প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৮ জুলাই, ২০২৫
‘যদি জোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি। যদি জোটে দুইটি পয়সা ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী।’ আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফুল ভালোবাসতেন। ফুলের প্রতি তিনি এত বেশি অনুরাগী ছিলেন যে, তাঁর উম্মতদের অন্তরেও সে ভালোবাসা বিকাশের প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি তাঁর প্রিয় উম্মতদের উদ্দেশে এই বলে আহ্বান জানিয়েছেন- খাবার কেনার পর যদি কোনো টাকা-পয়সা হাতে থাকে তা দিয়ে যেন ফুল কেনা হয়। এই নিয়ে আমাদের নবীজির একটি হাদিস আছে। হাদিস হলো- সেই বাণী যা মহানবী (সা.) বলেছেন। অন্য কথায়, মহানবী (সা.)-এর মুখ নিঃসৃত বাণীকে হাদিস বলে। মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই হাদিস নিয়ে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি, বাংলা সাহিত্যে যিনি ছন্দের জাদুকর নামে খ্যাত, সেই সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত একটি মনকাড়া কবিতা লিখেছেন- সেই কবিতারই অংশবিশেষ উপর্যুক্ত চরণ কয়টি। আর চরণ কয়টি উদ্ধৃতির যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। আমরা জানি, মানুষের মৌলিক চাহিদা যাকে আমরা ইংরেজিতে- Fundamental rights বলি। সেগুলো ৫টি- তার মধ্যে প্রথমটি খাদ্য, দ্বিতীয়টি বস্ত্র, তারপর শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান। একটু ভেবে দেখলে বোঝা যায়, এই পাঁচটি উপাদানেরই সরবরাহ কোনো না কোনোভাবে গাছপালার উপরই নির্ভরশীল।
আমরা যদি প্রথমত খাদ্যের কথা বলি, চাল-ডাল-শাকসবজির কথা বলি তা সরাসরি পাই গাছপালা থেকে। তারপর বস্ত্রের কথা- তাও আসে গাছপালা থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে তৈরি হয়। শিক্ষার প্রধান উপকরণ কাগজ তাও তৈরি হয় এই গাছপালা থেকে। আর চিকিৎসার ও বাসস্থানের বেশিরভাগ উপাদান সেই প্রাচীনকাল থেকে গাছপালাই আমাদের যোগান দিয়ে আসছে। এখনও গ্রামাঞ্চলে কারো হঠাৎ কেটে গেলে, কাশি হলে, ছোট ছোট শিশুদের কৃমির উপদ্রব প্রশমনে সরাসরি গাছপালা থেকে তৈরি ওষুধই ব্যবহার হচ্ছে। সর্বোপরি আমাদের প্রিয় নবী যে ফুল কেনার কথা বলেছেন সেই ফুলও গাছপালার অকৃত্রিম উপহার। খাদ্য আমাদের ক্ষুধার জ্বালা মেটায়। আর ফুল হলো আত্মার খাদ্য। চোখ ও আত্মার ক্ষুধা মেটাতে ফুলের সৌরভ ঐশ্বর্যের কোনো তুলনা নেই। এই যে গাছপালা আমাদের মৌলিক চাহিদার সব কটির যোগানদার, সর্বোপরি সৌরভ ও গৌরবের আধার, মানবজীবনে তার মতো উপকারী বন্ধু দ্বিতীয়টি থাকার কথা নয়। গাছপালা কী আমাদের শুধু খাদ্য দিয়েই ক্ষান্ত হয়। না, গাছপালা আমাদের বেঁচে থাকার অপরিহার্য উপাদান অক্সিজেন সরবরাহ করে। অক্সিজেন হলো- সেই পদার্থ যা মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী শ্বাসক্রিয়ায় মাধ্যমে গ্রহণ করে। আর ত্যাগ করি কার্বন ডাই-অক্সাইড।
আরো একটু পরিষ্কার করলে হয়- প্রাণী মাত্রই শ্বাস নেয় এবং ফেলে, যাকে শ্বাস-প্রশ্বাস বলে। আমরা সবাই প্রতিটি নিঃশ্বাসে গ্রহণ করি অক্সিজেন আর ফেলি কার্বন ডাই-অক্সাইড। গাছপালা প্রকৃতিতে অক্সিজেন সরবরাহ করে। আর কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয়। কার্বন-ডাই-অক্সাইড অর্থাৎ যে উপাদানটি আমরা প্রতিটি নিঃশ্বাসে ত্যাগ করি তা মানুষের শরীরের জন্য একটি মহা ক্ষতিকর উপাদান। যদি গাছপালা না থাকতো তাহলে সমস্ত বায়ুমণ্ডল এক সময় কার্বন-ডাই-অক্সাইডে ভরে উঠত।
একটি বৃক্ষ বছরে প্রায় ১৩ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। এটি আল্লাহ পাকের সুন্দর ব্যবস্থাপনা। তিনিই এভাবে বৃক্ষের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করেন। চারদিক সতেজ-সজীব গতিময় রাখেন। আল্লাহ পাক বলেন, ‘তিনিই আল্লাহ যিনি বায়ু প্রেরণ করেন। অতঃপর তা মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে। অতঃপর তিনি মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তা স্তরে স্তরে রাখেন। এর পর তুমি দেখতে পাও, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাদের কাছে ইচ্ছা তা (বৃষ্টি) পৌঁছান। তখন তারা আনন্দিত হয়। (সুরা রুম, আয়াত : ৪৩)।
এমন একটি সময় ছিল যখন উদ্ভিদকে মনে করা হতো প্রাণহীন। বিজ্ঞান গাছপালার প্রাণ আবিষ্কার করেছে বেশিদিন হয়নি। কিন্তু আমাদের পবিত্র ধর্ম ইসলামে বলা হয়েছে, গাছের শুধু প্রাণ নয় অনুভূতি আছে, দায়িত্ববোধও আছে। এমনকি মহান আল্লাহকে বৃক্ষ সেজদা করে। তার তাসবিহ পাঠ করে। কোরআন পাকে ঘোষিত হয়েছে, ‘আপনি কি দেখেননি নভোমণ্ডলে ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, পর্বতমালা বৃক্ষলতা ও জীবজন্তু এবং অনেক মানুষ আল্লাহকে সেজদা করে।’ (সুরা হজ, আয়াত-১৮)। শুধু মানুষ নয় পৃথিবীর সকল প্রাণী গাছপালার উপর নির্ভরশীল।
গরুর প্রধান খাদ্য ঘাস। ছাগলের প্রধান খাদ্য কচিপাতা। এভাবে প্রতিটি প্রাণী গাছপালার সাথে সম্পর্কিত। পৃথিবীর কোন প্রাণীই শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণ ছাড়া বাঁচতে পারে না। শর্করা ভেঙে যে শক্তি উৎপন্ন হয়, তার সাহায্যে আমরা চলাফেরা করি। এক বিশেষ পদ্ধতিতে সূর্যের আলোকে কাজে লাগিয়ে গাছপালা এই খাদ্য উৎপাদন করে। এই খাদ্য উৎপাদনে প্রয়োজন হয় ক্লোরোফিল নামের এক ধরনের সবুজ বস্তু। আর এই বস্তু থাকে গাছের সবুজ পাতায়। পৃথিবীতে যদি গাছপালা না থাকত তাহলে সেই কবে প্রাণী জগৎ বিলুপ্ত হয়ে যেতো। পৃথিবী হতো বিরান ভূমি। আর তাই, আমরা বুঝতে পারি আমাদের গাছপালার প্রতি কেমন আচরণ করা উচিত? গাছ মানুষ ও পরিবেশের বন্ধু। সবুজ গাছপালার ওপরই নির্ভর করে মানুষসহ পরিপূর্ণ প্রাণী জগতের অস্তিত্ব। গাছপালা সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়ে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে, আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন’ (আবু দাউদ : ৫২৪১, বায়হাকী : ৬/১৪০)। পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য গাছ লাগানোর শিক্ষা আমরা মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামণ্ডএর হাদিস থেকে পাই। তিনি বলেছেন, ‘যদি তুমি মনে কর আগামীকাল কেয়ামত হবে, তবু আজ একটি গাছ লাগাও।’
কোরআনে পাহাড়-পর্বতকে পৃথিবীর পেরেক বলে উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু মানুষ অবাধে বনজঙ্গল উজাড় করে ও পাহাড় কেটে নিজেরাই নিজেদের ধ্বংসের পথে ধাবিত করছে। মানুষ না বুঝে নিজের কত বড় ক্ষতিসাধন করছে, তা আমাদের চারপাশে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায়। মানুষ হয়তো বুঝেও বুঝছে না তাদের অসচেতনতা ও অবহেলায় পৃথিবীর পরিবেশ দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। জীবের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে; যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
তাই আমাদের উচিত গাছপালার প্রতি যত্নবান হওয়া। বেশি বেশি গাছ লাগানো। বাড়ি বা বাসার আঙিনায় এক চিলতে যদি খালি জায়গা থাকে তাতে যে কোন ধরনের গাছ লাগানো। ফলজ, বনজ, ঔষধি যে কোন ধরনের। আর যারা শহরে, নগরে ভাড়া বাসা বা ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকে তারাও গাছ লাগাতে পারে অনায়াসে। আজকাল টবে লাগানোর মতো অনেক চারা পাওয়া যায়। আবার টবশুদ্ধ চারা পাওয়া যায়। কথা হলো এই কাজটি করার জন্য ইচ্ছার প্রয়োজন। ইচ্ছা থাকলে উপায় একটা হবেই। মনে রাখা দরকার, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি হুমকির সম্মুখীন। বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার আধিক্য, বনভূমির স্বল্পতা, চাষযোগ্য জমি হ্রাস, সমাজের এক শ্রেণির মানুষের দাপুটে ভাব ও অর্থ লিপ্সা আর কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণের প্রেক্ষিতে নির্বিচারে গাছপালা কর্তনের ফলে ঋতু তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে ক্রমে বৈরী হয়ে উঠছে। এই বৈরিতা সামাল দিতে, বনভূমির গাছপালার সংখ্যা বাড়াতে আশু প্রয়োজন ব্যাপক উদ্যোগ, সর্বোপরি দেশের ছত্রিশ কোটি হাতকে একাজে সম্পৃক্ত করতে পারলে সামনের বিপর্যয় হয়তো বা এড়ানো সম্ভব। তাই কাজটি শুরু করতে হবে এখুনি। কাল নয় আজ। যে যার অবস্থান থেকে শুরু করতে হবে গাছ লাগানোর কাজ। এ কাজ কিন্তু নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, আমাদের আশপাশের পরিবেশের জন্য। মনে রাখতে হবে- জীবন বাঁচাতে আর জীবন সাজাতে বৃক্ষের প্রয়োজন অপরিহার্য। শুধু তাই নয়, পরিবেশ সংরক্ষণে বৃক্ষের কোনো বিকল্প নেই।