পাবনার ঈশ্বরদী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (ইপিজেড) ডায়রিয়া পরিস্থিতির অবনতি ও দুই শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ডায়রিয়ায় আক্রান্তরা সবাই ঈশ্বরদী ইপিজেডের রেনেসাঁ, ডেনিম, ভিনটেজ (এবা) নাকানো ইন্টারন্যাশনাল বিডি, স্টেলা হেয়ার কোম্পানিসহ অন্যান্য কয়েকটি কোম্পানির শ্রমিক। ইতোমধ্যেই ছয় শতাধিক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডাক্তার তাহমিনা শিরীন স্বাক্ষরিত পত্রে পাবনার সিভিল সার্জনকে দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্ত কমিটি সোমবার (২ জুন) বিকেল থেকেই সংশ্লিষ্ট ডায়রিয়া আক্রান্ত এলাকায় গমন, পরিদর্শন ও তদন্ত শুরু করেন।
ছয় সদস্যের এ কমিটিতে টিম লিডার করা হয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক এ এইচ এম মোস্তফা কামালকে। অন্য সদস্যরা হলেন- টেকনিক্যাল অফিসার শরিফ উদ্দিন হাসনাত, চাঁদপুর উত্তর মতলব ষাটনল ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার ফাহমিদা ফাইজা, খাগড়াছড়ি চেঙ্গির সহকারী সার্জন রাজেশ দেব, আইইডিসিআরের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট সোহেল রানা এবং ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট সজিবুল ইসলাম।
সোমবার (২ জুন) বিকেল থেকেই ঈশ্বরদীতে তদন্তের প্রাথমিক কাজ শুরু করে কমিটি।
ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আলী এহসান বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে জানান, সোমবার বিকেল থেকে তারা কাজ শুরু করেছেন। কমিটি প্রথমেই ঈশ্বরদী ইপিজেড পরিদর্শন করেন।
এদিকে মঙ্গলবার (৩ জুন) সকাল ৯টায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ঈশ্বরদী পৌর শহরের পিয়ারাখালী জামতলা এলাকায় সাগর হোসেনের স্ত্রী মাহফুজা খাতুনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি নাকানো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিতে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর আগে রোববার (১ জুন) দিবাগত রাত ১টায় কণা খাতুন (২৫) নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। কণা ইপিজেডের আইএইচএম কোম্পানির কোয়ালিটি কাটিং সেকশনের কর্মী ছিলেন। এ নিয়ে ইপিজেডের দুই নারী শ্রমিকের মৃত্যু হলো। ইপিজেডের সাপ্লাই পানি পান করে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি পরিবারের।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার (২৯ মে) ইপিজেড এলাকায় দুপুরের খাবার খাওয়ার পর পেট ব্যথা, পাতলা পায়খানা, জ্বর, বমি ও মাথাব্যথায় শ্রমিকরা অসুস্থ হতে শুরু করেন। তাৎক্ষণিক কয়েকজন শ্রমিক ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যান। পরে বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার, শনিবার, রোববার, সোমবার ও মঙ্গলবার শত শত শ্রমিক পেটের সমস্যা ও ডায়রিয়া জনিত রোগ নিয়ে চিকিৎসা নিতে ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, ইপিজেডের মেডিকেল সেন্টার, পার্শ্ববর্তী লালপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও আটঘরিয়া স্বাস্থ্য কেন্দ্রেও চিকিৎসা নেন। এসব হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন। ৫০ শয্যার ঈশ্বরদী হাসপাতালটিতে বেড সংকট থাকায় স্যালাইন লাগিয়ে রোগীরা বারান্দা, করিডোরে ও সিঁড়িতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়াও বেশি আক্রান্ত রোগীরা পাবনা জেনারেল হাসপাতাল ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। আবার যাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি তাদের অনেকেই প্রাথমিকভাবে স্থানীয় চিকিৎসকদের পরামর্শে বাড়িতেই চিকিৎসা গ্রহণ করছেন। অবস্থার অবনতি ঘটলে তারা হাসপাতালে এসে ভর্তি হন। ঈশ্বরদী ইপিজেডের রেনেসাঁ, নাকানো, এ্যাবা ও রহিম আফরোজ, আইএইচএম, স্টিল হেয়ার, অস্কার বাংলাসহ কয়েকটি কোম্পানির প্রায় ছয় শতাধিক শ্রমিক অসুস্থ হয়েছেন।
অপরদিকে ইপিজেডের এত বিপুল সংখ্যক রোগী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় ঈশ্বরদী ও পার্শ্ববর্তী লালপুরে স্যালাইন সংকট দেখা দেখা দেয়। তখন এই সুযোগে কিছু ফার্মেসি বেশি দামে স্যালাইন ও ডায়াপার বিক্রি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তখন সেনাবাহিনী, ফায়ার ব্রিগেড সহ বিভিন্ন উৎস থেকে স্যালাইন সংগ্রহ করে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন।
ঈশ্বরদী হাসপাতালের রেকর্ড থেকে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার (২৯ মে) রাত থেকে মঙ্গলবার (৩ জুন ) দুপুর ২টা পর্যন্ত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ইপিজেডের ৩১৩ জন শ্রমিক হাসপাতালে ভর্তি হন। একই সময় পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী লালপুর হাসপাতালে ৭৪ জন ইপিজেড এর শ্রমিক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হল। এছাড়াও গুরুতর অসুস্থ ১০ জন রোগীকে পাবনা সদর হাসপাতাল ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভর্তি হয়েছে ইপিজেড মেডিকেল সেন্টারে।
ঈশ্বরদী থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) এবিএম মনিরুল ইসলাম জানান, ঈশ্বরদী ইপিজেডে নারী শ্রমিকের মৃত্যুর বিষয়টি তিনি সরেজমিনে তদন্ত করেছেন এবং ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে নিশ্চিত হয়েছেন।
ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক এবিএম শহীদুল ইসলাম বলেন, আজকের (মঙ্গলবার) অবস্থা কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আমাদের মেডিকেল সেন্টার এবং বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিপুল খাবার স্যালাইন মজুত আছে। যাদের প্রয়োজন, তারা এখান থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন। পানি পরীক্ষার রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায়নি।