প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৪ অক্টোবর, ২০২৫
(ছোটগল্প)
পরিবারটার ওপর যে একটার পর একটা এরকম বিপর্যয় নেমে আসবে- এটা কেউই আগে ভাবতে পারেনি। প্রথমে মারা গেলেন এ-পরিবারের পিতা আবদুস সামাদ, যিনি পিডব্লিউডি অফিসের একজন হেড ক্লার্ক হলেও ধন-সম্পত্তি বেশ ভালোই করেছিলেন। পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে, যেখানকার ওরা আদি বাসিন্দা, সেখানে চারতলা একটা বাড়ি তৈরি করেছিলেন সামাদ সাহেব। নিজেরা একটা ফ্ল্যাটে থাকতেন আর বাকি সাতটা ফ্ল্যাট থেকে প্রতি মাসে ভাড়া পেতেন। এছাড়া উত্তরায় দশ কাঠার একটা জমি কিনেছিলেন, যার বর্তমান বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিজেদের গ্রামের বাড়িতে উত্তরাধিকারসূত্রে যে দেড় বিঘা জমি পেয়েছিলেন সেটা বাড়িয়ে মৃত্যুর আগে তিনি বারো বিঘা জমি করেছেন। সেদিক থেকে সামাদ সাহেবকে বেশ সফল মানুষই বলতে হবে। তবে সন্তান পালনের ক্ষেত্রে তিনি কতটা সফল হয়েছিলেন তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে।
কারণ বড় ছেলে শাহেদউদ্দীন আহমেদ লেখাপড়া তেমন শেখেনি। খেলাপাগল শাহেদ পাড়ার ফুটবল-ক্রিকেট টিম নিয়ে এত ব্যস্ত থাকত যে পড়াশোনাটা আর করে উঠতে পারেনি। তবে অনেকে বলে থাকে, মাঠের খেলার চেয়ে ক্লাবঘরে তিন তাসের খেলাতেই নাকি শাহেদের আসক্তি বেশি ছিল এবং ওর লেখাপড়া না হওয়ার পেছনে সেটাই নাকি ছিল মূল কারণ। অবশ্য বাবার ওরকম চারতলা বাড়ি থাকলে, যেখান থেকে মাসে মাসে মোটা অঙ্কের ভাড়া পাওয়া যায়, ঢাকা শহরে মূল্যবান জমি থাকলে যা বিক্রি করলেই মিলবে কয়েক কোটি টাকা, এমন পরিবারের ছেলেদের লেখাপড়া শেখার কি খুব একটা আগ্রহ থাকে? শাহেদেরও তাই সেটা ছিল না। তবে শাহেদের লেখাপড়া হয়নি বলে সামাদ সাহেবের যতটা দুঃখ ছিল তার চেয়ে বেশি দুঃখ ছিল যে শাহেদ বিয়েশাদি কিছু করল না বলে। শাহেদ আজীবন ব্যাচেলরই থেকে গেল। আর এখন তো ওর বয়স পঞ্চাশের উপরে।
তবে ছোট ছেলে জাহেদকে নিয়ে অতটা দুশ্চিন্তা ছিল না। কারণ ছোটবেলা থেকেই জাহেদ টাকা-পয়সার ব্যাপারটা ভালো বুঝত। বর্তমানে ও কন্ট্রাক্টরি করছে। প্রথমদিকে দু-একবার ক্ষতির মুখোমুখি হলেও এখন কোন ইঞ্জিনিয়ারের ঘুষের রেট কত বা কোন অফিসের কোন বড় কর্তাকে কীভাবে খুশি করতে হয়, বা সে অফিসারের কোনো বিশেষ চাহিদা আছে কি না আর সেটা কীভাবে মেটাতে হবে, এগুলো জাহেদ এখন খুব ভালোভাবেই শিখে গেছে। ফলে কন্ট্রাক্টরি থেকে জাহেদের আয় বর্তমানে বেশ ভালোই। জাহেদ যথাসময়ে বিয়ে করেছে এবং বউ-বাচ্চা নিয়ে রীতিমতো একজন সংসারী মানুষ ও। তবে জাহেদের একটাই সমস্যা যে, ছেলেবেলা থেকেই ও খেতে খুব ভালোবাসে। ফলে জাহেদের দেহটা বেশ স্থূলকায়। ওর হোন্ডা ফিফটি মোটরসাইকেলটাতে চেপে জাহেদ যখন রাস্তায় বের হয়, মনে হয় যেন ছোট একটা যন্ত্রের উপরে বড় একটা তুলোর বস্তা চলেছে। ইদানীং অবশ্য জাহেদের রক্তচাপ বেশ বেশি থাকছে এবং ওর হার্টেও কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। ডাক্তাররা বলেছে যে, খুব বেশি দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তবে নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে এবং খাওয়া-দাওয়াটা ওকে অবশ্যই কমাতে হবে। প্রথমটা মানে ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারে নিয়ম মেনে চললেও খাওয়ার ব্যাপারে জাহেদ খুব একটা নিয়ম মানত না। কারণটা ওই যে বললাম, ও খেতে খুব ভালোবাসত।
অধিকাংশ আর্থিকভাবে সফল পুরুষ মানুষের মতো সামাদ সাহেবের জীবনেও নারীঘটিত একটা পর্ব ছিল। সাভারের গ্রামাঞ্চলে একটা ভালো জমির খোঁজে সামাদ সাহেবকে একসময় সাভারে বেশ যাতায়াত করতে হতো। কেউ বলে সেখানে তার নিজের আগ্রহে, কেউ বা বলে জমির যে দালালটার মাধ্যমে তিনি সাভারে যাতায়াত করতেন সেই লোকটার আগ্রহে, তার এক বিধবা বোনের সঙ্গে সামাদ সাহেব জড়িয়ে পড়েন এবং পরে ওই নারীকে বিয়ে করতে বাধ্য হন। মহিলাটার দুটো সন্তান ছিল। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। দ্বিতীয় ওই স্ত্রীকে সামাদ সাহেব কোনো দিনই ওর ঢাকার বাড়িতে আনেননি। তবে ওই নারী ও তার সন্তানদের জন্য সামাদ সাহেব নিয়মিত টাকা-পয়সা পাঠাতেন। আর টাকা পাঠাতে সামাদ সাহেব খুব একটা আপত্তি করতেন না, কারণ তার বৈধ স্ত্রী হিসেবে তার দ্বিতীয় স্ত্রী ফাতেমা বেগম তার সম্পত্তির দাবিদার হলেও সে তো ঢাকায় এসে কিছু দাবি করছে না। ফলে তাদের মাসে কয়েক হাজার টাকা পাঠিয়ে যদি ঝামেলামুক্ত থাকা যায় সেটাকে সামাদ সাহেব কোনো বড় ক্ষতি বলে মনে করতেন না।
সামাদ সাহেবের মৃত্যুর পরেও পরিবারটা মোটামুটি ভালোই চলছিল। শাহেদণ্ডজাহেদ দুই ভাইয়ের মাঝে সম্পর্কেও তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। তবে সবকিছু পাল্টে গেল, যখন হঠাৎ শাহেদ একদিন ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ল। এক বন্ধুর সঙ্গে খেলা দেখতে মিরপুরে যাওয়ার পথে এ-দুর্ঘটনা ঘটে। একটা চলন্ত মিনিবাসের ধাক্কায় ওদের অটোরিকশাটা উল্টে যায় এবং শাহেদ রাস্তার পাশে ফুটপাথে আছড়ে পড়ে। পরে দেখা যায় ওর শরীরের মাংসপেশি অনেক জায়গায় থেঁতলে গেছে এবং ওর ডান পা-টা খুবই খারাপভাবে ভেঙে গেছে। রীতিমতো কমপ্রাউন্ড ফ্র্যাকচার। মানে বেশ কয়েক জায়গাতেই হাড় ভেঙেছে।
দুর্ঘটনার পরপরই শাহেদ জ্ঞান হারায় এবং খারাপ খবরটা হচ্ছে আজ প্রায় ১৬ দিন হলো তার জ্ঞান ফেরেনি। অজ্ঞান অবস্থায় সে পঙ্গু হাসপাতালে পড়ে রয়েছে। তার ভাঙা পায়ের চিকিৎসা অবশ্য চলছে। তার পা হয়তো ভালো হয়ে যাবে, তবে আজীবন তাকে ক্র্যাচ নিয়ে চলাফেরা করতে হবে বলে ডাক্তাররা জানিয়েছেন। তবে কবে তার জ্ঞান ফিরবে, বা আদৌ ফিরবে কি না- সে ব্যাপারে ডাক্তাররা এখনও পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারছেন না। তবে ডাক্তাররা আশা ছাড়েননি এবং হাসপাতালে অচেতন শাহেদের নিয়মিত স্যালাইন চলছে।
যেহেতু সামাদ সাহেব মারা গেছেন আর শাহেদ আদৌ জীবিত হয়ে ফিরবে কি না সন্দেহ রয়েছে, ফলে জাহেদের এক উকিলবন্ধু জাহেদকে পরামর্শ দিলো এ-সময় প্রপার্টিগুলো জাহেদ যেন নিজের নামে লিখিয়ে নেয়। শাহেদের ফেরা যেহেতু অনিশ্চিত, ফলে উকিলবন্ধুর পরামর্শটা জাহেদের কাছে অন্যায্য কিছু বলে মনে হয়নি। কারণ বলা তো যায় না সাভারের তার সৎমা আর সৎভাইবোনেরা যদি হঠাৎ একদিন এসে সম্পত্তির ভাগ দাবি করে বসে। তাই সেরকম কিছু ঘটার আগেই জাহেদের নামে সব সম্পত্তি নামজারি করে ফেলাটা জরুরি। তবে সমস্যা হচ্ছে, নামজারির আগে সম্পত্তিগুলো মিউটেশন করতে হবে এবং তার জন্য শাহেদের এনআইডি কার্ড আর লাগবে। শাহেদের এনআইডিটা জাহেদ উদ্ধার করেছে। এখন বাকি রয়ে গেছে শুধু ডেথ সার্টিফিকেটটা। যে-মানুষ এখনও মারা যায়নি তার ডেথ সার্টিফিকেট কীভাবে পাওয়া যাবে? কেউ বা তা দেবে? এসব নিয়ে কয়েকদিন ধরে জাহেদ বেশ ব্যস্তভাবেই ছোটাছুটি করে চলেছে।
তো সেদিন সকালে এ-কাজে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র অফিসে গিয়েছিল জাহেদ। তাকে যেতে হবে সাততলায়। মেয়র অফিসের যে কেরানিটার সঙ্গে এ-কাজটার ব্যাপারে টাকা-পয়সার লেনদেনের একটা ব্যবস্থা জাহেদ প্রায় করে ফেলেছে, সে সাততলায় বসে। সেদিন আবার মেয়র অফিসের লিফটটা বন্ধ, কারণ সকাল থেকেই বিদ্যুৎ নেই। ফলে জাহেদকে সিঁড়ি ভেঙে সাততলায় উঠতে হলো। কিন্তু এসে দেখে কেরানিটা টেবিলে নেই। লোকটা নাকি নিচে ক্যান্টিনে চা খেতে গেছে। ধুরন্ধর কেরানিটা অবশ্য জাহেদকে কয়েকদিন ধরেই বেশ ঘোরাচ্ছে। লোকটা আরও বেশি টাকা চায়। কারণ জীবিত কোনো মানুষের ডেথ সার্টিফিকেট বের করা তো তত সহজ কাজ নয়! আর এ-কথাটা কেরানিটা জাহেদকে বেশ কয়েকবারই বলেছে। বলেছে সব টাকাটা ওর নিজের জন্য নয়। অফিসের আরো কাউকে কাউকে এবং উপরেও এ-টাকার একটা বড় ভাগ তাকে দিতে হবে। ডেথ সার্টিফিকেটটা পেতে আরো কিছু বাড়তি টাকা খরচ করতে জাহেদের খুব একটা আপত্তি নেই। কারণ সামাদ সাহেবের রেখে যাওয়া সম্পত্তির পরিমাণ ও মূল্য তো কম নয়। তার শুধু জানতে হবে যে, কবে তাকে এ-অফিসে টাকাটা দিতে হবে আর টাকার অঙ্কটা ঠিক কত। এবং যেহেতু সেদিন জাহেদের সময়ের কিছুটা টানাটানি ছিল, তাই সাততলা থেকে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে জাহেদ কেরানিটার খোঁজ করার জন্য ক্যান্টিনে গেল। কিন্তু লোকটাকে ক্যান্টিনে পাওয়া গেল না। ফলে জাহেদকে আবার সিঁড়ি ভেঙে সাততলায় উঠে এসে অপেক্ষা করতে হলো। ওদিকে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করার সময় সেদিন তার আবার ছিল না।
কারণ সেদিন দুপুর ২টার মধ্যে তাকে পিডব্লিউডি অফিসে যেতেই হবে। একটা বড় টেন্ডার ড্রপের ব্যাপার রয়েছে। এদিকে কেরানিটার কোনো দেখাই নেই! বসে থেকে থেকে শাহেদ খুবই অধৈর্য হয়ে পড়ছিল।
সেদিন আবার সকাল থেকেই জাহেদের শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছিল না। তার মনে হচ্ছিল, আজ সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে গতরাতের বেঁচে যাওয়া কাচ্চি বিরিয়ানিটা না খেলেই বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু ওই যে তার সমস্যা, কোনো ভালো খাবার সামনে দেখলে সে সেটা না খেয়ে থাকতে পারে না। এদিকে কেরানিটা সেদিন সারা সকাল আর টেবিলেই এলো না। ফলে কিছুটা ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েই জাহেদ আবার সিঁড়ি ভেঙে নগরভবনের সাততলা থেকে নিচে নেমে এলো এবং বেশ কিছুটা পথ হেঁটে তার মোটরসাইকেলটার কাছে গেল। আর তখনই সে প্রথমে ওর বাঁ-হাতে আর একটু পরে বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করতে শুরু করল। কে যেন ভেতর থেকে তার হৃৎপিণ্ডটা খামচে ধরছে। শ্বাস নিতে দিচ্ছে না। জাহেদের চোখের সামনে হঠাৎ করে সবকিছু প্রথমে ঝাপসা ও পরে পুরো অন্ধকার হয়ে গেল। ওর মোটাসোটা দেহটা ধপাস করে মাটিতে ওর মোটরসাইকেলটার পাশেই লুটিয়ে পড়ল। আশপাশের লোকজন দৌড়ে এলো। কেউ কেউ অ্যাম্বুলেন্স ডাকার কথা বলছিল। অ্যাম্বুলেন্স এলোও। তবে অনেক যানজট পেরিয়ে আসতে হলো বলে অ্যাম্বুলেন্সটা পৌঁছল বেশ দেরিতে। জাহেদকে যখন অ্যাম্বুলেন্সে তুলে হাসপাতালে নেওয়া হলো কর্তব্যরত ডাক্তাররা জানালেন, রোগী ঘণ্টাখানেক আগেই মারা গেছে। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক।
প্রায় আটাশ দিন অজ্ঞান থাকার পর এক সকালে হাসপাতালের বেডে জ্ঞান ফিরে এলো শাহেদের। এরও প্রায় দুই সপ্তাহ পর শাহেদকে দেখা গেল নগরভবনের সামনে ক্র্যাচ নিয়ে রিকশা থেকে নামছে। এরপর ক্র্যাচে ভর করেই হেঁটে হেঁটে নগরভবনের লিফটটার দিকে এগিয়ে গেল সে। তার বগলে একটা ফাইল। শাহেদ সাততলায় যাবে। জাহেদের এনআইডিটাও নিয়ে এসেছে। এখন সে এখানে এসেছে জাহেদের ডেথ সার্টিফিকেটটা সংগ্রহ করতে। তার উকিল জানিয়েছে, সম্পত্তিটা শাহেদের নামে নামজারি করতে হলে একমাত্র মৃত ভাই জাহেদের ডেথ সার্টিফিকেটটা তার লাগবে। ক্র্যাচটা নিয়ে শাহেদ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে সাততলার সেই কেরানিটার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।