ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দৃষ্টিনন্দন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম

মোস্তফা কামাল গাজী
দৃষ্টিনন্দন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম

বায়তুল মোকাররম বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ। এটি ঢাকায় অবস্থিত। অনন্য স্থাপত্যশৈলী আর দৃষ্টিনন্দন কারুকাজে ভরপুর পুরো মসজিদ। পাকিস্তানের বিশিষ্ট শিল্পপতি আব্দুল লতিফ ইবরাহিম বাওয়ানি ও তার ভাতিজা ইয়াহিয়া বাওয়ানির উদ্যোগে এই মসজিদ নির্মাণের পদক্ষেপ গৃহীত হয়।

আব্দুল লতিফ ইবরাহিম বাওয়ানি প্রথম ঢাকাতে বিপুল ধারণক্ষমতার একটি গ্র্যান্ড মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেন।

১৯৫৯ সালে ‘বায়তুল মোকাররম মসজিদ সোসাইটি’ গঠনের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকার মিলনস্থলে মসজিদটির জন্য জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। স্থানটি নগরীর প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র থেকেও ছিল নিকটবর্তী। বিশিষ্ট স্থপতি টি. আব্দুল হুসেন থারিয়ানিকে মসজিদ কমপ্লেক্সটির নকশার জন্য নিযুক্ত করা হয়। মসজিদের নকশা করার সময় মসজিদকে কেন্দ্র করে বায়তুল মোকাররম মার্কেট, অফিস, লাইব্রেরি, গাড়ি পার্কিং এবং দক্ষিন প্রান্তে আগ্রার তাজমহলের সম্মুখভাগের একাধিক ছোট ফোয়ারা শোভিত পানির আধারের মতো লম্বা পানির আধার সম্বিলিত মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়।

পরবর্তীতে ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি এই মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয়। এই মসজিদে একসঙ্গে ৪০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারে। মসজিদের প্রধান কক্ষটি তিন দিকে বারান্দা দিয়ে ঘেরা। মিহরাবটি অর্ধ-বৃত্তাকারের পরিবর্তে আয়তাকার। আধুনিক স্থাপত্যে কম অলংকরণই একটি বৈশিষ্ট্য- যা এই মসজিদে লক্ষণীয়। এর অবয়ব অনেকটা পবিত্র কাবা শরিফের মতো হওয়ায় মুসলমানদের হৃদয়ে এই মসজিদটি আলাদা জায়গা করে নিয়েছে।

মসজিদটি নির্মাণের লক্ষ্যে ৮.৩০ একর জমি বরাদ্দ দেয় সরকার। মসজিদের আয়তন ৬০ হাজার বর্গফুট। মসজিদটি প্রধানত ৮তলা। নিচতলায় বিপণিবিতান ও গুদামঘর, প্রথমতলা থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত ভবন, এর ওপরে মেজেনাইন ফ্লোর বা ব্যালকুনি। এই হল আটতলা। কিন্তু সাধারণত ব্যবহৃত হয় ৬ তলা। মুসল্লিরা যে জায়গা বায়তুল মোকাররম মসজিদের ব্যবহার করে থাকে, তা হলো পুরুষদের নামাজের জায়গা ১ম তলা ২৬,৫১৭ বর্গফুট, মেজেনাইন ফ্লোর ১,৮৪০ বর্গফুট, দ্বিতীয় তলার আয়তন ১০,৬৬০ বর্গফুট, তৃতীয় তলার আয়তন ১০,৭২৩ বর্গফুট, চতুর্থ তলার আয়তন ৭৩৭০ বর্গফুট, পঞ্চম তলার আয়তন ৬,৯২৫ বর্গফুট এবং ষষ্ঠ তলার আয়তন ৭৪৩৮ বর্গফুট।

জুমা ও ঈদ উপলক্ষে নামাজ পড়ার জন্য রয়েছে বাড়তি ৩৯,৮৯৯ বর্গফুট জায়গা। মহিলাদের নামাজের জায়গা ৬,৩৮২ বর্গফুট। পুরুষদের অজুখানার জন্য ব্যবহৃত হয় ৬,৪২৫ বর্গফুট। নারীদের অজুখানার জন্য ব্যবহৃত হয় ৮৮০ বর্গফুট। সব মিলিয়ে মুসল্লিরা বায়তুল মোকাররম মসজিদের ১ লাখ ২৫ হাজার ৬২ বর্গফুট এলাকা ব্যবহার করে থাকে। মসজিদের প্রবেশ পথটি রাস্তা হতে ৯৯ ফুট উঁচুতে।

১৯৬৩ সালে মসজিদের প্রথম পর্বের নির্মাণকাজ শেষ হয়। ১৯৬৩ সালের ২৫ জানুয়ারি শুক্রবার মসজিদে প্রথম জুমার নামাজ আদায় করা হয়। প্রথম তারাবির নামাজও হয় ১৯৬৩ সালের ২৬ জানুয়ারি শনিবার।

মসজিদের প্রথম খতিব ছিলেন মাওলানা আব্দুর রহমান বেখুদ (রহ.)। তিনি ১৯৬৩ সালে এই মসজিদের খতিব হিসেবে নিয়োগ হোন। তার পরে নিয়োগ হোন মাওলানা কারি উসমান মাদানি (রহ.)। তিনি এ মসজিদের খতিব ছিলেন মাত্র এক বছর। পরবর্তী খতিব ছিলেন মুফতি সাইয়েদ মুহাম্মদ আমিমুল ইহসান। তিনি ১৯৬৪-১৯৭৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর খতিব হোন মুফতি মাওলানা মুইজ (রহ.)। তিনি দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৪-১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। তার পরে দায়িত্ব পালন করেন খতিব মাওলানা উবায়দুল হক (রহ.)। তিনি ছিলেন একজন দেশবরেণ্য আলেম। তিনি খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৪-২০০৯ সাল পর্যন্ত। তারপর মুফতি মাও. নুরুদ্দীন- যিনি ২৪ বছর এখানে ইমামের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, এক বছর ভারপ্রাপ্ত খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। পরে খতিব হন প্রফেসর মাওলানা মো. সালাহ উদ্দিন। তিনি ৫ জানুয়ারি ২০০৯ সালে এ মসজিদের খতিব নিযুক্ত হন। এরপর খতিবের দায়িত্ব পান মাওলানা রুহুল আমিন। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতন হলে তিনি কয়েক জুমা মসজিদে আসেননি। পরে দুয়েকজন দায়িত্ব পালন করেন। পরে খতিব হিসেবে দায়িত্ব পান মুফতি আবদুল মালেক।

বায়তুল মোকাররম মসজিদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন। সরকারি বেতন স্কেল, পদমর্যাদা, পদবিন্যাস ইত্যাদি মসজিদের খেদমতে নিয়োজিত কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও সমান। বর্তমানে বায়তুল মোকাররম মসজিদে খতিব ১ জন, ইমাম ৩ জন, মুয়াজ্জিন ২ জন, খাদেম ২০ জন, মাইক অপারেটর ১ জন, গার্ড ৫ জন।

মসজিদের বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বাগান। বাগানটি মুঘলশৈলীতে নকশা করা। হাজারো ফুলের হাতছানি বিমুগ্ধ করে প্রতিটি দর্শনার্থীকে। ১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এই মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। বিশ্বের বিখ্যাত মসজিদগুলোর একটি ঢাকার এই বায়তুল মোকাররম মসজিদ।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া শরইয়্যাহ, পাগাড়, টঙ্গী

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত