বয়সের পার্থক্য ও স্বাস্থ্যগত কারণে প্রবীণ নারীর স্বামী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আগে মারা যায়। ষাট বছর বয়সি নারীর প্রায় অর্ধেকের স্বামী মৃত্যু বরণ করে। সত্তুর বছর বয়সি অধিকাংশ নারীর বৈধব্য বরণ করতে হয়। আমাদের চার পাশে তাকালে বিধবা প্রবীণ নারীর মুখ দেখতে পাই। ষাট বছর বয়সি নারীর বিয়ের সংবাদ পাওয়া খুবই কঠিন বিষয়। অথচ এই বয়সে একজন পুরুষ সঙ্গী খুবই প্রয়োজন। এসব বিধবা প্রবীণদের রয়েছেন ৪০-৪৫ বছরের দাম্পত্য যাপনের অভ্যস্ততা। দীর্ঘ সময় ধরে স্বামীর সাথে কাটানোর মধ্য দিয়ে যে জীবনযাপন করেছেন তা হারিয়ে প্রচণ্ড মনোকষ্টে ভোগেন। নারীর সব অভিযোগ সাধারণত তার স্বামীকে নিয়ে। অভিযুক্ত ব্যক্তিটি যখন পৃথিবীতে অনুপস্থিত তখন তার অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হতে থাকে। আমাদের দেশে নারীর হাতে সহায় সম্পদ তেমন একটা থাকে না।
দাম্পত্য মানে নারী-পুরুষের বৈবাহিক জীবন। দাম্পত্য সামাজিক, ধর্মীয় ও আইনগতভাবে বৈধ। আমাদের দেশে দাম্পত্য শুরুর আগে কোনো প্রশিক্ষণ নেয়া হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবরা দাম্পত্য বিষয়ে ওরিয়েন্টেশন দেয়।
বিশেষ করে যারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা দাম্পত্যের চ্যালেঞ্জগুলোকে প্রেম ভালোবাসা দিয়ে মোকাবিলা করার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নেন। দাম্পত্য জীবনের নানা চ্যালেঞ্জকে কেউ কেউ তেমন একটা পাত্তা দিতে চায় না। দাম্পত্য জীবনকে বেশিরভাগ মানুষই সহজ করে নিতে পছন্দ করে। এটা অবশ্যই একটা ইতিবাচক ভাবনা।
দাম্পত্য জীবন নানাভাবে পরিবেশ, পরিস্থিতি, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিবারের সদস্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। সবাই কমবেশি পরামর্শ দিয়ে দাম্পত্যকে কঠিন করে তুলতে পছন্দ করেন। আমরা দাম্পত্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্বামী-স্ত্রীর উপর আস্থা রাখতে পছন্দ করি না বরং এক পা বাড়িয়ে দিয়ে উপদেশ বিতরণে আকুল হয়ে উঠি।
আমরা যদি কোনো দম্পতিকে জিজ্ঞেস করি কেন সন্তান নিয়েছেন তা হলে নিচের কয়েকটি উত্তর শুনতে পাবেন। যথা- বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি, আত্মীয়-স্বজনের চাপে, সবার ছেলে-মেয়ে আছে সেজন্য বাচ্চা নেয়া, সক্ষম দম্পতি হিসেবে স্বীকৃতি পেতে, নিজের স্বপ্ন সন্তানকে দিয়ে পূরণ করতে, দাম্পত্য জীবনের ঝগড়াঝাটি থামাতে সন্তান নেয়া হয়েছে। আমাদের দম্পতিরা সাধারণত চার ধরনের দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করে যথা ১. ঝগড়া বিবাদ ও মিলমিশের দাম্পত্য ২. সম্মান মর্যাদা ভালোবাসার দাম্পত্য ৩. সময় কাটানোর দাম্পত্য ৪. উপায়হীন দাম্পত্য।
ঝগড়া বিবাদ ও মিলমিশের দাম্পত্য আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি নজরে পড়ে। মতের অমিল কিংবা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ কর্মকে কেন্দ্র করে মনোমালিন্য, ঝগড়া বিবাদ শুরু হয়। ঝগড়া শুরু হলে কে কাকে কতখানি ছোট করতে পারবে সে বিষয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা থাকে। পরিস্থিতি খারাপ হলে একে অপরকে শারীরিকভাবে আঘাত করে। শিশুরা বাবা-মার এমন কর্মকাণ্ডে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। শিশুরা বাবা-মার প্রতি নেতিবাচক ধারণা নিয়ে বড় হতে থাকে।
সম্মান মর্যাদা ও ভালোবাসার দাম্পত্য আমাদের সবারই কাম্য। স্বামী-স্ত্রী উভয়ই পরস্পরের প্রতি সম্মান মর্যাদা, দায়িত্ব কর্তব্য, সহনশীলতা, বিশ্বস্ততা নিয়ে দাম্পত্যে থাকলে সন্তানরা বাবা-মার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বড় হয়।
সময় কাটানোর দাম্পত্য হলো স্বামীর সাথে স্ত্রী ঝগড়া বিবাদে কিংবা যোগ্যতায় কুলিয়ে উঠতে না পারলে চুপ করে থাকার নীতি অনুসরণ করে। অন্যদিকে স্ত্রীর যোগ্যতা, ধনসম্পদ বেশি হলে স্বামী চুপ থাকার চেষ্টা করে। ঝগড়া বিবাদে ক্লান্ত, ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উভয়ই নীরবে সংসার করে যান অথবা মানসিকভাবে একে অপরের প্রতি নিরাসক্ত হয়ে পড়েন।
উপায়হীন দাম্পত্য হলো স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে অপছন্দ করে, ঘৃণা করে, মতের ভিন্নতা থাকে, আলাদা বিছানায় শোয়, ছেলে-মেয়ের দিকে তাকিয়ে একই বাসায় থাকে, আর্থিক সামাজিক বিষয় এমনভাবে থাকে যে, কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে পারছে না।
দাম্পত্যের সংকটগুলো ছেলে-মেয়েরা শিশু বয়সেই বুঝতে পারে। বাবা-মার আচরণ, চলা ফেরা, কথাবার্তা, নিষ্ঠুরতা, গালাগালি, মারামারি, পরকীয়া শিশু মনে গভীর দাগ কাটে। বাবা-মা অনেক সময়ই সন্তানকে নিজের পক্ষে আনতে, সহানুভূতি পেতে একে অপরের চরিত্র সম্মান হানি করতে সচেষ্ট হয়।
নিজেদের ঝগড়া বিবাদ, নিষ্ঠুরতা শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে সাময়িক সুখ হয়তো পাওয়া যাবে কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে স্বামী স্ত্রী উভয়েরই অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। শিশুরা বাড়িতে সহিংসতার বড় সাক্ষী হয়ে যায় এবং সহিংসতা কিংবা যৌন নিপীড়নের শিকার হতে পারে।
বাচ্চারা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় ভোগে, বিছানায় প্রস্রাব করে দেয়,অকারণে পেট ব্যথা হয়, স্কুলে যেতে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে, সামাজিক মেলামেশায় উৎসাহ পায় না, নিজ ঘরে একাকী থাকতে পছন্দ করে, কোনো কাজে উৎসাহ বোধ করে না, হতাশায় ভুগতে থাকে।
উপরের সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শিশুরা যৌবনে উপনীত হয় এবং নিজেরা দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করে। অল্প কিছু সংখ্যক যুবক-যুবতীকে দাম্পত্য জীবনে অনাগ্রহী হয়ে উঠতে দেখা যায়।
বাবা-মার কাছ থেকে প্রাপ্ত জীবন শিক্ষা শিশুরা কার্যত সারা জীবন বয়ে বেড়ায়। বাবা-মার কাছ থেকে প্রাপ্ত গুণাবলী শিশুকে পরিণত বয়সে সাহসী, সৎ, মেধাবী, জ্ঞানী, বুদ্ধিমান মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কথায় আছে যেমন গাছ তেমনই ফল!
দাম্পত্য জীবনে প্রতারণা, নিষ্ঠুরতা, অপমান, অসম্মান, মিথ্যা, লুকোচুরি সন্তানকে মানসিকভাবে দুর্বল হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে।
একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ-পরিবারে গড়ে ওঠা শিশুরাই ভবিষ্যতে প্রবীণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে। শিশুরা পরিবারে দাদা-দাদি, নানা-নানি কিংবা প্রবীণ ব্যক্তির ক্ষেত্রে অসম্মান অপমান নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করতে দেখে তবে ভবিষ্যতে তারাও একদিন প্রবীণদের প্রতি আরো বেশি নিষ্ঠুরতা, অপমান, অসম্মান প্রদর্শন করতে শিখবে।
আমরা শিশুকে পরিবারে, স্কুলে শিশু, নারী ও প্রবীনদের প্রতি কেমন আচরণ করতে হবে সে বিষয়ে কার্যকর কোন প্রশিক্ষণ দিতে পারছি না ফলে তরুণরা রাস্তা ঘাটে, গণপরিবহনে, সেবা প্রতিষ্ঠানে, অফিস আদালতে কাঙ্ক্ষিত আচরণ করতে পারছে না। আমরা ভুলে যাই যে, সন্তান শেষ পর্যন্ত সমাজের হয়ে যায়। সন্তানকে গড়ে তোলা হয় মূলত সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ এবং স্বস্তিদায়ক সামাজিক জীবন গড়ে তোলার জন্য।
দাম্পত্য জীবনে যেসব চাহিদা থাকে তা হলো, সুশ্রী সুদর্শন, শিক্ষিত, আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান, সহনশীল, মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন একজন সঙ্গী। আমার কাছে মনে হয়েছে দাম্পত্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালোবাসা আর সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন সঙ্গীর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।
যারা সঙ্গীকে অপমান অপদস্ত নির্যাতন নিপীড়ন করে বিকৃত সুখ লাভের চেষ্টা করে তারা নিজেদের ক্ষতির পাশাপাশি সন্তানদের বিরাট ক্ষতি করেন। আমাদের সন্তানরা ঝগড়া বিবাদের দাম্পত্য দেখে বড় হয়ে দাম্পত্য যাপনে অনাগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে জন্মহার আশঙ্কাজনক হারে নিম্নগামী হবার সম্ভাবনা থাকবে। দাম্পত্য শুধু জৈবিক চাহিদা পূরণের বিষয় নয় পৃথিবীর জন্য মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ তৈরির পীঠস্থান।