ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মুসলিম বিজ্ঞানী-৩

আলোকবিজ্ঞানের জনক ইবনে হায়সাম

রায়হান রাশেদ
আলোকবিজ্ঞানের জনক ইবনে হায়সাম

জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা ও আবিষ্কারের একজন প্রতিভাধর ছিলেন হাসান ইবনে হায়সাম। তাকে আলোকবিজ্ঞানের জনক বলা হয়। অ্যানাটমি বা অঙ্গব্যবচ্ছেদ বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রকৌশলবিদ্যা, চক্ষুবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, দর্শন এবং সর্বোপরি বৈজ্ঞানিক গবেষণার পদ্ধতিগত উন্নয়নে তার বিশেষ অবদান রয়েছে।

একজন ইবনে হায়সাম

পুরো নাম আবু আলি হাসান ইবনে হাসান ইবনে হায়সাম। ইউরোপে তিনি হাজেন নামে পরিচিত। ইরাকের বসরায় ৩৫৪ হিজরি বা ৯৬৫ সালে তার জন্ম। শিক্ষার হাতেখড়ি শুরু হয় বসরার এক মক্তবে। উচ্চশিক্ষা লাভ করেন বাগদাদে। তিনি মধ্যযুগের ইউরোপে দ্বিতীয় টলেমি পদার্থবিদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জীবন কাটিয়েছেন কায়রোতে- ফাতেমিয় খলিফার সান্নিধ্যে। গবেষণামূলক বই লিখেছেন। শিক্ষা দিয়েছেন অভিজাত ব্যক্তিদের- বই লেখা ও পাঠদানই ছিল তার রোজগারের অন্যতম মাধ্যম। কর্মজীবনে তিনি বসরার বড় সরকারি পদে কাজ করেছেন। কেউ বলেন তিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন, আবার কেউ বলেন তিনি ছিলেন নির্মাণ প্রকৌশলী বা সিভিল ইঞ্জিয়ার।

ইবনে হায়সাম ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। তবে মুসলিমদের মধ্যে বিদ্যমান জাতিগত দ্বন্দ্ব তাকে কষ্ট দিত। তিনি দীর্ঘকাল শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি দেখেন যে, এই দ্বন্দ্ব মানুষই সৃষ্টি করেছে। তার ব্যক্তিগত জীবন, পরিবার, বিয়ে ও সন্তান সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। তবে তিনি ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো আলো বিলাচ্ছেন। তিনি ১০৪০ খ্রিষ্টাব্দে কায়রোতে মারা যান। ৭৫ বছর বেঁচেছিলেন।

বুক অব অপটিকস ও আলোকবিজ্ঞান

ইবনে হায়সামে কর্মজীবনে কায়রোতে ছিলেন। তৎকালীন খলিফা হাকিমের কাছে যান। খলিফা তাকে নীলনদের বন্যা নিয়ন্ত্রণের উপায় বের করার দায়িত্ব দেন। কাজ শুরু করার পর ইবনে হায়সাম বুঝতে পারেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অগত্যা পরিকল্পনা থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। এরপর তিনি লিখেছিলেন তার সেরা বই বুক অব অপটিকস যাকে নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকার সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী বই গণ্য করা হয়।

বুক অব অপটিকস সাত খণ্ডে লেখা। বইটি প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের ধারণায় আমূল পরিবর্তন আনে। চোখ থেকে আলো কোনো বস্তুর ওপর পড়লে আমরা সে বস্তুটি দেখতে পাই- এই ধারণাটি ছিল অ্যারিস্টটলের। কিন্তু হায়সাম বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে এটি ভুল প্রমাণিত করেন। যেমন : বহুদূরের তারকারাজি আমরা চোখ মেললেই দেখতে পাই। প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনি ঘোষণা করলেন, কোনো বস্তু থেকে আলো আমাদের চোখে এলেই তবে আমরা সে বস্তুটি দেখতে পাই। তিনি আলোকরশ্মির সরল পথে গমনের বিষয়েও পরীক্ষা করেন এবং প্রমাণ করেন।

বুক অব অপটিকস ছাড়াও তিনি আলোকবিজ্ঞানের ওপর রিসালা ফিলদাও বা ট্রিটিজ অব লাইট রচনা করেন। এখানে তিনি আলোর প্রতিসরণ, বিচ্ছুরণ, গ্রহণ, রংধনু, অধিবৃত্তিক কাঁচ, বিবর্ধন কাঁচ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেন। চোখের জৈবিক গঠন ও ব্যবচ্ছেদ বিষয়েও বিস্তর আলোচনা করেন। ড. রাজী উদ্দিন সিদ্দিকীর মতে, আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণের নিয়ম ইবনে হায়সাম আবিষ্কার করেন। তিনি আলোর আপতন ও প্রতিসরণ পথ এবং এই দুই মাধ্যমের অন্তর্র্বর্তী সমতলের ওপর অঙ্কিত সরলরেখা একই সমতল ক্ষেত্রের ওপর অবস্থিত এ পর্যন্ত আবিষ্কার করেন। এর পাঁচশত বছর পর লিডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিজ্ঞানী Willebrod Snell উক্ত দুই পথের কোণের মধ্যে যে একটি সম্পর্ক রয়েছে তা উদ্ভাবন করেন। এছাড়া তিনি একটি লেন্স কীভাবে ম্যাগনেফাইং হিসেবে কাজ করে তা পরীক্ষা করে দেখান। ক্যাটোপট্রিক্স সম্পর্কে তাঁর গবেষণা Al-Hayens problem নামে পরিচিত। বর্তমানে ইংরেজি Lens শব্দটি ইবনে হায়সামের আরবিতে ব্যবহৃত ‘আদাসা’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ‘আদাসা’ অর্থ মসুরের ডাল, চোখের লেন্স মসুরের ডালের মতো। তাই ল্যাটিন অনুবাদকরা এই আদাসাকে Lenticulumn বলে অনুবাদ করেন। এই শব্দটি আজ Lens নামে পরিচিত হচ্ছে।

পৃথিবীর প্রথম ক্যামেরা

ইবনে হায়সাম পিনহোল ক্যামেরা আবিষ্কার করেন। এটি পৃথিবীর প্রথম ক্যামেরা। আজকের আধুনিক ক্যামেরাগুলো পিনহোলের অনুসারী। এটি একটি আলোনিরোধক কাঠের বাক্স। এর এক পৃষ্ঠে ছোট একটি ছিদ্র হতো। ছিদ্রযুক্ত তলটি আলোমুখী করে তার সামনে কোনো বস্তু এমনভাবে উপস্থাপন করা হতো, যেন এর ছায়া ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করে বিপরীত তলে প্রতিবিম্বিত হয়। এভাবেই সেকালে পিনহোল ক্যামেরা দিয়ে তখনকার সময় পাওয়া যেত। ক্যামেরা হিসেবে কখনো ব্যবহার করা হয়েছে কাঠের বাক্স, কখনো ঘর, কখনো দেয়াল।

ঝুলিতে যত অর্জন : অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, ইবনে হায়সাম ছিলেন আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবক্তা। সেই হিসেবে তাকে প্রথম আধুনিক বিজ্ঞানী বলা হয়। তিনি যেকোনো বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য কঠোর পরীক্ষামূলক পদ্ধতির প্রচলন করেন। তার পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ার ধাপ সাতটি- এক. পর্যবেক্ষণ, দুই. সমস্যা নির্দিষ্টকরণ, তিন. সমাধান অনুমান করা, চার. পরীক্ষার মাধ্যমে অনুমান যাচাই করা, পাঁচ. পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করা, ছয়. তথ্যের বিশ্লেষণ, তুলনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সাত. ফলাফল প্রকাশ করা। ইবনে হায়সাম অ্যানাটমি বা অঙ্গব্যবচ্ছেদবিজ্ঞান, জোতির্বিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রকৌশলবিদ্যা, চক্ষুবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, দর্শন, ক্যালকুলাস, জ্যামিতি এবং সর্বোপরি বৈজ্ঞানিক গবেষণার পদ্ধতিগত উন্নয়নে অনেক কাজ করেন।

২০০-এর অধিক কাজ করেন ইবনে হায়সাম- যার মধ্যে ৯৬টি বৈজ্ঞানিক। তবে সেগুলোর মধ্যে টিকে আছে মাত্র ৪৬টি। তথাপি সেই ৪৬টিই তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন গবেষক, পর্যবেক্ষক এবং বিজ্ঞানী হিসেবে। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক আলোকবর্ষ উপলক্ষে জাতিসংঘ ইবনে হায়সামের আলোকবিদ্যাবিষয়ক কাজের ১০০০তম বার্ষিকী উদ্যাপন করেছে।

তার আরও কাজ : ইবনে হায়সামের শ্রেষ্ঠ গবেষণাপত্র বুক অব অপটিকস। এছাড়াও অ্যানালাইসিস অ্যান্ড সিনথেসিস, ব্যালেন্স অব উইজডম, কনফিগারেশন অব দ্য ওয়ার্ল্ড, অপসকুলা, মোশন অব ইচ সেভেন প্লানেটস, ট্রিটিজ অন লাইট, ট্রিটিজ অন প্ল্যাস, দ্য রেজুলেশন ইত্যাদি বই লিখেন।

ইবনে হায়সাম নভোজোতির্বিজ্ঞান নিয়েও বিস্তর গবেষণা করেছেন। বিভিন্ন ভরের মধ্যকার অদৃশ্য আকর্ষণের কারণে ত্বরণের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। তার মাকালা ফিল কারাস্তন নামক গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন বস্তুর আকর্ষণ কেন্দ্র নিয়ে আলোচনা করেছেন যা আমরা সেন্টার অব গ্রাভিটি নামে জানি। আল শুকুক আল আ বাতলামিয়াস তার জোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক কাজগুলোর মধ্যে একটি। নির্মাণ প্রকৌশলে তার কোনো লিখিত গ্রন্থ না থাকলেও তিনি একজন দক্ষ এবং মেধাবী প্রকৌশলী ছিলেন। গণিতে তিনি কাজ করেছেন কণিক, সংখ্যাতত্ত্ব আর বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতি নিয়ে। তিনি ইউক্লিডিয় জ্যামিতির কিছু উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধন করেছেন।

লেখক : আলেম ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত