ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কবি জাহিদ নয়নের কবিতা

মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় জেগে ওঠা স্বতন্ত্র স্বর

নুরুন্নাহার মুন্নি
মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় জেগে ওঠা স্বতন্ত্র স্বর

মনের খেয়ালে কষ্টের টলটলে পুকুরে নেমে যখন আমরা হৃদয়ের তন্দ্রা কাটাতে যাই, আমরা ভুলে যাই আমাদের হৃদপিণ্ডের পেছনে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে বসে থাকা অন্ধকারকে। এই অন্ধকার অতর্কিত অবস্থায় আক্রমন করে। ভরসাহীন জীবনের মতো, সে হোক মাছেদের অথবা মানুষের। জীবনের অনন্ত ছুটে চলায় পানির নিচে চলতে চলতে কখন যে শিকার বনে যায়! মানুষ তখন হয়ে ওঠে আততায়ী। মানুষের বেলায়ও পৃথিবীর পাপোৎসবে লুকিয়ে থাকে তাকে হনন করার হাজারো প্রচেষ্টা। কবি জাহিদ নয়নের ‘আততায়ী অন্ধকার’ বইটি হাতে পেয়ে মনের স¦তন্ত্র সত্ত্বায় ভেসে উঠলো নানান ভাবনার ছায়া।

ইজমের অমø মধুর স্বাদে ভিন্নতা যেমন আছে তেমন নতুনত্বের ঘ্রাণে নিঃশ্বাস নেওয়ার তৃপ্তিও পাওয়া যায়। বইটি হাতে নিয়ে প্রথমেই ডুব দিলাম সূচিপত্রে সাঁটানো প্রথম কবিতার ভেতর। বিষণ্ণ সুন্দর পথে। শিরোনামটা মনে দোলা দিল খানিকটা। এক দমে পড়ার চেষ্টা করেও লাভ হলো না। কবিতার প্রথম লাইনেই ইমোশনের উপর ব্যাপক চাপ। তারপর প্রতিটি লাইনে লুকিয়ে থাকা বাক্যের অর্থবোধক শব্দগুলো মস্তিষ্ককে নাচিয়ে ছাড়লো। কবি লিখেছেন, ‘ঝড় থেমে গেলে থেকে যায় তাণ্ডবের চিহ্ন/ মৃত পাখিদের শেষকৃত্য শেষে ফিরে যায় পিঁপড়ের দলও! যারা মৃত এবং বিধ্বস্ত /তাদের কোনো পদচিহ্ন থাকে না/ যেমন ছিল না নুহের প্লাবনে অভিশপ্তদের।’

চরম বাস্তবতার শিখণ্ডি দাঁড় করিয়ে কবি পাঠকের বোধের সাম্রাজ্যে পাঠককেই ছেড়ে দিয়েছেন। খণ্ডিত জীবনের যোজন বিয়োজনে মানুষ বেড়ে ওঠে বয়সে, মেধায়, প্রজ্ঞায়। আবার স্তব্দ কপাট বদ্ধ উঠোনের মতো নিস্প্রভ পড়ে থাকে কিছু বিকৃত মস্তিষ্ক। কখনও কখনও তা পাপের গন্ধ ছড়ায়। সুরভিত শ্যামলকে করে তোলে পরিত্যক্ত। সমাজের এই সব কলুষিত সত্ত্বা যুগ যুগ ধরে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে প্রকাশ্যে কিংবা অন্তরালে। তাইতো কবি লিখেছেন, ‘যে পথে পা বাড়াই সেখানেই পাপ/নগরীর পথে পথে পাপের উৎসব প্রশস্ত সরণি/ সিগন্যালে/অলিগলি/রাজপথে। এখানে আমি কিংবা অন্য কেউ/মাড়িয়ে গেছে পথ/অথবা আমাদের পূর্বসূরি/রেখে গেছে দাম্ভিক পদচিহ্ন।’ (ডুবে আছি পাপে)। কবি জাহিদ নয়ন মূলত একজন কবি। মেঘনা পাড়ের শহরে কেটেছে তার শৈশব, কৈশোর আর বাড়ন্ত বেলা। বর্ষার জলে কাদা ডোবানো নৌকার খেলা, শিশুকালের বেখেয়ালি ইচ্ছে, কিংবা যৌবনের সম্মোহনের দেউরিতে দাঁড়িয়ে বার বার খুঁজে পেতে চেয়েছেন, ছুটে যেতে চেয়েছেন নস্টালজিক অভিযানে। কবির কবিতায় তা খুঁজে পাই অবলীলায়। তিনি লিখেছেন ‘অবচেতনেই হারিয়ে খুঁজি সেই স্বর্ণ-সময়/খুঁজি ঘাসফড়িং, টলমলে পুকুর/আগুন রোদে পোড়া হিরন্ময় দুপুর!/খুঁজি বুনো সবুজের হৃৎপিণ্ড মাতাল। খুঁজি অপার্থিব ভরসার আঙুল।’ (পাথুরে আয়নায় প্রতিবিম্ব)।

‘আততায়ী অন্ধকার’ কাব্যগ্রন্থে কখনও কখনও কবিকে বেশ কৌশলী হতে দেখা গেছে। অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে তার বুকভর্তি ভালোবাসার কথা পাঠকের অপেক্ষমান মেঘ চোখে ভাসিয়ে দিয়েছেন। ছুঁড়ে দিয়েছেন কিছু শব্দের বৃষ্টি। নিশ্চুপ নীলাভ মেঘের খণ্ডাংশ ভেঙে যেমন অবারিত বৃষ্টির প্রকম্পিত আর্তনাদ নেমে আসে তেমনি সব বিস্ময়ের, পাপোম্মাদ পৃথিবীকে দেখা কবির মনে বেজে ওঠে অভিমানের সুর। নিরুত্তাপ প্রেমের উত্তাপে প্রেমিকার ছলছল চোখ দেখতে না পারাটা ও এক ব্যর্থতা। কবির ভাবাবেগ থেকে তাই নিঃসৃত হয় ‘প্রতারক হতে না পারাটাও এক অযোগ্যতা বটে।’ (অযোগ্যতা )। ‘আততায়ী অন্ধকার’ কাব্যগ্রন্থটিতে কবি বেশ কয়েক জায়গায় মিথ ব্যবহার করেছেন। শুধু পথ হাঁটেন, খুঁজে বেড়ান খাবলে খাওয়া শকুনের খামার কিন্তু আমাদের ভুলে ভরা জীবন। ‘কাঁটা তার গলে বৃষ্টি/কাঁটা তারে আটকা পড়ে পাখি/প্রায়শই প্রতিদিন/মাঝে মাঝে পাখিগুলোকে মানুষ ভেবে ভুল করি।’ (কাঁটা তার গলে বৃষ্টি)। কবি এভাবেই দেখেছেন আর এভাবেই লিখেছেন। কবি জাহিদ নয়নের জন্ম চাঁদপুর জেলায়। ইংরেজি সাহিত্যে করেছেন স্নাতোকোত্তর। বর্তমানে তিনি সরকারি চাকুরিতে নিয়োজিত আছেন।এক দশক ধরে লিখছেন বিভিন্ন জাতীয়, স্থানীয় পত্রিকা, লিটলম্যাগসহ বিভিন্ন সংকলন গ্রন্থে। ‘আততায়ী অন্ধকার’ তার প্রথম কাবগ্রন্থ। প্রথম কাবগ্রন্থ হলেও আততায়ী অন্ধকারের গহীনে প্রবেশ করলে পাঠক বুঝতে পারবে এর গভীরবোধ, এবং প্রগাঢ়তাকে। ৩৯ টি কবিতায় কবির অসাধারণ বোধ এবং গভীর চিন্তার আখ্যান আততায়ী অন্ধকার কাব্যগ্রন্থটি। আশা করি বইটি পাঠে পাঠক তৃপ্ত হবে। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন আইয়ুব আল আমিন। প্রকাশ করেছে দ্বিমত পাবলিসার্স। মূল্য : ২০০ টাকা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত