
দেশের বৃহত্তম বিল আর মিঠা পানির সবচেয়ে বড় জলাধার চলনবিলের অবয়ব আর ঐতিহ্য যেমন বিরাট তেমনি এর কিংবদন্তির ভাণ্ডারও বিশাল। নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ভরপুর চলনবিল বর্ষার বিপুল জলরাশিতে হয়ে উঠে নব যৌবনা। এ সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ ঘুরতে আসেন এ বিলে। সরকারি উদ্যোগ আর পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কিংবদন্তির চলনবিল হতে পারে এক আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র।
স্থানীয়রা জানান, বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন পর্যটন স্পটসহ বিশাল জলরাশিতে নৌকা নিয়ে বেড়ানোর জন্য প্রতি বছর লক্ষাধিক দর্শনার্থী আসেন চলনবিলে। বর্ষা মৌসুমে প্রতিদিনই নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ান তারা। বিশেষ করে চলনবিলের বিলসা সেতু, কুন্দইল, উধুনিয়া, বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের ৯ ও ১০নং ব্রিজ এলাকায় ছুটির দিনে হাজার হাজার দর্শনার্থীর ভিড় জমে। তবে শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনে শত শত নৌকা ছুটে বেড়ায় দর্শনার্থীদের নিয়ে। কিন্তু পর্যটন মোটেল বা রেস্ট হাউজ না থাকায় দূরাগত পর্যটকরা এখানে এসে অসুবিধায় পড়েন। তাই সরকারিভাবে দর্শনার্থীদের থাকার জন্য রেস্ট হাউজ নির্মাণ করে দিলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার পর্যটক চলনবিলে বেড়াতে আসার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
নাটোরের গুরুদাসপুরের খুবজিপুরে অসংখ্য গ্রন্থপ্রণেতা মরহুম অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদের হাতে গড়া চলনবিল জাদুঘর এ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান। জাদুঘরে আছে সুলতান নাসির উদ্দিনের নিজ হাতে লেখা কোরআন শরীফ। গাছের ছালে বাংলায় লেখা প্রাচীন পুঁথিসহ অসংখ্য সামগ্রী। প্রায় ৩৫০ বছর আগে সিংড়া উপজেলার ডাহিয়া এলাকায় ইসলাম প্রচার করতে আসা ঘাসী-ই-দেওয়ানের তিশিখালীর মাজারে প্রতি শুক্রবার হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটে।
চলনবিলে আনোয়ারা উপন্যাসের লেখক নজিবর রহমানের মাজার, রায় বাহাদুরের বাড়ির ধ্বংস্তূপ, দেশের বৃহত্তম গোবিন্দ মন্দির কপিলেশ্বর মন্দির, বারুহাসের ইমাম বাড়ি, শীতলাইয়ের জমিদার বাড়ি, হান্ডিয়ালের জগন্নাথ মন্দির ও রায়গঞ্জের জয়সাগর মৎস্য খামার রয়েছে। চাটমোহরের হরিপুরে লেখক প্রমথ চৌধুরী ও বড়াইগ্রামের জোয়াড়ীতে লেখক প্রমথ নাথ বিশীর বাড়িসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান বুকে ধারণ করে আছে চলনবিল।
চলনবিলের জনপদে অসংখ্য প্রাচীন মসজিদ, মন্দির, মাজার রয়েছে আর সেগুলো ঘিরে রয়েছে নানা ইতিকথা, বিশ্বাস। বিলপাড়ের তাড়াশ উপজেলার নবগ্রামে নওগাঁ শাহি মসজিদ (মামার মসজিদ) ও ভাগ্নের মসজিদ নামে দুটি মসজিদ রয়েছে। মামার মসজিদটির পাশেই হজরত শাহ শরিফ জিন্দানির (র.) মাজার অবস্থিত। অনেকেই বলেন, মসজিদটি তিষ নিই নির্মাণ করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে, তিনি বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে বাগদাদ থেকে এ দেশে ষোড়শ খ্রিস্টাব্দে এসেছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য। রাজা ভানসিংহের সময় তার আগমন হয় বলে জানা যায়।
রাজা ভানসিংহের পরিষদ ও তার ঠাকুরেরা দলে দলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ায় তিনি তার খিড়কি পুকুরে ডুবে প্রাণ বিসর্জন দেন বলে কথিত আছে। এখনও ভানসিংহের সেই খিড়কি পুকুর রয়েছে। মামার মসজিদের পাশে ভাগ্নের মসজিদ নিয়ে নানা উপকথা শোনা যায়। কোনো এক ভাগ্নে মামার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এক রাতে নাকি মসজিদ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাতের মধ্যে ছাদ দেওয়া সম্ভব হয়নি, তাই সেটি ছাদবিহীন অবস্থায় ছিল। কেউ বলে, সেই ভাগ্নে ওই রাতেই মারা যাওয়ায় মসজিদটির নির্মাণ অসম্পূর্ণ থাকে।
বিলপাড়ের চাটমোহরের হান্ডিয়ালে শেঠের বাঙ্গালা ও শেঠের কুঠি মীরজাফরের সহচর জগৎশেঠের বিশ্রামাগার ছিল বলে লোকে এগুলোকে আজো ঘৃণার চোখে দেখে। হান্ডিয়ালে রয়েছে বুড়াপীরের দরগা। বিলপাড়ের সিরাজগঞ্জ জেলার নিমগাছিতে ফকির দলের আস্তানা ছিল। শোনা যায়, বিদ্রোহী ফকিরদল মুক্তাগাছার মহারাজার পূর্বপুরুষ চন্দ্রশেখর আচার্যকে ময়মনসিংহ থেকে বন্দি করে নিমগাছিতে আটক রেখেছিল। নিমগাছির হাটখোলার পশ্চিমে ভোলা দেওয়ান নামে এক কামেলের মাজার রয়েছে। মাজারের পাশে একটি মসজিদ আছে।
বেহুলা-লখিন্দরের উপকথা শুনে কে না মোহিত হয়। লখিন্দরের বাবা চাঁদ সওদাগর মনসা দেবীকে মানত না, তাই নিয়ে কতো কাণ্ড। সেই চাঁদ সওদাগরের সময় চাঁদের বাজার লাগত চলনবিল পাড়ে, এখনকার বস্তুল হাই স্কুলের ঠিক পাশের ভিটায়। তাড়াশের বিনসাড়া গ্রামে রয়েছে বেহুলা-লখিন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর পাশেই আছে বেহুলার কুয়া (কূপ)। বেহুলা চাঁদের বাজারে যে নৌপথ দিয়ে যাতায়াত করতো সেটি বেহুলার খাড়ি নামে পরিচিত। বেহুলার খাড়ি নামক এই জোলা এখনও রয়েছে। খাড়ির পাশে নৌকা সদৃশ ঢিবি রয়েছে। গ্রামের লোক এখনও বিশ্বাস করে, ঢিবির নিচে বেহুলার নৌকা রয়েছে।
নিমগাছি হাটের পশ্চিমে জয়সাগর নামে এক বিশাল দীঘি রয়েছে। এই দীঘি নিয়ে নানা উপকথা প্রচলিত। রাজা অচ্যুত সেন এক যুদ্ধে জয়লাভ করে বিজয়ের স্মৃতিস্বরূপ নাকি জয়সাগর খনন করেছিলেন। দীঘি ১২ বছর ধরে খনন করার পরও নাকি এ দীঘিতে পানি ওঠেনি। এক রাতে রাজাকে এক সাধু স্বপ্নে দেখায় তার ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার পর বাসর রাতে সে দীঘিতে নেমে একমুঠো মাটি তুললে পানি উঠবে। রাজার ছেলে তা করায় দীঘি পানিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু রাজকুমারের সলিল সমাধি ঘটে। এরপর রাজবধূও সেখানে প্রাণ বিসর্জন দেয়। এই রাজবধূ নাকি অভিশাপ দিয়ে যায় কেউ এর পানি ছুঁবে না। লোকে ভয়ে এর পানি ব্যবহার না করায় জঙ্গলে ভরে যায় দীঘি। দীঘির মধ্যে বেল গাছ জন্মে। সেই বেলও ভয়ে কেউ ছুঁতো না। এখন অবশ্য দীঘিটি পরিষ্কার করে মাছ চাষ করা হচ্ছে।
চলনবিল পাড়ের নটমন্দির, তাড়াশ কপিলেশ্বর মন্দির, মামা-ভাগ্নের মসজিদ, আনুখাঁর দীঘি, পাগলাপীর, বারুহাসের বাঙ্গালা, তিসিখালীর ঘাসি দেওয়ানের মাজার, চৌগ্রামের বুড়াপীরের মাজার, চাপিলার মসজিদ, পোয়ালশুরা পাটপাড়া মসজিদ, গুরুদাসপুর এলাকার নীলকুঠি নিয়ে কতো উপকথা ছড়িয়ে আছে তার হিসাব করা দুরূহ। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিকল্পিত উদ্যোগে দেশের বৃহত্তম জল সম্পদ চলনবিল হয়ে উঠতে পাওে দেশের অন্যতম একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।
চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে তৎকালীন বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য কাজী গোলাম মোর্শেদ এবং বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপক হায়দার আলী তিশিখালী মাজার ঘিরে চলনবিলে একটি নয়নাভিরাম পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সেই প্রতিশ্রুতি আর আলোর মুখ দেখেনি।