ফিলিস্তিনি জনগণ প্রতিনিয়ত তাদের অস্তিত্ব, আত্মপরিচয় ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে চলেছে। ফিলিস্তিনে ইহুদি আগ্রাসনের ইতিহাস শুধু একটি ভূখণ্ড দখলের নয়; বরং উপনিবেশবাদ, জাতিগত নির্মূল, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং হাজার বছরের ইতিহাস মুছে ফেলার নির্মম অধ্যায়। এ সংকটের সমাধান শুধু ভূখণ্ড নয়; ন্যায়বিচার, অধিকার ও আন্তর্জাতিক মহলের সদিচ্ছার মাধ্যমেই সম্ভব। বিশেষত, আরব দেশগুলোর আশ্চর্য নীরবতাও অন্যতম কারণ। ফিলিস্তিনের ভূমি হাজার বছর ধরে নানা জাতি ও ধর্মাবলম্বীর আবাসস্থল। তবে আধুনিক যুগে এ ভূমির সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায় শুরু হয় ১৯ শতকের শেষভাগে। তখন ইউরোপে ইহুদি জাতীয়তাবাদ বা ‘সিয়োনিজম’ আন্দোলন শক্তিশালী হয়। এ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল, ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। যা তারা প্রাচীন ‘ইসরায়েল’ নাম দিয়ে দাবিকৃত ফিলিস্তিন ভূমিতে গড়ে তুলতে চেয়েছিল।
ফিলিস্তিনের প্রাচীন ইতিহাস : ফিলিস্তিন ভূখণ্ড ঐতিহাসিকভাবে নানা জাতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু। প্রাচীনকালে এখানে বাস করত কেনানীয়, ফিনিশীয় ও পরে ফিলিস্তিনীয় জাতি। ইহুদিরা একসময় এ অঞ্চলে বাস করলেও তারা দীর্ঘ সময় ধরে বিতাড়িত হয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৭০ অব্দে রোমানদের হাতে দ্বিতীয় ইহুদি মন্দির ধ্বংস হলে ইহুদিরা ফিলিস্তিন ছাড়ে। এরপর হাজার বছরের ইতিহাসে এ অঞ্চলে মুসলমান, খ্রিষ্টান, ইহুদি- সব ধর্মাবলম্বীই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বসবাস করত। ভূমধ্যসাগরের পূর্বে ১০ হাজার ৪২৯ বর্গমাইলব্যাপী ফিলিস্তিন দেশটি ছিল ওসমানি খেলাফতের অধীনে। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তারা ছিল ব্রিটিশবিরোধী জোটে। তখন ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধে বিজয়ী হতে ফিলিস্তিনদের সহযোগিতা চায়। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর যুদ্ধে জয়ী হলে এ ভূমিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে বলে আশ্বাস দেন; যা ইতিহাসে ‘বেলফোর ঘোষণা’ হিসেবে পরিচিত। যেহেতু আরবরা ছিল ইহুদিদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি, ফলে ঘোষণাটি তাদের অনুকূল বলেই তারা ধরে নেয়। কিন্তু এতে যে বড় একটা ধোঁকা লুকিয়েছিল, সেটা বুঝতে পারেনি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন তার প্রয়োজনে দুর্লভ বোমা তৈরির উপকরণ ‘কৃত্রিম ফসফরাস’ তৈরি করেন ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান। তার এ আবিষ্কারে আনন্দিত হয়ে তৎকালের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেন, কী ধরনের পুরস্কার চাও? উত্তর ছিল- অর্থ নয়, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে আমার স্বজাতির জন্য একটুকরো ভূমি দিলে ভালো হয়। ব্রিটিশ সরকার তখন ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি ইহুদিদের হাতে তুলে দিতে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পর ব্রিটেন স্বাধীনতা দেওয়ার অঙ্গীকার করে। ১৯১৮ সাল থেকে দীর্ঘ ৩০ বছর দেশটিকে নিজেদের অধীন রাখে। মূলত এ সময়টিই ইহুদি বলয় দ্বারা ফিলিস্তিনকে আরবশূন্য করতে প্রভাবিত করে ইঙ্গ-মার্কিনশক্তি।
আগ্রাসনের আস্কারা ও গোড়াপত্তন : ১৯ শতকের শেষভাগে ইউরোপে ইহুদি জাতি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সিয়োনিজম শুরু করে। এর প্রবক্তা ছিল থিওডর হারৎসল। যিনি ১৮৯৭ সালে প্রথম সিয়োনিস্ট কংগ্রেস আয়োজন করেন এবং একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখান। তার দৃষ্টিতে ফিলিস্তিন ছিল এ রাষ্ট্রের আদর্শ অবস্থান। ফলে শুরু হয় ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসনের পরিকল্পিত ধারা। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস ব্যালফোর একটি ঘোষণা দেন, যেখানে বলা হয়- ব্রিটেন ফিলিস্তিনে একটি ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়তা করবে। তখন ফিলিস্তিন ছিল ওসমানি খেলাফতের অধীনে। তবে ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে এটি ব্রিটিশ দখলে চলে আসে এবং ‘ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ফর প্যালেস্টাইন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় ইহুদি অভিবাসন ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। ১৯১৭ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদি জনসংখ্যা ছিল আনুমানিক ৫৫ হাজার। ১৯৪৭ সালের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ লাখেরও বেশি। এ অভিবাসনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় জমি অধিগ্রহণ, আরবদের উৎখাত, সহিংসতা এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ একটি প্রস্তাব দেয়। যেখানে ফিলিস্তিনকে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করার পরিকল্পনা করা হয়। ৫৬ শতাংশ জমি ইহুদিদের, আর ৪৪ শতাংশ জমি ফিলিস্তিনিদের। তবে এ প্রস্তাবে ফিলিস্তিনিরা তীব্র আপত্তি জানায়। কারণ, তারা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং অধিকাংশ জমির মালিক। ১৯৪৮ সালের ১২ মে রাত ১২টা ১ মিনিটে ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা করে ইহুদি জায়নবাদীরা। মাত্র ১০ মিনিটের ভেতর ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এরপর স্বীকৃতি দেয় ব্রিটেন এবং তৎকালীন সময়ের আরেক পরাক্রমশালী দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন ত্যাগ করলে ইহুদিরা একতরফা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। পরদিন আরব দেশগুলোও যুদ্ধ ঘোষণা করে। বস্তুত আমেরিকা ও ব্রিটেনের সহযোগিতা ও আশ্রয়ে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন করতে থাকে। এমনকি নিজেদের সেনাবাহিনীও গঠন করে। এরপর শুরু হয় মুসলিম ফিলিস্তিনিদের ওপর হত্যা-নির্যাতন। পাশাপাশি দখলদার ইহুদিরা ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে নিজেদের শক্তির জানান দেয়। এভাবেই ইসরায়েল রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়।
অবৈধ দখলদারিত্ব এবং নিরীহ ফিলিস্তিনিদের অত্যাচার করে বাস্তুচ্যুত করার ফলে সে অঞ্চলে মুসলিম ও ইহুদিদের মধ্যে অশান্তি তৈরি হয়। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে গেলে ইহুদিরা সেখানে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। এর পরপরই শুরু হয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। ইসরায়েলি বাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তখন প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে। শত শত গ্রাম গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। বহু মানুষ হত্যা করা হয়।
ব্রিটিশ শাসন ও ইহুদি অভিবাসন : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০ সালে ফিলিস্তিন ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের আওতায় আসে। ব্রিটিশ শাসনামলে ইউরোপ ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যক ইহুদি ফিলিস্তিনে অভিবাসন শুরু করে। ১৯২০ থেকে ১৯৪৮ সালের মধ্যে লাখ লাখ ইহুদি সেখানে চলে আসে।
স্থানীয় আরবদের জমি জবরদস্তিমূলক অধিগ্রহণ করা হয়। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল পশ্চিম তীর, গাজা, গোলান মালভূমি ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। এ দখল আজও চলমান। জাতিসংঘ এ দখলকে অবৈধ ঘোষণা করলেও ইসরায়েল এসব অঞ্চলে অব্যাহতভাবে বসতি স্থাপন করছে। ১৯৬৭ সালের জুনে যুদ্ধে মিসর, জর্ডান ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে ছয় দিনের যুদ্ধ শুরু করে। এতে তারা গাজা উপত্যকা (মিসরের কাছ থেকে), পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম (জর্ডানের কাছ থেকে), গোলান মালভূমি (সিরিয়ার কাছ থেকে) দখল করে নেয়। এ অঞ্চলগুলো আজও আন্তর্জাতিকভাবে ‘অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড’ হিসেবে বিবেচিত।
আধুনিক আগ্রাসন ও অবরোধ : ২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েল গাজা উপত্যকাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। বারবার বোমাবর্ষণ, সামরিক অভিযান ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে গাজাবাসীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যার বেশির ভাগই নারী ও শিশু। বর্তমানে পশ্চিম তীরে ৭ লাখ ইহুদি বসতি স্থাপন করেছে। যা শান্তিপ্রক্রিয়ার বড় অন্তরায়। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনে হামাস নির্বাচনে বিজয়ী হয়। ২০০৭ সালে তারা গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর ইসরায়েল গাজাকে সম্পূর্ণ অবরোধ করে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত ইসরায়েল গাজার বিরুদ্ধে একাধিকবার সামরিক হামলা চালিয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ৫২ হাজার ৮৬২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১ লাখ ১৯ হাজার ৬৪৮ জন। (দৈনিক যুগান্তর : ১৩ মে ২০২৫)। গাজার সরকারি গণমাধমের তথ্যানুসারে, নিহতের সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি। যেখানে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া নিখোঁজ ব্যক্তিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। (দৈনিক যুগান্তর : ১৩ মে ২০২৫)। জাতিসংঘের মতে, ইসরায়েলের বর্বর আক্রমণের কারণে গাজার প্রায় ৯০ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এ ছাড়া অবরুদ্ধ এ ভূখণ্ডের অধিকাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন ও প্রতিক্রিয়া : জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ধ্বংসযজ্ঞ, শিশুদের হত্যা বন্দিত্ব- এসব ঘটনায় আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দা জানানো হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফিলিস্তিনে ইহুদি আগ্রাসন কেবল একটি ভূখণ্ড দখলের ঘটনা নয়; এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, পরিচয় ও মানবাধিকারের বিরুদ্ধে একটি চলমান যুদ্ধ। জাতিসংঘের বহু প্রস্তাব ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদন থাকা সত্ত্বেও এ আগ্রাসন থেমে নেই। ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম তাই শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি মানবিক বেঁচে থাকার লড়াই। ইসরায়েলের বর্বর এ হামলা চলতি বছরের জানুয়ারিতে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে দিয়েছে।
গত বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। অবরুদ্ধ এ ভূখণ্ডে আগ্রাসনের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যা মামলার মুখোমুখিও হয়েছে ইসরায়েল। কিন্তু কার্যত ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে জুটেছে কী, তা চলমান পরিস্থিতি ও সময়ই বলে দিচ্ছে।
লেখক : সম্পাদক, কালান্তর প্রকাশনী