প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৯ আগস্ট, ২০২৫
পরমাণু বোমা আবিষ্কার হওয়ার পর থেকেই অন্য সব অস্ত্র যেন এর কাছে অসহায় হয়ে পরে। গুটিকতক দেশই পরমাণু বোমার অধিকারী এবং এই গুটিকতক দেশের পরমাণু হুমকিতেই পুরো বিশ্বকে তটস্থ থাকতে হয়। এই অস্ত্র ও এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আর রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে রয়েছে আইএনএফ চুক্তি। সম্প্রতি রাশিয়ার এই চু্িক্ত থেকে বের হয়ে আসার ঘোষণা রীতিমতো বিস্মিত করেছে বিশ্ববাসীকে এবং সেই সাথে আতঙ্কগ্রস্তও করেছে। গত কয়েক দশকে বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম সফল নিরাপত্তা উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি। যুদ্ধবিরতি ও পারমাণবিক সশস্ত্রতা হ্রাসে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছিল এটি। কিন্তু হঠাৎ করেই এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়ে বিশ্বকে অপ্রত্যাশিত সংকটে ফেলে দিয়েছে রাশিয়া। এতে শুধু পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বলই হয়নি, বরং পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ছে বলেই ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ১৯৮৭ সালে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় চুক্তিটি। এটি ৫০০ থেকে ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার পাল্লার ভূমি থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা বহালের ব্যাপারে সম্মতির গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
পৃথিবী এখন নিত্যনতুন অস্ত্রের হুংকারে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বড় শক্তিশালী দেশগুলো রীতিমতো ক্ষমতার প্রতিযোগীতায় লিপ্ত। ছোটদেশগুলোও নিজেকে যথাসম্ভব আধুনিক অস্ত্রে সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আর যত আধুনিক অস্ত্রের নামই আসুক পারমাণবিক বোমাকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি কোনো মারণাস্ত্রই। কারণ পৃথিবী এই অস্ত্রের বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছে। তাই পৃথিবী নিত্যনতুন অস্ত্রেসজ্জিত হলেও পারমাণবিক বেমার কথা আসলেই চোখের সামনে এক বিরাট ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র ভেসে ওঠে। কোনো যুদ্ধ শুরু হলেই সামনে আসে পারমাণবিক অস্ত্র ক্ষমতার কথা। এক তথ্যে জানা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মোট ৫ হাজার ৯৭৭টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে রাশিয়ার, যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রায় ৫৫০টি বেশি। বিশ্বে মোট পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রের ৯০ শতাংশেরও বেশি এই দুই দেশের কাছে আছে।
সুতরাং কোনোভাবে এর প্রয়োগ শুরু হলে পৃথিবীর অস্তিত্ত্ব যে থাকবে, না সেটা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই ধ্বংসক্ষমতা জানা সত্ত্বেও কেন একেবারে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়া যাচ্ছে না? এর দায় মূলত শক্তিধর দেশগুলোর ব্যর্থতা। ক্ষমতা প্রদর্শন এবং নিজের প্রভাব বলয় ধরে রাখতে অস্ত্রের প্রয়োজন। আর পারমাণবিক অস্ত্র এক্ষেত্রে অন্যতম শক্তি হিসেবে কাজ করে। মোট কথা আগের চেয়ে এখন পৃথিবীতে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আজ থেকে ৭৫ বছর আগে জাপানের হিরোশিমায় প্রথম পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছিল। পৃথিবীর মানুষ দেখেছিল এক নিষ্ঠুর অস্ত্রের ধ্বংসলীলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ প্রান্তে, মার্কিন সামরিক বাহিনী ইতিহাসের প্রথম পারমাণবিক হামলা চালায় জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমা এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলে- যার অনুমতি ছিল কুইবেক চুক্তির অধীনে যুক্তরাজ্যের সম্মতিসাপেক্ষে। এ দুই হামলায় প্রায় ২,২৬,০০০ মানুষ নিহত হন, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন বেসামরিক নাগরিক।
১৯৪৫ সালের শেষ নাগাদ,ি হরোশিমায় প্রায় ১,৪০,০০০ এবং নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪,০০০ মানুষ নিহত হন। নিহতদের মধ্যে প্রায় ৩৮,০০০ জন ছিলেন শিশু। পরবর্তী বছরগুলোতে অনেক বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি লিউকেমিয়া, ক্যানসার এবং রেডিয়েশনজনিত নানা কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। হিরোশিমার ওপর ফেলা ইউরেনিয়াম বোমাটির বিস্ফোরণ ক্ষমতা ছিল ১৫,০০০ টন টিএনটি-র সমান। এতে শহরের প্রায় ৭০ শতাংশ ভবন ধ্বংস বা পুড়ে যায় এবং বছরের শেষ নাগাদ আনুমানিক ১,৪০,০০০ মানুষ মারা যায়। তিন দিন পর, নাগাসাকিতে ফেলা হয় একটি আরও শক্তিশালী প্লুটোনিয?াম বোমা, যা ৬.৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। এতে মৃত্যু হয় আরও ৭৪,০০০ মানুষের। বিস্ফোরণের ফলে মাটির তাপমাত্রা ছিল ৪,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং বৃষ্টি হয়ে নামে বিষাক্ত বিকিরণযুক্ত ধূলিকণা।
আমেরিকার পরে দ্বিতীয় দেশ হিসেবে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় সোভিযেত ইউনিয়ন। ১৯৪৯ সালে তারা পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। তৃতীয় দেশ হিসেবে ব্রিটেন এই বোমার পরীক্ষা করে। এর ফলে পৃথিবী বুঝে যায়, যে এই ভয়ংকর অস্ত্র হাতে থাকলে বিশ্বে খবরদারী করা যাবে। এই বোমা মজুদ আছে এমন দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত ও পাকিস্তান। এছাড়াও উত্তর কোরিয়াতেও এই বোমা আছে। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি নাগাদ ৭০ হাজারের মত পারমাণবিক অস্ত্রের অস্তিত্ত্ব সম্পর্কে জানা ছিল। এখনও প্রায় ১৪ হাজার পরমাণু অস্ত্র আছে বলে মনে করা হয়। এক সময় পৃথিবী বুঝতে পারে এই অস্ত্র বিশ্বের জন্য হুমকি। এই অস্ত্র বিস্তার নিয়ন্ত্রণ চুক্তিও হলো। ১৯৬৮ সালের ১ জুলাই এই চুক্তির স্বাক্ষর সূচনা হয়। এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রপক্ষের সংখ্যা ১৮৯। ২০১০ সালে স্টার্ট অস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল দুটি দেশের (রাশিয়া ও আমেরিকা) মধ্য। পরমাণবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী বোমা আবিষ্কৃত হয়েছে। হাইড্রোজেন বোমা পারমাণবিক বোমার চেয়েও ৭০০ গুণ বেশি শক্তিশালী। তবে তা কোনো যুদ্ধে ব্যাবহার করা হয়নি। মোট কথা বিশ্ব এখন ভয়ংকর অস্ত্রের ঝুঁকিতে কাঁপছে। পরমাণু অস্ত্র ধ্বংস ক্ষমতার দিক থেকে অন্য সব অস্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক। অন্য অস্ত্রের চেয়ে পরমাণু অস্ত্র নিয়ে বিশ্বের মাথাব্যথা বেশি।
সারাবিশ্বে পরমাণু অস্ত্র সমৃদ্ধ দেশের সংখ্যা কয়েকটি। তবে এই কয়েকটি দেশে যে পরিমাণ অস্ত্র এখনও মজুদ আছে তা অনায়াসে প্রলয় ঘটতে পারে। মাঝে মাঝেই বিভিন্ন দেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হলে পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগের বিষয়টি উঠে আসে। এতে বিশ্বের অস্তিত্তই হুমকির মুখে পরে। আমরা একে অপরকে ধ্বংস করতেই ব্যস্ত। অথচ একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলা অনেক সময়ের ব্যাপার। ছোট এই পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার জন্য যেটুকু অস্ত্র দরকার তার থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র পৃথিবীতে মজুদ রয়েছে। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে মানব সভ্যতা আজ বহুদূর অগ্রসর হয়েছে। একবিংশ শতাব্দির দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে আমরা যেমন পৃথিবীকে উন্নত করতে পেরেছি তেমনি নিত্য নতুন অত্যাধুনিক অস্ত্রে নিজেদের সজ্জিত করে সভ্যতাকেই হুমকির মুখোমুখি দাড় করিয়েছি। এই ধ্বংসাত্বক অস্ত্র পৃথিবী থেকে একেবারে বিনষ্ট করা দরকার। যে অস্ত্র সভ্যতা বিনির্মাণে কাজে আসে না তা দিয়ে কি হবে? কিন্তু এটা কোনো এক দেশের দায়িত্ব না। প্রত্যেকেরই সমানভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
অস্ত্রনির্ভর পৃথিবী গড়ে তুলেছি আমরা। এটা আমাদের সফলতা না ব্যর্থতা তা একবাক্যে স্বীকার করার সময় আমাদের এখনই আসেনি। তবে একবাক্যে একথা বলতে দ্বিধা নেই আমাদের এই সুন্দর ধরণীর অস্তিত্ত হুমকিতেই রয়েছে। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো একের পর এক মারণাস্ত্র বানিয়ে পৃথিবীকে হুমকির মুখে ফেলছে। নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে রেখেই যে এটা করছে তা নিশ্চিত। কিন্তু শুধু নিরাপত্তার অজুহাতে একের পর এক আধুনিক মারণাস্ত্র দিয়ে পৃথিবী ভরে ফেলছে এ কথা পুরোপুরি হয়তো সত্যি নয়। কোনদিন যদি এই নিরাপত্তার অজুহাতই বুমেরাং হয়ে আমাদের ওপর চেপে বসে তখন মানবজাতি কোথায় আশ্রয় নেবে? অন্য গ্রহে? হলেও হতে পারে। তবে তার সম্ভাবনাও খুব বেশি নয়। এক দেশ নতুন কোন অস্ত্র বানাচ্ছে তো আরেক দেশ তার থেকেও ভয়ংকর কোন অস্ত্র বানিয়ে তাক লগিয়ে দিচ্ছে। এসব অস্ত্রের ভয়াবহতা এতই যে এই সুন্দর সবুজ শ্যামল পৃথিবী তার অস্তিত্ত হারাতে পারে। বহুবার এ ধরণী আধুনিক মারণাস্ত্রের আঘাতে কেঁপে উঠেছে। জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকির কথাই উদাহরণ হিসেবে বার বার উঠে আসে। সেই বোমা হামলার কয়েক দশক পার হলেও তার ক্ষত আজও জাপানের মানুষ বয়ে বেড়ায়। সেই হামলায় মৃত্যু এত ভয়ংকর ছিল যে কোন ধ্বংসের সাথেই এর তুলনা হয় না। এরপর শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত কি বিশ্বে শান্তি বিরাজ করছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই উত্তেজনা বলা হয় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে তা বিশ্বের অস্তিত্তই ধ্বংস করে দেবে।