বিশ্বের অন্যতম সর্বাধুনিক প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক যখন প্ল্যাটফর্মে ঘোষণা করলেন, তিনি গঠন করে ‘আমেরিকা পার্টি’- তখন গোটা বিশ্ব থমকে গেল। একটি প্রযুক্তির জাদুকর, যিনি টেসলা, স্পেস-এস্ক এবং নিউরালিঙ্কের মতো ভবিষ্যতের দিগন্তে নজর রেখেছেন, কেন হঠাৎ করেই রাজনীতির ময়দানে প্রবেশ করলেন? তার উত্তরে তিনি দিয়েছেন স্পষ্ট বার্তা- গিভ ইউর ব্যাক, ইউর ফ্রিডম। প্রযুক্তি এবং রাজনীতির সেতুবন্ধন আজকের বিশ্বে প্রযুক্তি আর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া আলাদা ধারণা নয়; বরং তারা একে অন্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ডিজিটাল গণতন্ত্র, সোশ্যাল মিডিয়া, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার একদিকে যেমন ভোটারদের কাছে সরাসরি পৌঁছানোর মাধ্যম তৈরি করেছে, তেমনি অন্যদিকে তা রাজনৈতিক ভ্রান্তি ও বিভাজনের কারণও হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে একজন প্রযুক্তিবিদ যখন রাজনৈতিক দল গঠন করেন, তা নিছক রাজনৈতিক পদক্ষেপ নয়- এটি প্রযুক্তি ও রাজনীতির সংমিশ্রণের একটি নতুন অধ্যায়। ‘আমেরিকা পার্র্টি’ মধ্যপন্থা বনাম দ্বিদলীয় রাজনৈতিক প্রাচীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলই শাসন করেছে। তাদের মধ্যে দুইপক্ষীয় মেরুকরণ, রাজনৈতিক আবর্জনা ও কর্পোরেট প্রভাব বেড়েই চলছে। এই অবস্থায় মধ্যপন্থি ভোটারদের এক নতুন রাজনৈতিক বিকল্প দিতে চাইছে। এই দলটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৮০ শতাংশ মধ্যপন্থিদের প্রতিনিধিত্বের আশা করে, যারা বর্তমান রাজনৈতিক উত্তেজনা ও বিভাজনে ক্লান্ত। তারা চায় এমন রাজনৈতিক পরিবেশ, যেখানে মতের ভিন্নতা সত্ত্বেও স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার রক্ষিত থাকবে। মাক্স এই বিষয়টি বারবার তুলে ধরেছেন এবং তার দলের মূলমন্ত্রে তা প্রতিফলিত হয়েছে। প্রতিবন্ধকতা ও বাস্তবতার মুখোমুখি তবে পথ সুগম নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনব্যবস্থা ইউনার টক অল তৃতীয় পক্ষের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। আইনগত জটিলতা, নিবন্ধন প্রক্রিয়া, নির্বাচনি বোর্ডের অনুমোদন- সবই কঠিন বাধা। সর্বোপরি, মাস্কের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সীমিত, যা দলের দীর্ঘমেয়াদি সফলতার জন্য উদ্বেগের কারণ। রাজনৈতিক নেতার ধারাবাহিকতা, কর্মীসংগঠন, সামাজিক নীতি ও কূটনৈতিক দক্ষতা ছাড়া সফল হওয়া কঠিন। এ ছাড়া তার ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের মাঝে বিতর্ক ও আবেগপ্রবণ টুইটগুলো জনমতের আস্থায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কর্পোরেট দুনিয়া থেকে এই রাজনৈতিক যাত্রা সহজ নয়। এরইমধ্যে টেসলা ও স্পেসএস্কের সঙ্গে যুক্ত বাজার ও বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন। কিছু বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান টেসলাভিত্তিক ইটিএফ স্থগিত করেছে, যা স্পষ্ট সংকেত দেয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আর্থিক প্রভাব কতটা গভীর।
বিশ্বজনীন প্রেক্ষাপটে আমেরিকা পার্টি তাৎপর্য : মার্কিন রাজনীতি শুধু আমেরিকার জন্যই নয়, পুরো বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একটি শক্তিশালী প্রযুক্তি উদ্যোক্তার রাজনৈতিক পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রযুক্তি ও গণতন্ত্রের নতুন সংলাপ সৃষ্টি করবে। বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে প্রযুক্তির ব্যবহার ও রাজনৈতিক দল গঠনের মধ্যে সংযোগ বাড়ছে। হতে পারে এর দৃষ্টান্ত, যেখানে প্রযুক্তি নেতৃত্বের সঙ্গে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সংমিশ্রণ ঘটবে।
ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ : তৃতীয় দলের সংগ্রাম ইতিহাস সাক্ষী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রস পেরো, ফরওয়ার্ড পার্টি, রিফর্ম পার্টির মতো তৃতীয় পক্ষের রাজনৈতিক দল দীর্ঘমেয়াদে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। আর্থিক চাপে, ভোটব্যবস্থার জটিলতায় এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অভাবে তারা ধীরে ধীরে বিলীন হয়েছে। এই ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তবে তার প্রচুর আর্থিক সম্পদ, সামাজিক মিডিয়া দক্ষতা এবং জনমতের প্রতি গভীর নজর এই দলকে স্বল্প সময়েই অগ্রগামী শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে পারে। সম্ভাবনা ও বাস্তবতার একঝাঁকানি। আমেরিকা পার্টি আজ শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দল নয়, একটি ধারণা, একটি প্রত্যাশা। এটি প্রযুক্তির শক্তি এবং গণতন্ত্রের আদর্শকে একত্রিত করার চেষ্টা। তবে এটি সফল হবে কি না, তা নির্ভর করবে : আইনি ও প্রশাসনিক প্রস্তুতির ওপর, দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দলীয় কাঠামোর ওপর, জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের ওপর। যদি মাস্ক এই তিনটি শর্তপূরণ করেন, তাহলে আমেরিকা পার্টি মার্কিন রাজনীতিতে একটি যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে। অন্যথায়, এটি থেকে যেতে পারে শুধু একটি আলোচিত রাজনৈতিক পরীক্ষা, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয়।
সমগ্র বিশ্বের জন্য শিক্ষা গণতন্ত্র ও প্রযুক্তির এই অদ্ভুত সেতুবন্ধন আজকের বিশ্ব রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। একজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তার রাজনৈতিক যাত্রা সেই পরীক্ষার প্রতীক। আমাদের সবাইকে নজর রাখতে হবে, কারণ এখানে লেখা হবে আধুনিক গণতন্ত্রের নতুন অধ্যায়।
লেখক : সমাজকর্মী ও শিক্ষার্থী ফুলছড়ি সরকারি কলেজ, জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা, বাংলাদেশ।