ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

যুবকদের কৌশলগত নেতৃত্ব গঠনে করণীয়

* সুলতানি ও মোগল আমলের স্থাপত্য শিল্পরীতির সমন্বয়ে নির্মিত এ মসজিদের পরিকল্পনা ও নির্মাণকাজে নিযুক্ত ছিলেন প্রখ্যাত স্থপতি মুহাম্মদ খাঁ। মসজিদটি নির্মাণের পর ১৮৩৭ সালে রওশন খাতুন চৌধুরী ও ১৯০৯ সালে আবুল আহমেদ খান গজনবি সংস্কার করেন
যুবকদের কৌশলগত নেতৃত্ব গঠনে করণীয়

২১ শতকের বাংলাদেশ একটি ভূরাজনৈতিক সংঘর্ষ ও কৌশলগত প্রতিযোগিতার কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে। তাই একটি জ্ঞানসমৃদ্ধ, কৌশলনির্ভর ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন যুবসমাজ ছাড়া রাষ্ট্রের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নেওয়া ও গ্লোবাল পটভূমিতে সম্মানজনক অবস্থান অর্জন সম্ভব নয়। এই ধারায় যা করা যেতে পারে-

ক. মাধ্যমিক স্তর থেকেই Geostrategy & Diplomacy অন্তর্ভুক্তি : শিক্ষাব্যবস্থায় ভূগোল বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান থাকলেও বর্তমান বিশ্বদৃষ্টির জন্য তা যথেষ্ট নয়। তরুণদের জানাতে হবে আন্তর্জাতিক শক্তির মানচিত্র (Great Powers, Multipolarity, Indo-Pacific dynamics), কূটনীতির নীতি ও কৌশল (soft power, track II diplomacy) বাংলাদেশকে ঘিরে আন্তর্জাতিক স্বার্থ (Bay of Bengal, Teesta, Rohingya crisis, BRI vs. Indo-Pacific strategy)। এটি হবে পাঠ্যসূচিতে কৌশলগত চেতনার প্রথম অনুপ্রবেশ, যাতে শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র বুঝতে শেখে।

খ. দক্ষিণ এশিয়া, মুসলিম বিশ্ব ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের ভূমিকায় তরুণদের সরাসরি যুক্ত করার রূপরেখা : তরুণদের আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে শুধু পড়ানো নয়, ব্যবহারিকভাবে সম্পৃক্ত করা হবে। যেমন, দক্ষিণ এশিয় রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সীমান্ত, পানিবণ্টন, অর্থনৈতিক সম্পর্কের মতো বিষয়ে যুব সংলাপ বা মডেল কনফারেন্স। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক- উম্মাহ-চিন্তায় তরুণদের প্রস্তুতি। জাতিসংঘের বিভিন্ন এজেন্সিতে তরুণ প্রতিনিধি ও ফেলোশিপ কর্মসূচি। যেন তরুণরা রাষ্ট্রনীতি ও বৈদেশিক নীতিতে ‘অবজারভার’ নয়, অংশগ্রহণকারী হয়।

গ. Bangladesh Youth Geopolitical Forum (BYGF) প্রতিষ্ঠা : এটি হবে একটি জাতীয় কৌশলচর্চার প্ল্যাটফর্ম, যেখানে- ছাত্র, গবেষক, তরুণ কূটনীতিক ও উদ্যোক্তারা দেশের ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলবে, আঞ্চলিক সংকট, যুদ্ধ, বাণিজ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে গবেষণা ও সংলাপ হবে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও থিংকট্যাংকের সঙ্গে যৌথ কার্যক্রম চলবে। এই ফোরাম হবে রাষ্ট্রনির্ভর যুবক নয়, রাষ্ট্রনির্মাতা যুবক গড়ার কারখানা।

৫. ন্যায্যতা ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষা : এই স্তম্ভের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে যুবশক্তিকে শুধু ভবিষ্যতের নাগরিক হিসেবে নয়, বরং ভবিষ্যতের রক্ষক ও ন্যায্যতার কর্মী হিসেবে গড়ে তোলা। জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমি দখল, পানি সংকট ও পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এখন আর শুধু পরিবেশবাদীদের কাজ নয়- এটি ন্যায়বোধসম্পন্ন যুবশক্তির যুদ্ধক্ষেত্র। এই স্তম্ভ দাবি করে-

ক. রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় যুবন্যায্যতার সংরক্ষণ : একে বুঝাবার জন্য Youth Equity Quota পরিভাষার চল রয়েছে। এটি এমন এক ন্যায্যতামূলক কাঠামো, যার মাধ্যমে বাংলাদেশে যেকোনো পরিবেশ, জলবায়ু ও ভূমি-সম্পর্কিত নীতিতে যুবসমাজের সক্রিয়, অর্থবহ ও দায়িত্বশীল অংশগ্রহণ আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাধ্যতামূলক করা হবে।

এটি শুধু একটি আসন বা নমিনেশন নয়, বরং যুবদৃষ্টিভঙ্গিকে পরিকল্পনার অংশ করে তোলা। যার দাবি হলো, নদী ব্যবস্থাপনায় তরুণ হাইড্রোলজিস্ট, গবেষক ও স্বেচ্ছাসেবকদের উপস্থিতি, পরিবেশ সংরক্ষণ প্রকল্পে স্থানীয় যুবসংগঠনের মতামত, জাতীয় ও স্থানীয় স্তরে নীতিনির্ধারণী টিমে পরিবেশ-সচেতন তরুণ কণ্ঠ থাকার নিশ্চয়তা। এর মাধ্যমে সরকারি সিদ্ধান্ত ও বাস্তবতা মধ্যে গবেষণাভিত্তিক, প্রজন্মসংবেদনশীল সংযোগ গড়ে উঠবে।

খ. Climate Youth Corps গঠনের প্রস্তাব : এ হবে একটি প্রশিক্ষিত, সংগঠিত ও অভিযানে সক্ষম যুববাহিনী, যাদের কাজ হবে- এক. নদীর গতিপ্রকৃতি, বনাঞ্চল, জলাভূমি, উপকূলীয় অঞ্চল ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে তথ্য সংগ্রহ, পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন তৈরি। দুই. দুর্যোগকালীন সময়ে স্বেচ্ছাসেবী সহায়তা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম। তিন. স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে পরিবেশ-সচেতনতা ও প্রতিবাদ সংগঠনে নেতৃত্বদান। চার. নদী-পাহাড় বন-সমুদ্র- এই চার জাতীয় ঐতিহ্যের ভিত্তিকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা।

এ হচ্ছে এক ধরনের Green Territorial Citizenship- যেখানে তরুণরা শুধু বসবাসকারী নয়, জল-জমি-জীবনের দায়িত্বশীল রক্ষক হতে শিখবে।

এই স্তম্ভের মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে ন্যায়বোধ, দায়িত্ববোধ ও ভবিষ্যতের প্রতি দায়বদ্ধতা গড়ে তোলা হবে। পরিবেশগত ন্যায়বিচারকে শুধু আইন নয়, বরং নাগরিক নৈতিকতা ও প্রজন্মসংলগ্ন রাজনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হবে।

৬. উদ্ভাবনী নেতৃত্ব ও কৌশলচর্চা : এই স্তম্ভ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে তরুণদের নেতৃত্ব ও বুদ্ধিবৃত্তিক অংশগ্রহণকে নীতি ও কাঠামোর স্তরে বৈধতা দিতে চায়। রাষ্ট্র শুধু নেতৃত্ব তৈরি করবে না, বরং উদ্ভাবক ও কৌশলজ্ঞ তরুণদের স্বাধীন চিন্তা, গবেষণা ও দিকনির্দেশনা প্রদানের পরিবেশ নিশ্চিত করবে। এ স্তম্ভের দাবি-

ক. জাতীয় বাজেটে Youth Sovereignty Fund : এটি হবে সরকারি বাজেটের একটি পৃথক ও সংরক্ষিত অংশ, যার মাধ্যমে তরুণ উদ্ভাবক, গবেষক, চিন্তক ও সংগঠকদের উদ্যোগকে আর্থিক, প্রযুক্তিগত ও নীতিগত সহায়তা দেওয়া হবে।

এর হবে লক্ষ্য:

প্রযুক্তি, সাহিত্য, জলবায়ু, ইতিহাস বা কৌশলবিষয়ক স্বাধীন গবেষণা।

গ্রাম ও শহরভিত্তিক উদ্ভাবনী সমাজ-উন্নয়ন প্রকল্প।

বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা, কারিগরি প্রতিষ্ঠানসহ সবক্ষেত্রের চিন্তাশীল তরুণদের সমান সুযোগ।

এই তহবিল দাতাভিত্তিক হবে না, হবে অধিকারভিত্তিক। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে- Youth as Strategic Stakeholders।

খ. যুব পরিচালিত গবেষণাকেন্দ্র- Think Bangladesh 2050 : এটি হবে একটি স্বাধীন, রাষ্ট্রীয়ভাবে সমর্থিত কিন্তু যুব পরিচালিত থিংক-ট্যাংক। যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথরেখা নির্ধারণে চিন্তা, গবেষণা ও কৌশলগত সুপারিশ দেবে।

এর কাজের মধ্যে থাকবে-

রাষ্ট্র ও নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য সক্ষমতা, ডিজিটাল রূপান্তর, শিক্ষা, ভৌগোলিক কৌশলবিষয়ে নীতিপত্র তৈরি।

সরকার, বেসরকারি খাত ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের জন্য গবেষণাকর্ম।

Policy Simulation Lab I Youth Strategic Dialogues ইত্যাদির আয়োজন।

Think Bangladesh 2050 তরুণদের পলিসি ফলোওয়ারের জায়গা থেকে পলিসি মেকার হবার দিশা দেবে। কারণ রাষ্ট্রকে যে তরুণরা বোঝে, তারাই একে গড়ে তুলতে পারে।

খোলাসা : বাংলাদেশের যুবশক্তি আর শুধু একটি সম্ভাবনার নাম নয়। শক্তিটি নৈতিক, জ্ঞানভিত্তিক এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার এক কেন্দ্রবিন্দু। এই বাস্তবতাকে ফলবান করার জন্য প্রয়োজন এমন এক ডকট্রিন, যা একদিকে ভবিষ্যতের কাঠামো নির্মাণ করবে, অপরদিকে অতীতের দায় ও আত্মপরিচয়ের সংযোগে রূপান্তর ঘটাবে।

আমরা এমন এক যুগে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে তরুণ শুধু একজন চাকরিপ্রার্থী নয়, বরং তিনি হতে পারেন- একজন দার্শনিক চিন্তানায়ক, একজন তথ্যযোদ্ধা, একজন সবুজ সিপাহী, একজন ন্যায়বোধের প্রহরী এবং একজন ভবিষ্যৎ রচনাকারী। এই পরিচয় কেউ দান করবে না, অর্জন করতে হবে। আর এই অর্জনের পথ তৈরি করতে হবে রাষ্ট্রকে- একটি নতুন সামাজিক চুক্তির ভিত্তিতে।

এখন সময় এসেছে যুবকদের শুধু দিকনির্দেশনা দেওয়া নয়, বরং দিকনির্মাণের শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার। তাদের হাতে তুলে দিতে হবে জ্ঞানচর্চার স্বাধীনতা, কৌশলচর্চার পরিবেশ, সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা এবং দায়িত্বের মর্যাদা।

একটি দেশ তার ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে চায়? তাহলে তাকে তার যুবসমাজকে দৃষ্টিভঙ্গির অগ্রসর উত্তরাধিকারী বানাতে হবে। তাদের নৈতিকতার সেনানী, প্রযুক্তিযুদ্ধে দক্ষ এবং জল-জমি-জীবনের রক্ষক বানাতে হবে। তখনই তৈরি হবে এমন এক প্রজন্ম, যারা শুধু যুগের সন্তান নয়, বরং যুগের নির্মাতা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত