ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বই আলোচনা

দেশ ও মাকে হৃদয়ের গভীরে লালন করার আখ্যান ‘মধুবাজ’

নুসরাত সুলতানা
দেশ ও মাকে হৃদয়ের গভীরে লালন করার আখ্যান ‘মধুবাজ’

রেদওয়ান খান পশ্চিম বাংলা এবং বাংলাদেশ দুই বাংলায়ই বেশ পরিচিত মুখ। দীর্ঘদিন কথাসাহিত্য চর্চা করছেন। ‘মধুবাজ’ রেদওয়ান খানের প্রথম উপন্যাস।

উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায় রঞ্জন আহমেদ নামের লন্ডন প্রবাসী এক যুবক পাতাল ট্রেনে চড়ে নিজের ঘরে ফিরছে। ট্রেন থেকে নেমে নিজের আবাসিক এলাকা ক্লিপক্লোজে হেঁটে পোঁছানোর সময়ে সে খুব মিস করে বাংলাদেশের রিক্সা। একই সাথে ক্লান্ত দেহে হাঁটতে, হাঁটতে মনে পড়ে দেশে রেখে যাওয়া স্ত্রী, ছোট কন্যা এবং আরও অনেক কিছুই। প্রবাসে রঞ্জন গিয়েছে আরও বহু যুবকের মতো নিজের ভাগ্য উন্নয়নে। তাই খুব স্ট্রাগল করতে হয় তাকে। রঞ্জন ভুগতে থাকে ভীষণ বিষন্নতায় আর স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে নিজের গ্রাম, মা, স্ত্রী, সন্তান সবার জন্য। তথাপি রঞ্জনের বিষন্নতা কিংবা তীব্র একাকীত্ব সাথে নিয়ে দুর্মদ যুদ্ধের কথা বোঝার যেনকেউ নেই। মা’কে রঞ্জন বলতে পারে না- কারণ প্রবাসে আসার কিছুদিন আগেই রঞ্জনের ছোট ভাই রিফাত ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। শেষ বার রঞ্জন যখন রিফাতের কবর জিয়ারত করতে যায়- তখন ছোট ভাইয়ের কবরের পাশের পাতাবাহার গাছের পাতাগুলো যেন কেঁপে কেঁপে বলেছিল- যেও না। এ আবেগ যেমন তীব্র, তেমনই গভীর। কিন্তু প্রবাসে রঞ্জন কা’কে বোঝাবে এর ঘনত্ব!

ট্রেনে যেতে যেতে যখন কোনো এক তরুণী জিজ্ঞেস করে তার মা’কে কীভাবে কলার থোড় রান্না করতে হয়। তখন রঞ্জনের মনে পড়ে যায় পুকুর ঘাটে গৃহকন্নার কাজে রত তার চিরদুঃখী মায়ের মুখ। মায়ের বয়সী লাল মুরগীর চিউক, চিউক ডাক। গ্রামের পুকুরগুলোর কথা। তাদের কড়াই গাছে বাসা বাঁধা বাজ পাখির কথা। এভাবেই প্রবাসে তীব্র সংগ্রামী জীবন নদীতে বাংলাদেশ রঞ্জনের বুকের ভেতর জেগে থাকে এক টুকরো চর হয়ে। সেখানে ঘুরে বেড়ায় নিজের সাথে একান্তে।

উপন্যাসের কাহিনি এগুতে থাকলে দেখা যায়, রঞ্জন যেমন ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য লন্ডন গিয়েছে তেমনি সে যেন দাম্পত্য থেকেও পালাতে চেয়েছিল। রঞ্জনের স্ত্রী মঞ্জুলিকার সাথে প্রেম করেই বিয়ে হয়েছিল। তথাপি দুজনের বোঝাপড়াটা যেন রূপকথার মতোই অলীক হয়ে উঠেছিল। মঞ্জুলিকা অবস্থাসম্পন্ন ঘরের মেয়ে। আবার সেই সংসারে মঞ্জুলিকার মা’ই সর্বেসর্বা। মঞ্জুলিকা এবং তার বোনেরা কখনো মায়ের কাছে কোনো প্রাধান্য পায়নি। উপেক্ষা এবং অযত্নে মঞ্জুলিকা শুধু কাঠিন্যই শিখেছে। অন্যদিকে রঞ্জন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠলেও আছে সংবেদনশীলতা। রঞ্জনভাবে- মঞ্জুলিকা তার পরিবারের সবাইকে বুঝবে এবং কাছে টেনে নেবে। বিপত্তি বাঁধে যখন রঞ্জন তার ক্যান্সার আক্রান্ত ভাইকে নিজের বাসায় নিয়ে আসে। মঞ্জুলিকার বিরক্তি যখন চোখেমুখে ফুটে ওঠে তখন রঞ্জন কেবলই কষ্ট পায় আর ভীত হরিণের মতো দাম্পত্য নামের বাঘ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। মঞ্জুলিকা সারাজীবনের অপ্রাপ্তির কারণেই যেন রঞ্জনকে মুঠোয় পুরে পেতে চেয়েছিল। আর তাতে সম্পর্কই যেন হয়ে উঠেছে এক গ্লাস হেমলক। দীর্ঘ প্রবাস জীবনে রঞ্জন যেমন ভাঙনের মতো একা। তেমনি মঞ্জুলিকার একাকীত্ব ও গভীর রাতের মতো স্নিগ্ধ এবং অভেদ্য। এই উপন্যাসে পুরুষের আবেগ চমৎকার মূর্ত হয়ে উঠেছে। যা চিন্তাশীল পাঠকের ভাবনাকে উস্কে দেয়।

উপন্যাসে উঠে এসেছে অনেকগুলো টুকরো টুকরো জীবনের চিত্রকল্প। যেমন মনোয়ার কখনও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছেড়ে যেতে চায় না। স্ত্রী নিয়ে গেছে প্রবাসে তাও সবচেয়ে ব্যয়বহুল ব্রোথেলের মেম্বার হয়ে গর্বের সাথে রঞ্জনকে সেই খবর দিয়েছে। এই মনোয়ারই স্ত্রী সাজিয়া ইংরেজি না জানার ভয়ে কাজে যেতে না চাইলে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দেয়। আবার স্ত্রীর সঙ্গে বাক-বাকুম প্রেমও করে। কালাম তার ভিসা, পাসপোর্ট, বৈধ কোনো কাগজই নেই। কিন্তু সে লন্ডন ছেড়ে যাবে না। কালাম বৃটিশ হোম মিনিস্টারকে সিলেটি ভাষায় চিঠি লিখে রঞ্জনকে দিয়েছে ইংরেজিতে অনুবাদ করে পৌঁছে দিতে। পাঠক এখানে লেখকের রসবোধের পরিচয় পান গভীরভাবেই।

আছে লন্ডনের নিঃসন্তান, নিসঃঙ্গ বৃদ্ধার বিড়াল লুলুকে খুঁজে না পেয়ে তার কষ্ট, শংকার বয়ান।

মধুবাজ সামাজিক উপন্যাস। তদুপরি লেখকের ভাষার চমৎকারিত্ব, শক্তিশালী চিত্রকল্প, মধ্যবিত্ত জীবনের সংকটের নিখুঁত বয়ান উপন্যাসকে সুখপাঠ্য করে তুলেছে। রেদওয়ান খান ভবিষ্যতে আরও ভালো উপন্যাস উপহার দেবেন পাঠক হিসেবে এটা নিবিড় প্রত্যাশা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত