প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১০ নভেম্বর, ২০২৫
বাঘায় এলেই দেখা মিলবে ঐতিহ্যবাহী শাহী মসজিদ, সুবিশাল দীঘির স্বচ্ছ পানি আর প্রাচীন জাদুঘরের। হজরত শাহ দৌলাহ (রহ.)-এর মাজার আর প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন সমৃদ্ধ দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান রাজশাহীর বাঘা। প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো শাহী মসজিদ এখানকার সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান। ঐতিহ্যবাহী শাহী মসজিদ ঘিরে সুবিশাল দীঘি, প্রাচীন অন্দরমহল, পুকুরের ধ্বংসস্তূপ, হজরত আব্দুল হামিদ দানিশমান্দ (রহ.), হজরত মুয়াজ্জেম দানিশমান্দ (রহ.), শাহেদৗলাহ (রহ.)-এর মাজার এবং উৎসব পার্ক ভ্রমণপ্রিয় এবং ধর্মানুরাগী মানুষের জন্য এক সেরা আকর্ষণীয় স্থান। কিছুদিন আগে নতুন করে যুক্ত হলো জাদুঘর। দর্শনীয় স্থান হিসেবে বাঘায় কেউ বেড়াতে এলে একসঙ্গে দেখা মিলবে এসবের।
রাজশাহী শহর থেকে ৫০ কিলোমিটারের পথ বাঘা উপজেলা সদর। পদ্মানদীর কোল ঘেঁষে এ উপজেলার অবস্থান। বাঘা মসজিদের আশপাশে সাজানো আমবাগান। আমের দিনে থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা রঙিন আম বেশ চমৎকার দেখায়। তখন দর্শনার্থীদের আনাগোনাও বেড়ে যায় দ্বিগুণ।
মসজিদে প্রবেশের জন্যে রয়েছে লাল পোড়া মাটির কারুকার্যশোভিত সুন্দর দুটি ফটক। প্রবেশ করেলেই দেখা মিলে সবুজে ছাওয়া আঙিনা, গাছের ডালে হাজারো পাখির কলকাকলি, দিঘির নিটোল জলে রাজহাঁসের ভেসে বেড়ানোর অপূর্ব দৃশ্য। সত্যি মনোমুগ্ধকর একটা পরিবেশ।
প্রায় ২৫৬ বিঘা জমির ওপর ১৫২৩-১৫২৪ সালের মধ্যেবর্তী সময়ে হুসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন শাহের পুত্র সুলতান নসরাত শাহ মসজিদটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় এই মসজিদের সংস্কার করা হয়। মসজিদের গম্বুজগুলো ভেঙে গেলে ১৮৯৭ সালে নতুন করে আবার ছাদ ও গম্বুজ নির্মাণ হয়। বাঘা মসজিদের ছবি ৫০ টাকার নোট ও ১০ টাকার টিকিটে দেখতে পাওয়া যায়। মসজিদের চারপাশটাই বিশাল দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সমভূমি থেকে থেকে ৮-১০ ফুট উঁচু করে মসজিদের আঙিনা তৈরি করা হয়েছে। দেয়াল প্রায় ৮ ফুট চওড়া। সবটাই লাল পোড়ামাটির আস্তরণ। দোয়ালের গায়ে সুন্দর করে আঁকা হয়েছে আম গাছ, শাপলা ফুল ও লতাপাতার অপূর্ব কারুকাজ।
মসজিদটির ওপরে রয়েছে মোট ১০টি গম্বুজ ও চারটি মিনার। ভেতরে রয়েছে ৬টি স্তম্ভ ও সুন্দর কারুকার্যখচিত ৪টি মেহরাব। মসজিদের দৈর্ঘ্য ২২.৯২ মিটার, প্রস্থ ১২.১৮ মিটার এবং উচ্চতা ২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। মাঝখানের দরজার ওপর ফার্সি ভাষায় লিখিত একটি শিলালিপি রয়েছে।
মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোণে একটু উঁচুতে নির্মিত হয়েছে একটি বিশেষ নামাজকক্ষ। অনেকে মনে করেন, এটি আগে মহিলাদের নামাজের জায়গা ছিল। আবার অনেকের মতে, কক্ষটি শুধু সুলতানের প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত গভর্নরের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। মসজিদের পাশেই আছে একটি কবরস্থান। বেশ কয়েকজন বুজুর্গ শায়িত আছেন এখানে। কথিত আছে, হজরত শাহ দৌলা দানেশমন্দ (রহ.) পাঁচজন সঙ্গীসহ ১৫০৫ সালে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাগদাদ থেকে বাঘায় আসেন। খানকা গড়ে এখানেই থেকে যান। ইন্তেকাল করলে বাঘা মসজিদের এই মাজারে মাদফুন হোন। নাসিরউদ্দিন নসরত শাহ জনকল্যাণার্থে মসজিদের সামনেই একটি দিঘি খনন করেন। শাহী মসজিদ সংলগ্ন এ দিঘিটি ৫২ বিঘা জমির ওপর বিস্তৃত। দিঘির চারপাশে রয়েছে অসংখ্য নারিকেলবীথি। প্রতি শীত মৌসুমে দিঘিতে বেড়াতে আসা অসংখ্য অতিথি পাখির কলতানে এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। সুদূর সাইবেরিয়া ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা এসব পাখির কলতানে মুখরিত হয়ে ওঠে এই এলাকা; যা ভ্রমণবিলাসী মানুষের নজর কাড়ে। এখানে রয়েছে পিকনিক কর্নার। প্রতি শীত মওসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসেন বাঘায়। দিঘিটির চারপাশে রয়েছে বাঁধানো পাড়।
মসজিদের উত্তর পাশে রয়েছে জহর খাকি পীরের মাজার। ১৯৯৭ সালে মাজারের পশ্চিম পাশ খনন করার সময় ৩০ ফুট বাই ২০ ফুট আয়তনের একটি বাঁধানো মহল পুকুরের সন্ধান মিলে। পুকুরটি একটি সুড়ঙ্গপথ দিয়ে অন্দরমহলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কয়েক বছর আগে মোজাইকবিশিষ্ট এখানে আরও দুটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে নামাজ পড়েন মহিলারা। ঐতিহাসিক ও সুরম্য এই মসজিদ দর্শন করতে ও মাজার জিয়ারত করতে দূর-দূরান্তের লোকজন আসেন প্রতিদিন। প্রতি শুক্রবার বসে মুসলমানদের মিলনমেলা। প্রতি ঈদেও এখানে লক্ষাধিক লোকের আগমন ঘটে। দিন দিন মসজিদের পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে চলছে।
২০০৮ সালের আগস্টে ফুর্তি এফএম রেডিও গ্রামীণফোনের মাধ্যমে দেশের ২১টি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা থেকে সাতটিকে এসএমএসের মাধ্যমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় নির্বাচনের জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানালে বাঘা শাহী মসজিদ প্রথম স্থান অধিকার করে। বাঘায় পর্যটনশিল্পের অন্যতম আকর্ষণ হলো- বাঘা শাহী মসজিদ।