রাজধানী ঢাকার কলাবাগান এলাকা থেকে সাবেক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল (এএজি) টাইটাস হিল্লোল রেমার (৫৫) মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গত শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বাসা থেকে কলাবাগান থানা-পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। খবরটি নিয়ে গণমাধ্যমেও বেশ আলোচনা চলছিল। এই আইনজীবীর আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, ‘তিনি বেশ কিছুদিন ধরে বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন’।
টাইটাস হিল্লোল রেমার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির অন্তর্বর্তী কমিটির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস। তিনি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক লিখেছেন, ‘আর্থিক কারণে সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবীকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়, এটা আমি মেনে নিতে পারছি না। রেমা বেশ মেধাবী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অনুজ। সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।’
রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘আমি টাইটাস হিল্লোল রেমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, তার স্বামী বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন।’
অর্থনৈতিক দুরাবস্থায় ভোগার কারণে বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশনে দীর্ঘদিন থাকার কারণে আত্মাহুতি দেয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। নিজেকে কতটা অসহায় ও অকার্যকর মনে করলে একটা লোক এমনটা করতে পারে।
বিষয়টি জানতে পেরে আমি একটি ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। পোস্টটি হলো- ‘জীবিত অবস্থায় বিজ্ঞ আইনজীবীদের বেনাভোলেন্ড ফান্ডের টাকা উত্তোলনের ব্যবস্থা সংস্কার পূর্বক চালু করা সময়ের দাবি’। এই পোস্টে খুলনার ২১ ব্যাচের বন্ধুবর আইনজীবী মো. আশরাফুল ইসলাম একটি চমৎকার মন্তব্য করেছেন- ‘একমত পোষণ করি এবং এখন এটা সময়ের দাবি, কারণ কোনো সিনিয়র আইনজীবীর যদি কোনো উত্তরসূরি না থাকে এবং তার যদি কেউ দেখার লোক না থাকে তখন তিনি মৃত্যুর পর টাকা নিয়ে কি করবেন, আমার প্রস্তাব হচ্ছে ১০ বা ২০ বছর পেশার বয়স এরপর থেকে প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আইনজীবীকে দেয়া উচিত। কারণ ‘যার জীবন তার নিজের’।
জীবদ্দশায় আইনজীবীরা যেন বার কাউন্সিলের বেনাভোলেন্ট ফান্ডের সুবিধা পায় এ বিষয় হাইকোর্টে রিট আবেদন দাখিল হয়েছিল। এ বিষয়ে পত্রিকার খবরে এসেছে-‘জীবদ্দশায় আইনজীবীরা যেন বার কাউন্সিলের বেনাভোলেন্ট ফান্ডের সুবিধা পায় এই বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে মামলাটির কার্যক্রম আগামী ২ মাসের জন্য মুলতবি রেখেছেন আদালত। রোববার (২৮ জানুয়ারি) বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এসব আদেশ দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মদ আলী। তার সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার ইফতার উদ্দিন মাহমুদ, অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল, অ্যাডভোকেট জামিলা মমতাজ ও ব্যারিস্টার সাবিত এ খান। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুজ্জামান। বার কাউন্সিলের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার এসএম কফিল উদ্দিন।
শুনানিকালে বার কাউন্সিলের আইনজীবী আদালতকে বলেন, বিভিন্ন স্লটে ফি বাড়ানো হয়েছে। তাতে বার্ষিক মাত্র ৫০০ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। এতে করে কোনো আইনজীবী মারা গেলে তার পরিবার বেশি টাকা পাবেন না।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে বলেন, বিষয়টি বার কাউন্সিলের পলিসির ম্যাটার। তখন রিটকারীর আইনজীবী সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, ফি বৃদ্ধির বিষয়টি নবীন আইনজীবীদের জন্য কষ্টকর হবে।
তখন আদালত বার কাউন্সিলের আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, আইনজীবীরা মৃত্যু দাবি না রেখে জীবদ্দশায় যেন বেনাভোলেন্ট ফান্ডের সুবিধা পেতে পারে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কি না দেখুন।
রিটকারীর আইনজীবী বলেন, তাহলে চলতি জানুয়ারি মাসে ফি জমাদানের সময় বর্ধিত করা যায় কি না সেই বিষয়ে আদেশ চাই। তখন আদালত মৌখিকভাবে সময় শিথিল করার বিষয়টি বিবেচনার জন্য বলেন। একই সঙ্গে জীবদ্দশায় আইনজীবীরা যেন বার কাউন্সিলের বেনাভোলেন্ট ফান্ডের সুবিধা পায় এই বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা জানানোর জন্য মামলাটি আগামী ২ মাসের মুলতবির আদেশ দেন হাইকোর্ট।
এর আগে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল আইনজীবীদের বাৎসরিক নবায়ন ফি বৃদ্ধি করে। সে সিদ্ধান্তের বৈধতা প্রশ্নে আইনজীবীদের পক্ষে এবিএম বায়েজিদ রিটটি দায়ের করেন। (সূত্র: ২৮ জানুয়ারী, ২৪, বাংলা ট্রিবিউন)।
এছাড়াও আইনজীবীদের আর্থিক সহায়তায় গঠিত বেনাভোলেন্ট ফান্ডের অর্থ জীবিত থাকা অবস্থায় প্রদানের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৯ সেপ্টেম্বর) সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অশোক কুমার ঘোষ এ রিট দায়ের করেন। তিনি বলেন, রিট আবেদনটি আগামী সপ্তাহে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি হতে পারে। রিটে আইনজীবীদের মৃত্যুর পর আর্থিক সুবিধা প্রদান না করে জীবিত থাকা অবস্থায় বেনাভোলেন্ট ফান্ডের অর্থ প্রদানে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারির আর্জি জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান, আইন সচিব, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সম্পাদকসহ দেশের সব বারের সভাপতি সম্পাদককে রিটে বিবাদী করা হয়েছে।
রিট আবেদনে আরও বলা হয়েছে, আইনজীবীদের আর্থিক সুবিধা দেয়ার জন্য প্রত্যেক বারের বেনাভোলেন্ট ফান্ড গঠন করা আছে। মৃত্যুর পর সেই ফান্ড থেকে আইনজীবীদের আর্থিক সুবিধা দেয়া হয়। তবে মৃত্যুর পর বেনাভোলেন্ট ফান্ডের অর্থ দিয়ে কী হবে? অথচ জীবদ্দশায় একজন আইনজীবী অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে পারছেন না, পরিবার-পরিজন নিয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন। তাই রিটে আইনজীবীদের জীবদ্দশায় বেনাভোলেন্ট ফান্ডের সুবিধা প্রদানের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
সে কারণেই প্রয়োজনীয়তা থাকলে বার কাউন্সিলের গঠনতন্ত্র সংশোধনের বিষয়েও রিটে আর্জি জানানো হয়েছে। প্রসঙ্গত, এর আগে একই বিষয়ে গত ১৬ জুন বার কাউন্সিলকে আইনি নোটিশ দিয়েছিলেন রিটকারী আইনজীবী। তবে সে নোটিসের জবাব না পেয়ে তিনি রিট দায়ের করেন। (সূত্র: ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১, বাংলা ট্রিবিউন)। আইনজীবীদের সনদ প্রদান ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছিল আইনজীবীদের বেনাভোলেন্ট ফান্ড বৃদ্ধি করে দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্ত। সেই হিসেবে আইনজীবীদের মৃত্যুদাবি সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। বেনাভোলেন্ট ফান্ড দ্বিগুন হলেও জীবদ্দশায় সে আর্থীক সুবিধা আইনজীবীরা পাবে না, পাবে মৃত্যুর পর ওই আইনজীবীর ওয়ারেশগণ বা নমিনিরা। আইনজীবীদের কল্যাণে বেনাভোলেন্ট ফান্ড। এই ফান্ডের টাকা বার কাউন্সিলের নিয়ম অনুযায়ী একজন আইনজীবীর মৃত্যুপরবর্তীতে তার ওয়ারেশ নমিনিরা পাবে। এই নিয়মটি বর্তমানেও বহাল আছে। আইনজীবীদের কল্যাণার্থে এই ফান্ডের সুবিধা আইনজীবীর ওয়ারেশ বা পরিবার পেয়ে থাকেন। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীরা তাদের চাকরিকাল শেষ হলে অবসর ভাতা ও পেনশনের টাকা তুলে বাকি জীবন অতিবাহিত করে কিন্তু আইনজীবীদের বেলায় এটা ভিন্ন নিয়ম। জীবদ্দশায় তাদের আর্থীক সুবিধা পাবে না, এই আর্থিক সুবিধা পাবে তার পরিবার কিন্তু জীবদ্দশায় যে কতটা কষ্টে একজন সাধারণ আইনজীবীর জীবন কাটে তা একমাত্র ওই আইনজীবীই জানে। দেশে প্রায় ৭০ হাজার আইনজীবী আইন পেশায় থাকলেও আর্থিকভাবে কতজন সচ্ছল তা বলা বাহুল্য। চ্যালেঞ্জিং পেশায় টিকে থেকে সবার পক্ষে আর্থিক সচ্ছলতা আনা সম্ভব নয়। আর্থীকভাবে সাবলম্বী সামান্য কিছু সংখ্যক আইনজীবী আর বাকি সব পেশায় আছে কিন্তু মধ্যবিত্তের মতো দিন চালিয়ে যাচ্ছে। সব কুল-প্রতিকুলতার সাথে সেবা দিয়ে যাচ্ছে বিচারপ্রার্থীদের। আইনজীবীরা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য ভূমিকা পালন করে থাকে। বিচার বিভাগের দুটি ডানা একটা হলো বিচারক আরেকটা হলো আইনজীবীরা। বিচার বিভাগের অপর ডানা আইনজীবীরা আজ পদে পদে বৈষম্যের শিকার। যে আইনজীবীরা বিচারপ্রার্থীদের অধিকার রক্ষা, বৈষম্যের সমতা, দেশে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা, সংবিধান প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার নিশ্চিতে নিরলসভাবে আইনি সহায়তা দিয়ে চলেছে সেই আইনজীবীরাই আজ নিয়ম ও বৈষম্যের শিকার। তার মানে দাঁড়াল বাতির নিচেই অন্ধকার। সব নিয়ম ভাঙে নতুন ভালো নিয়মের প্রয়োজনে তাই আইনজীবীদের কল্যাণে যেহেতু বেনাভোলেন্ট ফান্ড তাই এই ফান্ডের অর্থ আইনজীবীরা যাতে তাদের জীবদ্দশায় ব্যবহার করে যেতে পারে সে বিষয় আইনজীবীদের সর্বমহলে দাবি উঠেছে। দেশের অনেক প্রবীণ আইনজীবী জীবনের শেষ বেলায় অর্থের অভাবে ভালো চিকিৎসা করাতে পারে না, ভালোভাবে সংসার চালাতে পারে না, কি নিদারুণ কষ্টে শেষ জীবনটা অতিবাহিত হয়। সব অনিয়মের বিরুদ্ধে আইনজীবীরা আইনি সেবা দিয়ে যায়। শেষ জীবনে আইনজীবীদের আর্থীক সুবিধাটি পেয়ে হতাশা, বিষণ্ণতামুক্ত জীবন কাটুক সে ব্যবস্থা হোক। তাই জীবদ্দশায় আইনজীবীদের বিভিন্ন স্লটে বেনাভোলেন্ট ফান্ডের সুবিধা ভোগের ব্যবস্থা দ্রুত চালু হোক, এটা আইনজীবীদের দীর্ঘ দিনের প্রাণের দাবি।
লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট, জজ কোর্ট, খুলনা।