ঢাকা বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আল্লামা সুলতান যওক নদভী (রহ.) আকাশে অঙ্কিত নাম

ফারহান হাসনাত
আল্লামা সুলতান যওক নদভী (রহ.) আকাশে অঙ্কিত নাম

সুলতান যওক নদভী- এ নাম সুবিদিত। বাংলাদেশি ইসলামি পণ্ডিত। জামেয়া দারুল মাআরিফ আল ইসলামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও মহাপরিচালক। বিশ্ব মুসলিম লীগের বাংলাদেশ শাখার প্রধান। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ও প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব ছিলেন তিনি। সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশের। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সংস্কারে এ দেশে প্রথম যৌক্তিক আওয়াজ তুলেন তিনি। বইও লেখেন। আরবি ভাষায় দক্ষতা ও সাহিত্য অবদানে তিনি ছিলেন অনন্য।

পড়াশোনার হাতেখড়ি : আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভীর বাড়ি কক্সবাজারের মহেশখালীতে, জন্ম ১৯৩৯ সালে। বাবার নাম সুফি আবুল খায়ের, মা রূহ আফজা বেগম। শৈশবেই মাকে হারান তিনি। নানা সুফি মকবুল আহমদ ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা যফর আহমদ উসমানি (রহ.) ও হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর খলিফা।

পড়াশোনার হাতেখড়ি মহেশখালীতেই। এখানেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ করেন। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন সেখানকার গোরকঘাটা জামিয়া আরাবিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায়। ১৯৫৯ সালে জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া থেকে প্রথম স্থানে লাভ করে দাওরায়ে হাদিস উত্তীর্ণ হন।

পটিয়ায় যাদের সান্নিধ্য পান : পটিয়ায় যুগশ্রেষ্ঠ কয়েকজন মনীষীকে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান। এর মধ্যে অন্যতম হলেন, আল্লামা মুফতি আজিজুল হক (রহ.), আল্লামা ইমাম আহমদ (রহ.), আল্লামা হাজী ইউনুস (রহ.), আল্লামা আমির হোসাইন (রহ.), আল্লামা ইসহাক আল-গাজী (রহ.), মুফতি ইবরাহিম (রহ.), আল্লামা আলী আহমদ বোয়ালভি (রহ.) ও শাইখুল হাদিস আল্লামা ইহসানুল হক সন্দ্বিপী (রহ.) প্রমুখ।

বর্ণাঢ্য কর্মজীবন : একাডেমিক পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে দীর্ঘ ৬০ বছরের বেশি সময় শিক্ষকতা করেছেন আল্লামা সুলতান যওক। চট্টগ্রামের বরশতনগরের রশিদিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু হয়। এরপর তিনি মাওলানা আতহার আলী (রহ.)-এর আহ্বানে কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়ায় শিক্ষকতা করেন। পরে নিজ শ্বশুর মাওলানা আলী আহমদ বোয়ালভী (রহ.)-এর প্রতিষ্ঠিত হুসাইনিয়া মাদ্রাসা কিছুদিন পরিচালনা করেন। এরপর চট্টগ্রামের জামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগরে শিক্ষকতা করেন। অতঃপর, ১৩৮১ হিজরি সনে জামিয়া পটিয়া থেকে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর দুই ধাপে ১৭ বছর তিনি পটিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক ছিলেন। এরপর ১৯৮৫ সালে মুফাক্কিরে ইসলাম আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)-এর পরামর্শক্রমে আরবি ভাষায় প্রাধান্য ও আধুনিক শিক্ষার সংযোজনে চট্টগ্রামে জামেয়া দারুল মা’আরিফ আল-ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে কয়েক মাস তিনি ভারতের দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় শিক্ষকতা করেন। কর্মজীবনে তিনি তিনি কোরআন, হাদিস, ফিকাহ, আরবি ভাষা, সাহিত্যসহ ইসলামি শিক্ষার নানা বিষয়ে পাঠদান করেন।

যাদের কাছ থেকে হাদিসের সনদ পেয়েছেন : আরবি ভাষা ও সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি অর্জনের পাশাপাশি গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসদের কাছ থেকে হাদিস পড়ানোর অনুমতি পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম হলেন, শাইখুল হাদিস আল্লামা জাকারিয়া কান্ধলভী (রহ.), হাকিমুল ইসলাম কারি মুহাম্মদ তাইয়েব (রহ.), হাফিজুল হাদিস আল্লামা আবদুল্লাহ দরখাস্তি (রহ.), আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.), খাতুমুল মুহাদ্দিসিন আল্লামা আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.), আল্লামা আশেক এলাহি বারনি (রহ.), আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরি (রহ.), আল্লামা মাহমুদ হাসান গঙ্গুহি (রহ.), আল্লামা মনজুর নুমানি (রহ.) ও মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন মুফতি মুহাম্মদ হাসান অমৃতসারি (রহ.) প্রমুখ।

নদভী উপাধি লাভ : তখন ১৯৮১ সাল, ভারতের নদওয়াতুল উলামায় অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক ইসলামি সাহিত্য সম্মেলনে অংশ নেন তিনি। দীর্ঘ দুই মাস সেখানে অবস্থান করেন তিনি। মাধ্যমিক স্তরে অনুবাদ বিষয়ে পাঠদান করেন। এই প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা না করলেও বিশ্বখ্যাত দায়ী আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) তাকে সম্মানসূচক নদভী উপাধি দেন এবং নামের শেষে তা ব্যবহারের নির্দেশ দেন।

শিক্ষা সংস্কারে তার চিন্তা-ভাবনা : আল্লামা সুলতান যওক নদভী শিক্ষা সংস্কারে যুগোপযোগী কাজ করে গেছেন। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় যুগান্তকারী নমুনা রেখে গেছেন, যা বাস্তবায়ন করতে পারলে মাদসারা শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা হবে। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, চিন্তাচেতনা ও ইলমি অধঃপতনের এই যুগে আমাদের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আগের মতো ফলাফল দিতে পারছে না। সৌকর্যমণ্ডিত ঐতিহ্যবাহী এ সমস্ত মাদ্রাসার অধিকাংশই বর্তমানে জড়তা ও স্থবিরতা শিকার ও প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজ সংস্কার ও যুগোপযোগী প্রজন্ম তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি ক্রমবর্ধমান এ রোগের দ্রুত চিকিৎসা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণি ও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণির মাঝে বিরাট দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এ সমস্ত সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা কারিকুলামে সংস্কার প্রয়োজন। এই চিন্তাধারার আলোকে তিনি কল্যাণকর পুরাতন ও উপকারী নতুনের সমন্বয়ে একটি পরিকল্পনা জাতির সামনে তুলে ধরেছেন।

ভাণ্ডারে তার বিবিধ রতন : ১৯৮৬ সালে আন্তর্জাতিক ইসলামি সাহিত্য সংস্থা (রাবেতাতুল আদব আল-ইসলামি)-এর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও বাংলাদেশ ব্যুরো চিফ নিযুক্ত হন তিনি। মক্কায় মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগ আয়োজিত সম্মেলনে অংশ নেন ১৯৯০ সালের ১২ আগস্ট। সেসময় পবিত্র কাবাঘরে প্রবেশ করে নামাজ পড়ার বিরল সুযোগ লাভ করেন। ১৪২৯ হিজরিতে তাকে তৎকালীন সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ পবিত্র কাবাঘরের গিলাফ উপহার দেন।

রচনাবলি : আল্লামা সুলতান যওক নদভীর আরবি ও উর্দু ভাষায় লেখা অর্ধশতাধিক গ্রন্থ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, শরহু জাদুত তালিবিন, শাজারাত মিনান নুসুস আল-আদাবিয়্যাহ, আত-তালিকাত আল-আসারিয়্যাহ আলাল মাকামাত, নুখবাতুল আহাদিস, রিহলাতি ইলা আরদিল জিহাদ, কুল্লিয়াতে যওক, জামে যওক, আল-খুতাবুল মিনবারিয়্যাহ আল-আারিয়্যাহ, দাওয়াতুল ইসলাহি ওয়াত তাতবির ফি মিনহাজিত তালিম, সাফহাতুন মিন হায়াতি, ইশরুনা দারসা, আল-জানিবুল বালাগি ফি শিরিল মুতানাব্বি, আত-তালিকাত আন-নদবিয়্যাহ আলাল হামাজাত আন-নববিয়্যাহ, আল-মুখতারাত আল-শিরিয়্যাহ, কন্দে খামাহ শরহে উর্দু পন্দে নামাহ, আল-কিরাআতুল আরাবিয়্যাহ, আত-তরিক ইলাল ইনশা, কালিমাত আদাবিয়্যাহ ফিকরিয়্যাহ।

ইন্তেকাল : কোরআন, তাফসির, হাদিস, ফিকাহ, ভাষা, সাহিত্যসহ জ্ঞানের নানা শাখায় বিচরণশীল এ আলেম শুক্রবার (২ মে) রাত ১টার দিকে চট্টগ্রামের এভারকেয়ার হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। পরদিন শনিবার জামেয়া দারুল মা’আরিফ আল-ইসলামিয়া প্রাঙ্গণে তার জানাজা নামাজ পড়া হয়। তার লাশ দাফন করা হয় মাদ্রাসার কবরস্থানে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত