জুলাই তখন আর মাস ছিল না,
তা হয়ে উঠেছিল
একটি কফিনবাহী ট্রাক,
যার চাকায় লেখা ছিল
‘গণতন্ত্র ফিরে চাও?’
মায়ের চুপচাপ কান্না
মায়েরা কান্না করে না,
তারা নিঃশব্দে চোখের নিচে
এক টুকরো সাদা শাড়ির প্রান্তে
রক্তরঙা রুমাল বুনে রাখে।
এক মা ফোন করেছিল ছেলেকে
‘তুই কোথায়?’
ছেলে বলেছিল, ‘মা, রাজপথে,’
মা তখন চুপ করে ছিল।
সে জানতো, শব্দ বললে কান্না গড়িয়ে পড়বে।
সেই নীরবতা ঢেউয়ের মতো এসে
ঢাকছিল সাঈদের কফিন,
যেখানে লেখা ছিল
‘এই রাষ্ট্রে, ন্যায়ের দাবিতে,
আমার মায়ের দোয়া যেন কাঁদে।’
ছবিতে লুকানো বিপ্লব
সকালে এক বন্ধু পাঠিয়েছিল ছবি
একটা মৃত মুখ, রক্তমাখা কপাল,
তার ঠোঁটে ছিল
শেষ চুমুর মতো ঠান্ডা নীরবতা।
আমি ছবিটা দেখে শিউরে উঠেছিলাম,
কিন্তু চোখ ফিরাইনি।
কারণ জানতাম,
এই চেহারায় লুকানো আছে
আমার দেশের সোনার ছেলে,
যার নাম আবু সাঈদ,
যার মৃত্যুতে জন্ম নেয়
একটি নতুন আগুন,
একটি নতুন বাংলা।
ছবি তখন আর ছবি নয়,
তা হয়ে উঠেছে দলিল,
একটি ইতিহাসের চিহ্ন,
যেখানে রংপেন্সিল দিয়ে আঁকা ছিল
‘আমরা থামবো না।