রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণই মূল সম্পদ। জনগণের শ্রমে-ঘামে-মেধায়-পরিকল্পনায় একটি দেশ বা জাতির অগ্রগতি নিশ্চিত হয়। বিশ্বের জনসংখ্যা যখন ৫০০ কোটি হতে চলেছিল, ঠিক তখনি জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিচালনা পরিষদের মাধ্যমে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। এটি মূলত জাতিসংঘ কর্তৃক জনসংখ্যা-সংশ্লিষ্ট একটি বার্ষিক আয়োজন। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) জানিয়েছে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮২০ কোটি (৮ দশমিক ২ বিলিয়ন)। যা ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের তুলনায় বেড়েছে ১৯ কোটি। বিশ্বের জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশে নিত্যনতুন অসংখ্য সমস্যা যুক্ত হচ্ছে। বিশ্বে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে সে হারে খাদ্যের জোগান নেই।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে খাদ্যাভাব ও অপুষ্টিজনিত কারণে। মূলত বিশ্ব জনসংখ্যার বিভিন্ন সমস্যাকে চিহ্নিত করে বিশেষ করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব, লিঙ্গ ভারসাম্য, দারিদ্র্য, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্যে প্রতিবছর ১১ জুলাই বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা দিবস পালিত হয়ে আসছে।
বৈশ্বিক জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা জরুরি, যাতে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায় এবং সারা বিশ্বে মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়। এরই ধারাবাহিকতায় নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর আমাদের দেশেও বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালিত হয়ে আসছে।
বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের প্রতিপাদ্য ‘একটি ন্যায্য এবং আশাবাদী পৃথিবীতে পছন্দের পরিবার তৈরি করতে তরুণদের ক্ষমতায়ন করা’। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। ইউএনএফপিএ জানিয়েছে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ৫৭ লাখে। এর মধ্যে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১১ কোটি ৭১ লাখের বেশি, যা মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ অর্থাৎ ৩ কোটি ৩০ লাখ (প্রায় ৩৩ মিলিয়ন) কিশোর-কিশোরী এবং ১০-২৪ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি (৫০ মিলিয়ন), যা জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ। বর্তমান বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অধিক হওয়ায় ২০৬৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ক্রমাগত জনসংখ্যা বাড়বে। এরপর আবার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। জনসংখ্যার ৭ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী, যা বয়স্ক জনগণের সংখ্যা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে এবং মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী।
রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক উপাদানগুলোর মধ্যে জনসংখ্যা অন্যতম। জনসংখ্যা ব্যতীত রাষ্ট্র গঠন কল্পনাতীত। আবার এই জনসংখ্যা যদি জনশক্তিতে রূপান্তরিত না হয় তাহলে রাষ্ট্রকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই জনসংখ্যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিশাল জনসমষ্টি মানেই বিপুল শ্রমশক্তি। কথাটি শুনতে ভালো লাগলেও আমাদের দেশে এই বিশাল জনসংখ্যার জন্য সমস্যাই বেশি।
আমাদের সীমিত ভৌগোলিক আয়তন এবং সীমিত উৎপাদন ব্যবস্থায় জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে রাষ্ট্রকে অনেক দিকে ভাবতে হয়। যেহেতু বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ কর্মক্ষম বয়স সীমার মধ্যে। সে হিসেবে বলা যায়, আগামীর বিশ্বে বাংলাদেশের তরুণরাই বিপুল শ্রমশক্তির জোগান দেবে। তৈরি করবে উপভোক্তার মস্ত বড় বাজার। তবে এর জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থাকে যুব ক্ষমতায়ন, প্রজনন অধিকার এবং একটি সহায়ক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরির উপর জোর দিতে হবে। যাতে করে তরুণরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। তাহলে দুনিয়ার বিস্তৃত জ্ঞান ও নেটওয়ার্ক-পণ্যের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণভারও অর্পিত হবে তরুণ প্রজন্মের হাতে। তরুণ কর্মক্ষম শক্তিকে কাজে লাগানোই দেশের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এই শক্তিকে কাজে লাগাতে পারলেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। অধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি পৃথিবীকে দ্রুত নগরায়নের দিকে ধাবিত করছে।
বিবিএস ও ইউএনএফপির তথ্যমতে, বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হলো ঢাকা। দেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ লোক এই ঢাকা সিটিতে বাস করে। ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টোর গ্লোবাল সিটিস ইনস্টিটিউশন পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ ঢাকা হবে বিশ্বের তৃতীয় জনসংখ্যা বহুল শহর এবং একই সময়ে জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখে।
প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং স্মার্ট নগর পরিকল্পনার মাধ্যমে উচ্চ ঘনত্বের জনসংখ্যা পরিচালনা করা সম্ভব হলেও আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের জন্য সেটা অনেকাংশেই অসম্ভব। সুপেয় পানির অপ্রতুলতা, বাতাসের বিষাক্ততা, সম্পদের বিলুপ্তি, বাসস্থানের সমস্যা, প্রাণপ্রতিবেশ ধ্বংস ইত্যাদি বহু বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হচ্ছে বর্ধিত জনসংখ্যার ঢাকা শহর। জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে না পারলে আমাদের আর্থসামাজিক জীবনের সব ক্ষেত্রে এর কুপ্রভাব পরিলক্ষিত হবে। অদক্ষ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বাড়বে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, অপুষ্টি এবং অশিক্ষার শিকার হবে বিপুলসংখ্যক মানুষ।
দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি কমিয়ে আনা যায়, এসব বিষয়ে হিসাব-নিকাশ করার জন্যই আজকের এই দিবসটি। বর্তমান বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত উন্নয়ন ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে দেশ দ্রুত উন্নয়নের পথে ধাবিত হয়েছে। দেশের মানুষের গড় আয়ু, শিক্ষার হার, শিল্পোৎপাদন, রাজস্ব আয়, জনশক্তি রপ্তানি ও জিডিপির হার বেড়েছে। এখন প্রয়োজন বৈষম্যহীন টেকসই স্মার্ট সমাজব্যবস্থা আর টেকসই স্মার্ট সমাজ গড়ে তুলতে হলে সমাজব্যবস্থাকে অবশ্যই অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে। সমাজ ব্যবস্থায় সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়নে পিছিয়ে পড়া, সুবিধাবঞ্চিত শিশু, শ্রমজীবী শিশু, নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গ, প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর উন্নতি সাধনের জন্য উপযুক্ত নীতিমালা গ্রহণ, আইন-প্রণয়ন ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের ন্যায়সঙ্গত সমাজব্যবস্থার দ্বারা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে প্রবেশ করতে হবে, যাতে করে সমাজের মানুষের জন্য তৈরিকৃত সুযোগগুলোতে সবাই সমান সুফল ভোগ করতে পারে।
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকে টেকসই করার জন্য সব সুযোগ-সুবিধা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দ্বারগোড়ায় পৌঁছাতে হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(১) এবং ২৮(৪) নং অনুচ্ছেদে সবার জন্য সমান অধিকার ও সুযোগের কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে পিছিয়ে থাকা এই জনগোষ্ঠী চরম বৈষম্যের শিকার হয়। বিভিন্ন কারণে পিছিয়েপড়া বৃহৎ এই জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করাতে হলে এবং উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসতে হলে চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সমগ্র বিশ্বে এখনও অসংখ্য জনগোষ্ঠী প্রান্তিক জীবনযাপন করছে বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই সমাজ ও বৈষম্যহীন স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হলে এই জনগোষ্ঠীকে বিশেষ শিক্ষায় শিক্ষিত করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কর্মক্ষেত্রসহ সামাজিক সব ক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত প্রবেশগম্যতার অধিকার প্রদান করতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে পিছিয়েপড়া বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের মূলধারার কাজে অংশগ্রহণের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে।
প্রাথমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য আইন-প্রণয়ন ও তার কার্যকর প্রয়োগ ঘটাতে হবে। দেশের এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে রূপান্তর করার মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকারকে অবশ্যই তাদের প্রাধান্য দিয়ে কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিগণ সমাজের অংশ। তাদের মেধা, জ্ঞান, দক্ষতাকে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে পুঁজি হিসেবে বিনিয়োগ করতে হবে। ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমতায় প্রতিষ্ঠিত হোক আগামীর বৈষম্যহীন বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা। আমাদের দেশে জনসংখ্যা তখনই সম্পদে রূপান্তরিত হবে, যখন প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক চাহিদাগুলো যথাযথভাবে পূরণ করা যাবে। কিন্তু এ চাহিদাগুলো পূরণে এখনও বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষাব্যবস্থায় পরিকল্পনার অভাবে পুরো জনসংখ্যাকে কার্যকর জনসম্পদে পরিণত করা যাচ্ছে না। বৈষম্যের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হলে এ ঘাটতিগুলো দূর করা অপরিহার্য।
বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে জনসম্পদ তথা জনসম্ভাবনা হিসেবে গড়ে তুলতে হলে বিশাল আকারে যে মেধা পাঁচার হচ্ছে তার প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থার সব স্তরে বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আজকের এই বিশেষ দিনটিতে আসুন সবাই মিলে এমন একটি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি, যেখানে প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ থাকবে, অধিকার সমুন্নত থাকবে এবং টেকসই উন্নয়ন অর্জিত হবে। পরিকল্পিত জনব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ হয়ে উঠুক বিশ্ব জনসংখ্যয় একটি সুস্থ সমৃদ্ধ জাতি।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।