ইসলামের মৌলিক বিধান হজ। অর্থে স্বাবলম্বী ব্যক্তির জন্য হজ পালন করা আবশ্যক। যে ঘরকে কেন্দ্র করে হজব্রত পালন করা হয়, তা পৃথিবীর প্রথম কাবা ঘর। সৃষ্টির সূচনার আত্মপ্রকাশ হয়েছে কাবার পথ ধরে। কাবা ঘরের ডিজাইনার স্বয়ং আমাদের প্রভু। সৃষ্টির প্রথম ভোর থেকে সমহিমায় জাগ্রত, উদ্ভাসিত ও মানব হৃদয়ের দীপ্তিময় মিনার কাবাঘর। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই মানবজাতির জন্য প্রথম যে ঘর নির্মিত হয়েছে, তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারি। এতে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন আছে। যেমন মাকামে ইবরাহিম। যে সেখানে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ। মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে সেই ঘরের হজ করা তার অবশ্য কর্তব্য। আর কেউ প্রত্যাখ্যান করলে সে জেনে রাখুক, নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বজগতের মুখাপেক্ষী নন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৯৬-৯৭)।
হজ পাঁচ স্তম্ভের একটি : ইসলাম যে পাঁচটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোর অন্যতম এ হজ। ভিত্তি ছাড়া যেমন সভ্য দুনিয়ার কোনো কিছু নির্মিত হয় না, তেমনি হজ ছাড়া নির্মিত হয় না মুমিন হৃদয়ে ভালোবাসার কাবাঘর। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ইসলামের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পাঁচটি বিষয়ের ওপর। যথা- ১. এই মর্মে সাক্ষ্যদান যে আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই ও মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। ২. যথাযথভাবে নামাজ আদায় করা। ৩. জাকাত প্রদান। ৪. হজ। ৫. রমজান মাসের রোজা পালন।’ (বোখারি : ৮)।
আল্লাহতে পূর্ণ সমার্পণ : হজের উদ্দেশ্য আল্লাহকে খুশি করা। একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর আদেশ পালন করা। নিজেকে আল্লাহর কাছে পূর্ণ সমর্পণ করা। হজে বান্দা আল্লাহর জন্যই একনিষ্ঠ হয়ে আসে এবং তাঁরই সন্তুষ্টি কামনা করে। মানুষ যখন হজের ইচ্ছায় ঘর ছাড়ে, হৃদয় তখন উদ্বেলিত হয়ে ওঠে প্রভুর প্রেমে। শুভ্র পোশাক যখন গায়ে জড়িয়ে যায়, তখন মন কেঁপে ওঠে প্রিয় প্রভুর ঘর দর্শনের সুখানুভূতিতে। মানুষ তখন হারিয়ে যায় নতুন জগতে। সে ছুটে চলে অনন্ত অসীমের দিকে। তার কণ্ঠে থাকে হাজারো বছর ধরে অগণিত কণ্ঠে গেয়ে ওঠা ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’। যে স্লোগান ইবরাহিম (আ.) থেকে শুরু হয়ে মুহাম্মদ (সা.)-এর কণ্ঠে পূর্ণতা পেয়ে উচ্চারিত হচ্ছে কাবা ঘরের দিকে ছুটে চলা প্রত্যেক হাজির কণ্ঠে। ইহরাম বাঁধা, কাবার তওয়াফ, আরাফাতের অবস্থান, সাফা-মারওয়ায় দৌড়ানো, মুজদালিফায় অবস্থান, কোরবানি, মাথা মুণ্ডানো, শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ- সবকিছুতে বিরাজ করে প্রভুপ্রেমের একনিষ্ঠতা, সমর্পণ ও একাগ্রতা।
মুসলিমই একমাত্র পরিচয় : এখানে ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নেই। শিক্ষিত-মূর্খের তফাত নেই। জ্ঞান-গরিমা প্রকাশের সুযোগ নেই। বুদ্ধি-কৌশল প্রয়োগের অবকাশ নেই। সবার মধ্যে আল্লাহকে পাওয়ার ব্যাকুলতা। প্রভুপ্রেমে বিলীন হওয়ার আকুলতা। নিজেকে মালিকের একনিষ্ঠ সেবক প্রমাণ করার প্রতিযোগিতা। এখানে সবাই এক। সবার পদতলে একই মাটি, মাথার ওপরে খোলা আকাশ, পরনে সাদা কাপড়, মুণ্ডানো মাথা। কারও মুখে অযাচিত কথা নেই, আড়ম্বরতা নেই, সবার মুখে শুধু একই ধ্বনি ‘হাজির হে মালিক, আমি আপনার দরবারে হাজির।’
খোদাপ্রেমের বিশ্ব সম্মেলন : বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের এক অনন্য নিদর্শন হজ। প্রতিবছর কয়েক লাখ মুসলমান বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করার জন্য। একই কাতারে শামিল হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাওয়াফ করে আল্লাহর ঘর। ভ্রাতৃত্বের এমন নিদর্শন পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। এটা এমন এক মিলনমেলা, যেখানে সবার মনে একটাই আশা ও উদ্দেশ্য থাকে, তা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এখানে পার্থিব কোনো চাওয়া-পাওয়ার হিসাব থাকে না। থাকে শুধুই ভ্রাতৃত্ব, পরস্পরের জন্য শুভকামনা। হজকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে, বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহুধাবিভক্ত মুসলিম জাতিকে বছরে অন্তত একটিবারের জন্য হলেও ঐক্যবদ্ধ করে হজ। বিশ্ব মুসলিমের মিলনমেলা হিসেবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এখানে আসা বিশ্বের প্রত্যেক মুসলমানের পোশাক, আমল, ছুটে চলা, উচ্চারণ এক হয়ে যায়। হজের দিনগুলোয় পৃথিবীতে বসবাসরত সব মুসলমানও অনুকরণ-অনুসরণ করে হাজীদের।
মানুষকে নিষ্পাপ করে হজ : হজ পুণ্য ও সফলতার আশিস। অর্জনের ঝুলি সওয়াবে টইটম্বুর করার মহাতিথি। পাপকাজ ও অযথা কথনের বাহুল্য থেকে বিরত থাকতে পারলে হাজির জীবন হবে পাপ-পঙ্কিলতাহীন সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর মতো। প্রভাতে ফোটা প্রথম লাল গোলাপের মতো। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করল এবং হজ অবস্থায় কথা ও কাজে পাপ থেকে বিরত রইল, সে হজ শেষে সেদিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে ঘরে ফিরবে, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল।’ (বোখারি : ১৫২১)।
কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত : হজ দুনিয়া-আখেরাতে দান করে সফলতা। করে মহিমান্বিত। জীবনের জমিনকে করে উর্বর। জীবন উদ্ভিদে বর্ষণ করে রহমতের বারিধারা। আখেরাতের জীবনে রয়েছে- যেমন সওয়াবের ভান্ডার, তেমনি দুনিয়ার জীবনে রয়েছে অর্থ-বিত্তে বুকটান দিয়ে দাঁড়ানোর হিম্মত লাভের প্রেরণা। দুনিয়ার রিজিকে এনে দেয় সমৃদ্ধি। দূর করে দেয় অভাব-অনটন। হজের প্রতি মানবকে উৎসাহিত করে মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা বরাবর হজ ও ওমরা করো। হাঁপর যেমন লোহা, সোনা ও রুপার কলঙ্ক দূর করে ফেলে, হজ ও ওমরা তেমনি অভাব ও পাপ মুছে ফেলে। আর কবুল হজের একমাত্র পুরস্কার হলো- জান্নাত।’ (তিরমিজি : ৮১০)।