বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ সরাসরি কৃষিকাজে নিয়োজিত এবং অধিকাংশ গ্রামীণ জনগোষ্ঠী কৃষি ও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। কৃষিখাত শুধু আমাদের খাদ্যের উৎস নয়, এটি দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড এবং গ্রামের মানুষের জীবিকা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার প্রধান মাধ্যম। তাই কৃষি খাতের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করাই দেশের সার্বিক অগ্রগতির অন্যতম প্রধান শর্ত। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বাংলাদেশের কৃষিখাত নানাবিধ সংকট ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে, যা দ্রুত সমাধান না করা হলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গুরুতর হুমকির মুখে পড়বে।
বর্তমান সময়ে কৃষিখাতের সমস্যা বহুমাত্রিক। কৃষকেরা সার, বীজ, কীটনাশক, জ্বালানি এবং শ্রমসহ উৎপাদনের সব খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেকেই আর লাভবান হচ্ছেন না।
ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া এবং বাজার ব্যবস্থার অসঙ্গতির কারণে কৃষকের আয় কমে যাচ্ছে, যা তাদের জীবনমান এবং উৎপাদনশীলতা উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, অনিয়মিত বৃষ্টি এবং জমির লবণাক্ততা বাড়ার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এই সব সমস্যা কৃষকদের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে এবং অনেকেই কৃষি ছেড়ে শহরে অভিবাসনের পথ বেছে নিচ্ছেন। সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে কৃষি খাতের উন্নয়নের চেষ্টা চলছে, তবে মাঠ পর্যায়ে এসব প্রকল্পের সুফল কৃষকের হাতে পৌঁছাতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। দুর্নীতি, প্রশাসনিক জটিলতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবে প্রকৃত কৃষকরা অনেক সময় সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কৃষক যাতে সুফল পান সে জন্য কার্যকর তদারকি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সবচেয়ে জরুরি। দেশের বাজার ব্যবস্থা স্বচ্ছ ও কার্যকর না হলে কৃষক লাভবান হবে না। এজন্য ডিজিটাল কৃষি বিপণন ব্যবস্থা চালু করে কৃষক ও ক্রেতার মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করা প্রয়োজন। এতে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমে কৃষক সহজেই সঠিক মূল্য পাবে। কৃষি পণ্যের বাজারে মূল্য স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কৃষকের ফসলের মূল্য কৃত্রিমভাবে কমানো না যায়।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বরাদ্দ ও কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। অধিকাংশ কৃষক এখনও ঐতিহ্যগত ও শ্রমসাধ্য পদ্ধতিতে কাজ করছেন, যার কারণে উৎপাদন ব্যয় ও সময় অনেক বেড়ে যায়। আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন- ট্রাক্টর, প্লাউ, রাইস হার্ভেস্টার সহজ কিস্তিতে এবং ভর্তুকিসহ কৃষকের কাছে পৌঁছানো গেলে শ্রম ও সময়ের ব্যাপক সাশ্রয় হবে। পাশাপাশি কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে তোলা প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আবহাওয়া-সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি, টেকসই কৃষি ও সহনশীল ফসলজাতের উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। বন্যা, খরা ও লবণাক্ততার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি রোধে গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কৃষকদের জন্য আবহাওয়াভিত্তিক সতর্কতা এবং পরামর্শ দ্রুত ও সহজলভ্য করতে হবে মোবাইল অ্যাপসহ আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে। কৃষি বীমার আওতা সম্প্রসারণ এবং দুর্যোগ ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে যাতে কৃষক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন না হন। কৃষি ঋণের সহজলভ্যতা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা জরুরি। অনেক প্রান্তিক কৃষক এখনও সরকারি ব্যাংক বা এনজিও থেকে ঋণ পেতে পারেন না বা অত্যন্ত কঠোর শর্তে বাধ্য হন। সরকারের উচিত স্বল্পসুদের ঋণ প্রদান নিশ্চিত করা এবং ঋণ শোধের ক্ষেত্রে নমনীয়তা বজায় রাখা, যাতে কৃষক অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়ে না। কৃষকদের সামাজিক মর্যাদা ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি। ‘কৃষক’ শব্দের সঙ্গে থাকা অবজ্ঞার ভাবনা দূর করে শিক্ষাব্যবস্থা, গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে কৃষকের অবদানকে মর্যাদাসম্পন্নভাবে তুলে ধরতে হবে। তরুণ প্রজন্ম যাতে কৃষিকে সম্মানের পেশা হিসেবে গ্রহণ করে তার জন্য কৃষি শিক্ষা আধুনিকায়ন করে প্রযুক্তিনির্ভর ও লাভজনক পেশা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে বাজেট বাড়ানো অপরিহার্য। সেচ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন, বাজার কেন্দ্র গঠন এবং নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এছাড়া, মাঠ পর্যায়ে কৃষি অবকাঠামো যেমন, সেচ পাম্প, রাস্তা ও বিপণন কেন্দ্র উন্নয়নে নজর দিতে হবে। ‘কৃষক বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’- এই কথাটি শুধু একটি স্লোগান নয়, এটি দেশের টেকসই উন্নয়নের বাস্তব নির্দেশক। কৃষকদের প্রতি যথাযথ অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, সামাজিক ও প্রশাসনিক সহায়তা ছাড়া দেশের অগ্রগতি অসম্ভব। তাই এখনই সময়, কৃষকের পাশে দাঁড়িয়ে পরিকল্পিত ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের। যখন কৃষকরা লাভবান হবেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করবেন, আর্থিকভাবে স্থিতিশীল হবেন এবং সামাজিক মর্যাদা পাবেন, তখনই দেশের কৃষিখাত স্থায়ীভাবে উন্নতি করবে। কৃষি খাতের উন্নয়ন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। অতএব, প্রয়োজন মাঠ পর্যায়ের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভুত পরিকল্পনা ও নীতিমালা গ্রহণের, যেখানে কৃষক ও কৃষিখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। কৃষিখাতের টেকসই উন্নয়নে সব সরকারি, বেসরকারি এবং সামাজিক অংশীদারদের সম্মিলিত প্রয়াস অপরিহার্য। দেশের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে কৃষিখাতকে বাঁচানো ও উন্নত করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও শিক্ষার্থী, ফুলছড়ি সরকারি কলেজ, সাঘাটা, গাইবান্ধা