প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৪ জুলাই, ২০২৫
কৃত্রিম সাফল্যের মুখোশ সরিয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষায় উঠে এসেছে এক নির্মম বাস্তবতা। এটিই হতে পারে শিক্ষাকে রাজনীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ও মানবিকভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার একটি যুগান্তকারী সূচনা। ২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল আমাদের সামনে একটি কঠিন অথচ অপরিহার্য প্রশ্ন তুলে ধরেছে আমরা কি চাই শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মূল্যায়ন, না কি একটি সাজানো, চকমকে তথাকথিত সাফল্যের গল্প?
প্রায় ১৯ লাখ পরীক্ষার্থীর অংশগ্রহণ এবং তার মধ্যে প্রায় ৬ লাখের অকৃতকার্যতা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গভীর সংকটের একটি স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এই ফলাফলের মাধ্যমে একটি বড় ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে এবার আর ফলাফলকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বা সামাজিক ইভেন্টে পরিণত করা হয়নি। বরং, ফলাফল হয়েছে বাস্তবতানির্ভর, নৈতিক ও পেশাদার মূল্যবোধের প্রতিফলন।
রাজনীতিমুক্ত শিক্ষা প্রশাসন সময়ের দাবি পূরণে সাহসী পদক্ষেপ : দীর্ঘদিন ধরে বোর্ড পরীক্ষার ফলাফল ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ফেইস সেভিং’ সংস্কৃতি দৃঢ়মূল হয়েছিল। সেখানে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত অর্জনের চেয়ে প্রশাসনিক ভাবমূর্তি রক্ষা এবং সমালোচনার ঝুঁকি এড়ানোই ছিল মুখ্য বিবেচ্য বিষয়। ফলে ফলাফলের বাস্তবতা ধামাচাপা পড়ে যেত পরিসংখ্যানগত সাজসজ্জার নিচে। গুণমানের চেয়ে গ্ল্যামার হয়ে উঠেছিল সাফল্যের প্রধান মানদ-। তবে ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল সেই বহুলচর্চিত ভ্রান্ত ধারা থেকে এক দৃশ্যমান প্রস্থান ঘটিয়েছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যে পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছে, তা সত্যিকার অর্থেই প্রশংসার দাবিদার। প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি ছাড়াই ফল প্রকাশ, নির্বিচারে নম্বর প্রদান এবং পাসের হার বাড়াতে কোনো প্রকার কৃত্রিম হস্তক্ষেপ না করা, এসবই একটি গঠনমূলক ও নীতিনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত দেয়। এই প্রক্রিয়াগত পরিবর্তন নিছক ব্যতিক্রম নয়; বরং একটি নতুন নীতিগত মানদ-। যদি এই ধারা অব্যাহত রাখা যায়, তবে এটি ভবিষ্যতের শিক্ষানীতি প্রণয়নে একটি ইতিবাচক মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।
সাজানো সফলতা থেকে সরে এসে বাস্তবতার সামনে : জাতি কি তৈরি ছিল এই মুখোমুখির জন্য? : দীর্ঘদিন ধরে ফলাফলের মাধ্যমে ‘সাফল্যের গল্প’ বানানো হয়েছে। একেক বছর জিপিএ-৫ এর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা অর্জনের এক গোপন কৌশল হিসেবে। এমনকি ২০২০ সালে করোনাকালে অটোপাস সংস্কৃতিও শিক্ষা-জগতে বিতর্ক তৈরি করেছিল। তখন বলা হয়েছিল, ‘শিক্ষার্থীদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত’। কিন্তু সেই সুবিধাভোগী প্রজন্ম যখন ২০২৫-এ এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিল, বাস্তবতার সঙ্গে তাদের দূরত্বটা চরমভাবে প্রকাশ পেল।
আমরা দেখতে পেলাম, একদিকে সরকারি কলেজগুলোর গুটিকয়েক সাফল্য, অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক বিদ্যালয়ের ফলাফল বিপর্যয়। এখানেই প্রশ্ন আসে আমরা কি এসব শিক্ষার্থীর প্রকৃত প্রস্তুতির জন্য কাজ করছিলাম, নাকি কেবল সাফল্যের ‘ছবি’ আঁকছিলাম?
ফলাফল নয়, শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে : প্রায় ছয় লাখ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়া কোনো একদিনের পরিণাম নয়; বরং এটি দীর্ঘদিনের শিক্ষাজীবনের সংকটের প্রতিফলন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের শিক্ষা কার্যক্রম, পরিবেশ এবং সুযোগ-সুবিধা ছিল অনুপযুক্ত ও অসম্পূর্ণ। শিক্ষাজীবনের প্রতিটি পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে দক্ষ ও অনুপ্রাণিত শিক্ষক, আধুনিক ও মানসম্মত পাঠ্যবই, বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ (প্র্যাকটিক্যাল লার্নিং), পাশাপাশি পর্যাপ্ত অনুশীলন ও সুশৃঙ্খল মূল্যায়ন প্রক্রিয়া। কিন্তু এই মৌলিক উপাদানগুলো বহু ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকায় শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতির মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে, যা তাদের বর্তমান অবস্থানের মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত। ফলাফল শুধুমাত্র পরীক্ষার একটি বহিরাবরণ, একটি চিত্রমাত্র। কিন্তু সেই চিত্রের গভীরে নিহিত রয়েছে একটি দীর্ঘমেয়াদি ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা। এই দুর্বলতার শিকলে বাধা পড়েছে কোটি কোটি শিক্ষার্থী, যারা ততদিন পর্যন্ত তাদের স্বপ্ন ও সামর্থ্য বিকশিত করার পূর্ণ সুযোগ পায়নি।
প্রতিটি অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর পেছনে একটি ভেঙে পড়া বিদ্যালয়ের ছবি দেখতে পাওয়া যায় যেখানে হয়তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামো পুরোনো, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপ্রেরণার অভাব, কিংবা এমন পরিবেশ যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রেরণা পাচ্ছে না তাদের প্রতিভা বিকাশের জন্য। অতিরিক্তভাবে, অনেক শিক্ষার্থী আজকাল বাহ্যিক গাইড বা টিউটরদের ওপর এতটাই নির্ভরশীল, যে তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাঠ্যবই থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। পাঠ্যবইয়ের প্রতি বিমুখতা এবং ক্লাসরুমে সক্রিয় অংশগ্রহণের অভাব তাদের শিক্ষাগত দক্ষতাকে হ্রাস করেছে। শিক্ষার্থীদের মনোবল ও আগ্রহ কমে যাওয়ার পেছনেও রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ অনুপ্রেরণার অভাব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সৃজনশীলতা, উৎসাহ এবং সমর্থন সৃষ্টির পরিবর্তে একটি রুটিনভিত্তিক, প্রতিযোগিতামূলক ও চাপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে এবং তাদের শিক্ষায় মনোযোগ হারাচ্ছে।
এই অবস্থায়, শুধু ফলাফল দেখে দোষারোপ বা হতাশায় ডুব দেওয়া যথার্থ হবে না। বরং এই সংকটের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমাদের অবশ্যই শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক স্তর থেকে সংস্কার ও পুনর্গঠন করার দায়িত্ব নিতে হবে। এখনই সময় যেখানে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পাঠ্যবই উন্নয়ন, শিক্ষার পরিবেশ এবং অনুপ্রেরণামূলক ক্লাসরুম সংস্কৃতি গড়ে তোলার মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষার্থীর পক্ষে শিক্ষার মান নিশ্চিত করা হবে।
শিক্ষার্থীর সফলতা একটি সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিবিম্ব। তাই তাদের অকৃতকার্যতা কেবল ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং আমাদের সামাজিক ও শিক্ষানীতিগত ত্রুটির সংকেত। এই সংকেতগুলোকে গভীরভাবে মূল্যায়ন করে দ্রুত প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আগামী প্রজন্মের শিক্ষার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
জিপিএ-৫, সম্মান নাকি সামাজিক যন্ত্রণা? : অতীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সাফল্য প্রমাণের জন্য অহেতুক জিপিএ-৫ অর্জনের দিকে দৌড়েছে। অভিভাবকরাও সন্তানকে এই দৌড়ে ঠেলে দিয়েছে। ফলাফল : মানসিক চাপ, আত্মহত্যার ঘটনা, এবং জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা একটি কিশোর প্রজন্ম। এবার ফলাফল কম হলেও মিথ্যা প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। একটি সন্তান যদি জিপিএ-৪ পায়, তবুও সে যদি প্রকৃত শিক্ষায় দক্ষ হয়, তাহলেই জাতির জন্য সম্পদ।