ঢাকা সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সততার শত্রু সমাজ : ঘুষ, গ্লানি ও গহনার প্রতাপ

রাজু আহমেদ
সততার শত্রু সমাজ : ঘুষ, গ্লানি ও গহনার প্রতাপ

পিওনের পাঁচ-সাতটা বাড়ি, ঘরে গহনা ভর্তি নারী এবং ব্যাংকে অঢেল টাকাকড়ি- এই সমাজে বিরল? আমলার দুশ্চিন্তার সারি, আল্লাহ কীভাবে দেব এ মাস পাড়ি এবং সমাজ মারে টিটকারি- সততার এমন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারীকে চেনেন না? সমমর্যাদা চাকরি করে একজনের রাজকীয় হালহকিকত, আভিজাত্যপূর্ণ চালচলন কিংবা নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড়; আরেকজনে মাসের দুই মাথায় টানাটানি দেখে বউ মারে খোঁচা! ব্যাটা ঘরেও পারে না, বাইরেও পারে না! সমাজের অসুস্থতা সয়ে সয়ে সৎ মানুষ যাবে কোথায়? একই চাকরি- কারো বাড়ি-গাড়ি, আর কারো মাস শেষের আগেই পকেট খালি- আছে না? অহরহ আছে, অনেকেই আছে। সমাজ ঘুষ-দুর্নীতিকে মোটামুটি স্বীকৃতি দিয়েছে! বেতন কত এটা চাকরিজীবীর বাবা-ভাই, পরিবার-স্বজনকে ভাবায় না। উপরি কামাই কত- তা দেখে লোকে জামাই বানাতে উঠেপড়ে লাগে। যে কর্মে পাওয়ার প্র্যাকটিসের সুযোগ যত বেশি, সেখানে দুর্নীতির মূল তত গভীরে। বাবা ছেলেকে জিজ্ঞেস করে না- এতো অর্থবিত্তের মালিক কীভাবে হলে! স্ত্রী-স্বামীর কাছে জানতে চায় না- বাজার থেকে এতোসব কী দিয়ে কেনো? বরং চাহিদা তড়তড় করে বাড়ে। সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য, নিজেদের আরামণ্ডআয়েশের জন্য রাষ্ট্রের ভিত লোপাট করে দেওয়া হয়। বেতনের বাইরে পিওনের ২৫ টাকা এবং বসের হাজার টাকা দুটোই ঘুষ, দুটোই অন্যায়। অথচ মানুষকে জিম্মি করে লাখ লাখ, কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া সাধু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

একই গ্রেড অথচ কতিপয় চাকরিকে কেন্দ্র করে সমাজ-রাষ্ট্রে হাইপ এতো উচ্চতর কেনো? বেতনের আকর্ষণে? সামাজিক মর্যাদায়? ক্ষমতা অনেকেই ভালোবাসে। দায়িত্বকে যারা ক্ষমতা মনে করে তারা ন্যায়কে মমতা দিয়ে আগলে রাখে না।

সমাজে সৎ মানুষ যেমন আছে, লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কেনার সামর্থ্যবানদেরও অভাব নেই। চাকরিজীবীর দুর্নীতি যত সহজে চোখে পড়ে, মজুদদার ব্যবসায়ীর, চাঁদাবাজ রাজনীতিবিদের কিংবা সুদখোর মহাজনদের অন্যায় তত প্রকটভাবে চোখে লাগে না। তবে সমাজের কোনো একটা অংশ আংশিকভাবে পচে না। যখন পচন ধরে তখন সমাজের সর্বস্তরের পচন থেকে গন্ধ বের হয়। একজন দুর্নীতিবাজ পুলিশের চেয়েও একজন নীতিহীন শিক্ষক সমাজের আরও বড় ক্ষতির কারণ।

একজ আমলার বিবেক পচে যাওয়ার চেয়েও একজন ইমামের নৈতিক পদস্খলন সমাজকে বেশি দুষিত করে। যারা মানুষ গড়ে, যারা ন্যায়পরায়ণ হতে বলে- তাদের মধ্যে গলদ মানে প্রজন্মের পর প্রজন্মের বিপথগামী হওয়া। দুর্নীতি সর্বগ্রাসী। যারা সৎ এই সমাজে তারা প্রায় বিপন্ন। ভোগবাদী মানসিকতা বিবেকের পচনকে দীর্ঘায়িত করছে। সুখী মানুষের মত সৎ মানুষের জামা সংগ্রহ করতেও অভিযান চালাতে হবে। অথচ হাটে ঘাটে ধর্মের আলোচনা, সংসদে-অফিসে শুদ্ধাচারের বয়ান এবং মসজিদে মসজিদে নীতি-নৈতিকতার নসিহা- এ জাতিকে শুদ্ধ করার কথা ছিল। মুখে সাধুতা থাকলে, অন্তরে তো ঘাপলা দেখি। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি এবং লুটপাট কমছে না, বরং বাড়ছে। দুর্নীতিবাজরা সমাজের সামনের সারিতে চলে আসছে। সৎ ও সততায় জীবন-জীবিকা পরিচালনাকারীদের প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জিং জীবন পার করতে হচ্ছে। রাষ্ট্র ও আইনের কঠোর রীতি দুর্নীতি লাঘবে ততক্ষণ পুরোপুরি কাজ করবে না, যতক্ষণ সমাজ অন্যায়কে সর্বজনীনভাবে প্রত্যাখ্যান না করে। পরিবারের সদস্য বাড়তি অর্থকে নিরুৎসাহিত না করলে, অফিসে ঘুষের মাত্রা নিম্নমুখী হবে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ঘুষ গ্রহণ কারও কারও রক্তে মিশে গেছে। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া এখন জাতীয় চরিত্রে। শুধু ঘুষগ্রহীতাকে দোষ দিচ্ছি কেন? বরং ঘুষদাতাও ঘুষদানে যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে, স্বার্থ উদ্ধারে যেভাবে পারছে, সে পথেই হাঁটছে। মানুষের ধৈর্য কমে যাচ্ছে।

ডাক্তারের সিরিয়ালে রোগী, এমনকি দাফনেও লাশের সঙ্গী- ঘুষ দিয়ে তার কাজ আগে করিয়ে নিচ্ছে। উত্তরণের উপায় কী? সমাজের অসুস্থ প্রতিযোগিতা থামাতে হবে। রাষ্ট্র এটা থামাতে পারবে? রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে যুক্তদের সৎ হতে হবে। সমাজ থেকে একটা প্রজন্ম বের হতে হবে- যারা প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে। ধর্ম যাদের কাছে জিম্মি, রাজনীতি যাদের করতলগত এবং অফিস-আদালতে প্রচলিত যে রেওয়াজ, তা বন্ধ করতে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের সামনে একটা সুযোগ এসেছিল, কিন্তু হযবরল আরও বেড়েছে। যে যেভাবে পারছে আখের গুছিয়ে নিচ্ছে।

অন্যের কাজ কারবার দেখে মনে হয়- এই দেশটা তাদের না! তবে আশা রাখি, নতুন ভোরের সূর্যোদয় হবে। ধীরে আসুক, তবুও পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই আসুক। ঘুষ-দুর্নীতি, অন্যায় এবং কুণ্ডরীতি চিরকাল চলবে না। কোথাও না কোথাও, কারো না কারো কাছে এটা বাধাপ্রাপ্ত হবে। আমাদের হয়তোবা শেষ বিচারের দিন পর্যন্তই অপেক্ষা করতে হবে! দুর্নীতির করালগ্রাসে আজ সৎ মানুষ যেন কোণঠাসা। অথচ কোনো জাতির টিকে থাকা, মর্যাদা অর্জন কিংবা উন্নতির মূলে থাকে চরিত্রবান নাগরিক। যে সমাজে অসৎ মানুষকে বীর আর সৎ মানুষকে নির্বোধ মনে করা হয়, সে সমাজ অন্ধকারে ডুবে যায় এক সময়।

দুর্নীতি কেবল অর্থ বা সম্পদের ক্ষতি নয়, এটি বিশ্বাস, ন্যায্যতা ও মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংসের ভয়ঙ্কর হাতিয়ার। তাই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সবস্তরে। মূল্যবোধের শিক্ষাই হতে পারে উত্তরণের পথ। হোক তা ধীর, তবু স্থায়ী হোক। যেন কোনো সততা আর গর্ব নিয়ে মাথা উঁচু করে না বলতে বাধে না- ‘আমি সৎ, আমি ঠিক কাজটাই করছি।’ পরিবর্তন আসবেই, যদি কিছু মানুষ এখনও বুক পেতে বলে, ‘না, আমি ঘুষ খাব না; অন্যায়ের সঙ্গে আপস করব না।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত