ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পিছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্পেসএক্স ও টেসলার প্রধান নির্বাহী ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এর মালিক ইলন মাস্কের যে একটি শক্তিশালী যোগসূত্র রয়েছে- সেটি এখন সর্বজনবিদিত। দুইজনের প্রগাঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই জনগণ নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচনের পরেও দেখেছে। তবে সেটি এখন নিকটাতীত এবং সেই সম্পর্কও। ঘনিষ্ট বন্ধু থেকে তারা এখন প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার পথে। হতে পারে এই নির্বাচনে ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় সহায়ক ভূমিকা পালনকারী এই ইলন মাস্কই ট্রাম্পের আগামী নির্বাচনের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ালেন! যদিও নির্বাচন এখনও অনেক দূর। সপ্তাহ খানেকের ব্যবধানে ট্রাম্প এবং ইলন মাস্কের মধ্যে দূরত্ব এতটাই বেড়ে গেছে যে, এখন উভয়ই চলেছেন উল্টো পথে। এই ঘটনার তিক্ততা এতদূরে পৌঁছেছে যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সেটি ছড়িয়েছে। আগামী নির্বাচনের আগে আরও অনেক ঘটনা দুর্ঘটনাই ঘটবে। সব যে বিপক্ষে যাবে এমনটাও নয়। আবার এই পরিস্থিতির যে উন্নতি ঘটবে না, সেটিও নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিন্তু আপাতত দুজনের পথ দুইদিকে। শুরু হয়েছে দুই মিত্রের রেষারেষি। এই রেষারেষি প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে চিরায়ত রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট রাজনীতিতেও। এর প্রধান কারণ মূলত মানুষটির নাম ইলন মাস্ক এবং এই মানুষটিই গত নির্বাচনে ট্রাম্পকে বিজয়ী হতে জোড়ালো সহযোগিতা করেছেন। তা সে যে কোনো কারণেই হোক।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দ্বন্দ্বের মধ্যেই ‘আমেরিকা পার্টি’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করলেন মাস্ক। এর আগে তিনি এক্সে একটি জনমত জরিপ চালান। দলটি গঠনের পর তিনি লিখেন, ‘আমেরিকা পার্টি’র জন্ম হলো- আপনাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। এখানে বলাইবাহুল্য যে, এই স্বাধীনতা খর্ব বলতে তিনি ট্রাম্পের আমেরিকাকেই বোঝাতে চাচ্ছেন। মাস্কের এই ঘোষণা এমন এক সময়ে এলো যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বহুল প্রচারিত ‘বিগ অ্যান্ড বিউটিফুল’ কর ছাড় এবং ব্যয়বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিলে স্বাক্ষর করেছেন যা মাস্কের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়ে। মাস্ক নির্বাচনে ট্রাম্পকে বিজয়ী করতে শত শত মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ‘সরকারি ব্যয় দক্ষতা বিভাগ’-এরও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
‘বিগ অ্যান্ড বিউটিফুল সম্পর্কে মাস্ক বলেন, ‘বাইডেনের আমলে যেখানে ঘাটতি ছিল ২ ট্রিলিয়ন ডলার, এখন সেই ঘাটতি বাড়িয়ে ২.৫ ট্রিলিয়ন করা হচ্ছে। এতে আমেরিকা দেউলিয়া হয়ে যাবে। সাবেক বন্ধুর এই ভূমিকায় স্বভাবতই ট্রাম্প খুশি নন। বরং বিরক্ত। মাঝেমধ্যে হুমকিও দিচ্ছেন। ট্রাম্প এরই মধ্যে হুমকি দিয়েছেন যে, মাস্কের কোম্পানিগুলো যেসব সরকারি ভর্তুকি পায়, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। অন্যদিকে মাস্ক ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি এমন সব কংগ্রেস সদস্যদের বিরুদ্ধে অর্থ ব্যয় করবেন যারা ট্রাম্পের বিলকে সমর্থন করেছে। আর এনবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, মাস্ক যদি ডেমোক্রেট প্রার্থীদের জন্য অর্থায়ন করেন, তবে তাকে খুবই গুরুতর পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে।
২০২৬ সালেই দেশটিতে মধ্যবর্তী নির্বাচন। মধ্যবর্তী নির্বাচনের ইতিহাস বলছে বিপুল ভোট নিয়ে ক্ষমতায় আসার পরেও মধ্যবর্তী নির্বাচনে আগের সেই জনপ্রিয়তার ছাপ পাওয়া যায় না। বরং কিছুটা নড়বরে অবস্থায় থাকে জনপ্রিয়তা। মাস্কের সঙ্গে এই দ্বন্দ্বের ফলে এই জায়গায় আরও বেশি ঝুঁকিতে পরতে পারে দলটি। কারণ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা ট্রাম্পের সময়ে মাস্ক ভালোভাবেই রপ্ত করেছে। যদিও মুখে মাস্কের নতুন এই দল গঠনের পদক্ষেপকে ‘হাস্যকর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রে ১৬০ বছর ধরে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট এই দ্বিদলীয় কাঠামো বেশ শক্তিশালীভাবে চলে আসছে। তৃতীয় শক্তি মাঝেমধ্যে আলোচনায় থাকলেও কোনো প্রভাব ফেলে না। জনগণ এতেই অভ্যস্থ। কিন্তু মাস্ক সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছে। মাস্ক এক্সে লিখেছেন, ‘আমরা যেভাবে ‘ইউনিপার্টি’ ব্যবস্থাকে ভাঙব, তা হলো- গ্রিক কৌশলবিদ এপামিনোনডাস-এর মতো: নির্দিষ্ট এক জায়গায় তীব্র ও কেন্দ্রীভূত আঘাত।’ নির্বাচনের পর থেকে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তাও আগের মতো নেই।
যদিও এখনই ভয়ের জায়গায় নেই। তবে কমেছে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে দুশ্চিন্তার ব্যাপারই বটে। ডেমোক্র্যাটরা শক্তিশালী হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক একটু ভিন্ন মোড় পেয়েছে। সেটি এমন যে যারা এতদিন যুক্তরাষ্ট্রকে একদম কাছের বন্ধু হিসেবেই মনে করেছে তারাও এখন ভাবছে যদি বন্ধু দেশ কাছে না থাকে সেক্ষেত্রে নিজেদের সক্ষমতা অর্জন করা যায় কীভাবে? যুক্তরাষ্ট্র এখন নিজের ঘর সামলাতে বেশি ব্যস্ত। নিজেদের অর্থনীতি নিয়েও ভাবার বিষয় রয়েছে। অথচ বেশ জোরেসোরেই ক্ষমতায় এসেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। চার বছর পর আবার বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে তিনি ফিরেছেন ওয়াশিংটনে ক্ষমতার মসনদে। নিজের বিজয়ের ব্যাপারে প্রথম থেকেই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন এই প্রেসিডেন্ট। এর মধ্যেই ইরানের বিরুদ্ধে নিজেদের বিমান দিয়ে পরমাণু স্থাপনায় হামলা করে সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়। যদিও এরপরপরই বিরতি কার্যকর হয়। তবে পরমাণু ইস্যুতে কঠোর অবস্থানের বিষয়টি এখন পরিষ্কার। শুল্ক নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে ব্যাপক শোরগোল তৈরি হয়েছে সেটিও ট্রাম্পের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। মধ্যপ্রাচ্য সফর করে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র বিক্রির চুক্তিও করেছেন। ট্রাম্পের সবথেকে বড় হুমকির বার্তা হল তিনি মাস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের চুক্তি বাতিল করার কথা বলেছেন। যদিও এটি একটি হুমকি এবং কার্যকর হবে বা হবে না সেটি আরও কিছুদিন পর বোঝা যেতে পারে। অর্থাৎ সম্পর্ক ঠিক কি অবস্থায় পৌঁছায় তার ওপর নির্ভর করবে এই নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারটা। সরকারের সঙ্গে মাস্কের আনুমানিক ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলার মূল্যের চুক্তি রয়েছে। এর বড় অংশ যুক্ত মাস্কের স্পেসএক্স কোম্পানির সঙ্গে। ফলে চুক্তি বাতিল হলে আপাতদৃষ্টিতে স্পেসএক্সের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়তে পারে। যদিও এটি ট্রাম্পের ফাঁকা হুমকিও হতে পারে। স্পেসএক্সের ড্রাগন স্পেসক্রাফট আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে মানুষ ও মালামাল পরিবহন করছে। সেখানে নাসার তিনজনকে সম্প্রতি পাঠানো হয়েছে। ট্রাম্পের সবথেকে বড় হুমকির বার্তা হল তিনি মাস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের চুক্তি বাতিল করার কথা বলেছেন। এখানে সবথেকে বড় বিষয় হলো ট্রাম্পকে এখন ঘরে মানে নিজের দেশে এবং বাইরে অর্থাৎ আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিপক্ষ দেশগুলোর সাথে মোকাবেলা করতে হবে। এটা সত্যিকার অর্থে চ্যালেঞ্জিং হবে। এই ঘটনার পেছনের কারণ খুঁজতে শুরু করেছেন অনেকেই। কারণ হিসেবে আবার কেউ কেউ ষড়যন্ত্র তত্ত্বও সামনে আনছেন। বলছেন,এটা লোক দেখানো। আবার এর কারণ হিসেবে অনেকেই চীনকে টানছেন। চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টেসলা পিছিয়ে পরছে। চীন টেসলার একটি বৃহৎ বাজার। একদিকে চীন এবং অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, এই দুই দেশের শুল্ক আরোপের খেলায় উভয় দেশের প্রতিষ্ঠান জড়িয়ে গেছে। চীন চাইছে নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে আরও বেশি সুবিধা দিতে। ফলে টেসলার প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান যা চীনের সেটি যে বেশি সুবিধা পাবে সেটাই তো ঠিক। এদিকে ট্রাম্পের ঘোষিত সাম্প্রতিক ব্যয় সক্রান্ত বাজেট বিলে বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর ৭৫০০ ডলার কর ছাড়ের সুবিধাটি তুলে নেওয়ার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। চীনের বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে যতটা সম্ভব কম দামে বৈদ্যুতিক গাড়ি নিয়ে আসার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, তখন আমেরিকায় ৭৫০০ ডলারের কর সুবিধাটি বন্ধ করা হলে সবচেয়ে ক্ষতিগস্ত প্রতিষ্ঠানটির নাম যে হবে টেসলা তা-ও বেশ অনুমান করা যায়। নিজের প্রতিষ্ঠানের আগাম এই ক্ষতি দেখে মাস্ক যে চুপ থাকবেন না বা কাছের মানুষের কাছ থেকে এই সিদ্ধান্তের পর যে নিজের প্রতিষ্ঠানের পরিণতি দেখছেন, সেখান থেকেই এই দূরত্ব বলে অনেকের ধারণা। তবে কারণটা ব্যবসায়িক হওয়ার কথা। ইলন মাস্ক একজন দক্ষ ব্যবসায়ী। নিজের ব্যবসাটা ঠিক ভালোভাবেই বোঝেন এবং এই কারণেই তিনি আজকের মাস্কে পরিণত হয়েছেন। সেক্ষেত্রে সম্পর্কের বিষয়টির আগে নিজের প্রতিষ্ঠানই প্রাধান্য পাবে- এটাই তো স্বাভাবিক। যদি সেটাই হয় তাহলে খুব দ্রুতই স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই উভয়ের সম্পর্ক। আর নতুন দল করলেও একটি দ্বিদলীয় কাঠামো ভেঙে নতুন কোনো চমক দিতে পারেন কি না- সেটাই দেখার বিষয়।
প্রাবন্ধিক ও কলামিষ্ট