ঢাকা শনিবার, ০৯ আগস্ট ২০২৫, ২৫ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

প্রাথমিক বৃত্তি থেকে কেজি স্কুল বাদ কেন?

মো: শামীম মিয়া
প্রাথমিক বৃত্তি থেকে কেজি স্কুল বাদ কেন?

প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত- যেখানে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় কেজি স্কুল ও বেসরকারি শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে- তা একজন অভিভাবক হিসেবে আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে, ক্ষুব্ধ করেছে এবং প্রশ্নবিদ্ধ করেছে রাষ্ট্রের শিক্ষা-নীতিকে। আমি একজন সাধারণ নাগরিক, যার একমাত্র স্বপ্ন সন্তান যেন ভালো করে পড়ে, মানুষ হয়, নিজের পায়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আজ সেই স্বপ্নেই বৈষম্যের দেয়াল তুলে দিচ্ছে রাষ্ট্র।

আমার প্রশ্ন- আমি কেন সরকারি স্কুলে না পাঠিয়ে কেজি স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করিয়েছি?

উত্তর একটাই- সরকারি স্কুলে শিক্ষা নেই, শিক্ষক থাকলেও পাঠদানে উৎসাহ নেই, তদারকি নেই, জবাবদিহিতা নেই। বহু শিক্ষক নিজেদের সন্তানদের পাঠান না সরকারি স্কুলে। এই কথাটাই এক ভয়ংকর বাস্তবতা। একজন শিক্ষক যদি নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ তারই নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানে দেখতে না পান, তাহলে আমরা কিভাবে সেই প্রতিষ্ঠানে সন্তান রেখে নিশ্চিন্ত থাকব? এখানেই সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষা হচ্ছে আমাদের জাতি গঠনের মূল ভিত। সেই ভিত্তিই যদি দুর্বল হয়, তাহলে উপরতলার ভবিষ্যৎ ধসে পড়বেই। কিন্তু সেই দুর্বলতাকে ঢাকতে গিয়ে রাষ্ট্র এখন নতুন বৈষম্যের জন্ম দিচ্ছে- যোগ্য শিক্ষার্থীকে শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানভিত্তিক পরিচয়ের কারণে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এটি একপ্রকার রাষ্ট্রীয় অবিচার, যা ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক সংকেত।

আজ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শহর- প্রতিটি এলাকায় কেজি স্কুলগুলো তাদের স্বকীয়তা ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিশুদের মানসম্মত শিক্ষা দিয়ে চলেছে। তাদের রেজাল্ট ভালো, ক্লাসরুটিন মানা হয়, অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয়। অথচ সরকারি স্কুলে বছরের শুরুতে বই দিলেও অনেক সময় শিক্ষকই ক্লাস ঠিকমতো নেন না। তদারকি নামে আছে, বাস্তবে নেই। দুর্নীতি, দায়িত্বহীনতা, অনুপ্রবেশ- সব মিলিয়ে আজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মান নিয়ে সাধারণ অভিভাবকদের আস্থা নেই। সরকারের উচিত ছিল এই পরিস্থিতির মধ্যে প্রতিযোগিতার একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা। উচিত ছিল সরকারি স্কুলগুলোকে এমনভাবে চাপে রাখা, যাতে তারা কেজি স্কুলগুলোর চেয়ে ভালো ফল করে, অভিভাবকদের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনে। কিন্তু সেটা না করে আজ রাষ্ট্র উল্টো পথে হাঁটছে- যাদের মান ভালো, তাদের বাদ দিয়ে কৃত্রিমভাবে বিজয়ী সাজানো হচ্ছে। এটা শুধু বৈষম্য নয়, বরং শিক্ষা-নীতি নিয়ে এক ধরনের ব্যঙ্গ। আমি সরকারকে প্রশ্ন করতে চাই- বাচ্চাদের কী দোষ ছিল?

তারা তো শুধু পড়াশোনা করছে। তাদের মধ্যে কে সরকারি, কে বেসরকারি- এটা তো তাদের কোনো পরিচয় নয়। তাহলে কেন এমন সিদ্ধান্তে তারা ভুক্তভোগী হবে? নীতি-নির্ধারকরা কি সত্যিই ভাবেন, বৃত্তি পরীক্ষা শুধু সরকারি স্কুলের জন্য রাখলে সরকারি শিক্ষার মান বেড়ে যাবে? এটা ভাবা একেবারেই অজ্ঞতা। কারণ পরিবর্তন তখনই হয়, যখন প্রতিযোগিতা থাকে, জবাবদিহিতা থাকে, মানের বিচার থাকে। যদি সেই প্রতিযোগিতা থেকেই কেজি স্কুলগুলোকে বাদ দেওয়া হয়, তাহলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো স্বচ্ছন্দে আগের মতোই থাকবে- দায়িত্বহীন, দুর্বল, তদারকিহীন। ফলাফল? শিক্ষা থাকবে নামমাত্র, ভবিষ্যৎ থাকবে অনিশ্চিত। আমার মতো হাজারো অভিভাবক এখন প্রশ্ন করছেন- ‘আমরা সন্তানদের কোন শিক্ষাব্যবস্থায় রাখব?’ রাষ্ট্র যদি এই প্রশ্নের জবাব না দেয়, যদি সরকার এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে কোনো সদর্থক পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আস্থা হারাবে। আর এটা রাষ্ট্রের জন্য এক ভয়ংকর ভবিষ্যতের সূচনা।

সরকারের প্রতি অনুরোধ- বৈষম্য নয়, প্রতিযোগিতা আনুন। বাদ নয়, অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করুন। ছাঁকুন, বাছাই করুন; কিন্তু তার আগে সবার অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করুন। কোমলমতি শিশুদের হেয় করা নয়, তাদের মধ্যে থেকে সেরা তুলে আনুন ন্যায়ের ভিত্তিতে- Not by excluding others, but by including everyone. একজন সাধারণ অভিভাবক হিসেবে আমার একটাই দাবি- আমার সন্তানকে তার মেধার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করুন, তার স্কুলের নামের ভিত্তিতে নয়। এটা শুধু আমার দাবি নয়, দেশের কোটি কোটি শিশুর ন্যায্য অধিকার।

অভিভাবক

আমদিরপাড়া, জুমারবাড়ী,সাঘাটা,গাইবান্ধা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত