প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৯ জুলাই, ২০২৫
আমরা পুরস্কার গ্রহণ করতে কেনা পছন্দ করি। আর আনন্দ-বিনোদন উপভোগ করার ক্ষেত্রে তো কোনো বালাই নেই। আরাম-আয়েশের কথা যদি বলি, সে ক্ষেত্রে আমরা বাঙালি অনেক এগিয়ে। যে কাজে আরাম, আয়েশ, আনন্দ, সুখানুভূতি বেশি পাওয়া যায়, সে কাজগুলোর প্রতি আমরা একটু বেশিই আগ্রহী। আমরা সকালে ঘুম হতে উঠা থেকে শুরু করে রাত্রি ঘুমানো অব্দি প্রত্যকেই কোনো না কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকি। তবে কোন কাজটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজটি আমার জীবনের ভবিষৎ উজ্জ্বল করবে, সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী প্রতিদিনের কার্যক্রমে কতটা সময় ব্যয় করছি, এমন নির্দেশিকা আমরা ক’জন মেনে চলি। আমাদের নিত্যদিনের কার্যের সঙ্গে ডোপামিন সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতরভাবে কাজ করে, যা আমরা বুঝতেই পারি না। প্রতিনিয়ত আমাদের মাত্রারিক্ত ডোপামিন ডিটক্স ছিনিয়ে নিচ্ছে।
বিশদ আলোচনা করার পূর্বে জেনে নেওয়া যাক ডোপামিন কি? ডোপামিন মানব দেহের এক প্রকার হরমোন। যা ক্যাটেকোলামাইন ও ফেনাথ্যালামাইন পরিবারের একটি নিউরিট্রান্সমিটার, যা মানব মস্তিস্কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটা এক ধরনের আনন্দদায়ক, আরাম ও সুখানুভূতি। শুরুতেই বলেছিলাম, আমরা সবাই পুরস্কার পেতে পছন্দ করি, সহজ কথায় বলা যায়, ডোপামিন হলো- মানব মস্তিষ্কের পুরস্কার। একজন মানুষের মূল লক্ষ্যবস্তু ছেড়ে মস্তিষ্ক যখন উন্মুক্ত হয়ে পুরস্কারের নেশায় ডুবে যায়, তখন সেখান থেকে বেরিয়ে আসা অনেক কঠিন হয়ে পরে। ডোপামিন আমাদের মস্তিষ্কে খুবই সুক্ষ্মভাবে যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করে যা আপাত দৃষ্টিতে সঠিক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ডোপামিন নিঃসরণ হচ্ছে। ধরে নেওয়া যাক এই মুহূর্তে আমার মনটা খারাপ তাই নজরুল সংগীত শোনতে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ইউটিউব ওপেন করতেই আমার প্রয়োজনীয় একটা ভিডিও সামনে ভাসছে খুব সহযে আঙ্গুলটি টার্চ করল, কিছু সময় দেখতে দেখতে দেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ খবরের নোটিফিকেশন আসল দেখতে শুরু করলাম, এদিকে আবার মাঝেমাঝে মস্তিষ্কে নাড়াও দিচ্ছে, এটা দেখার পরেই নজরুলের ভালো একটা গান শোনব- এরই মাঝে চকচকে ঝকঝকে সুন্দর পোস্টারে লেখা ‘আপনি কি আপনার সন্তানকে পড়াশোনায় মনোযোগী করতে চান? মাত্র তিনটি টিপসই যথেষ্ট’ এমন চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দেখে খুব দ্রুত মস্তিষ্ক সায় দিচ্ছে। আমার সন্তানটা একেবারেই পড়তে চায় না ভিডিওটা আমার দেখা জরুরি, শুরু হয়ে গেল দেখা। এভাবে একেরপর এক নতুন নতুন ভিডিও চোখের সামনে ভাসছে- কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখব, এমন সিদ্ধান্তের টানা-হেঁচড়ায় শুরুর মূল লক্ষ্যবস্তু বা পরিকল্পনা থেকে কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছি, তা আমরা কতটা অনুভব করি।
বর্তমান তথ্যপ্রযক্তির যুগে আমরা প্রায় সবাই ডোপামিনের জালে আটকা। তবে বিশেষ করে প্রযুক্তির ব্যবহারে তরুণরা বহুগুণ এগিয়ে। আমাদের দেশের তরুণ সমাজ মাত্রারিক্ত ডোপামিনের জালে এমনভাবে আটকে গেছে, যা তাদের উন্মাদ করে তুলেছে। এখান থেকে তাদের বেরিয়ে আনতে না পারলে তাদের ভবিষৎ অন্ধকার। তাদের ভবিষৎ অন্ধকার হওয়া মানে একটা রাষ্টের জন্য ভয়ানক সংকেত। বর্তমান সময়ে তরুণ প্রজন্ম ডোপামিন নামক হরমোনের নিউরোট্রান্সমিটারে এতটা দ্রুত নিঃসরণ হচ্ছে, যার কারণে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক রাসায়নিক এক ধরনের সুখ ও আনন্দময় অনুভূতি সৃষ্টি করে। তবে অতিরিক্ত ডোপামিন গ্রহণ করার ফলে আসক্তি হয়ে পরে। যার কারণে মনোযোগ হারিয়ে ফেলে খিটমিটে মেজাজ, খুধামন্দাসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।
তরুণরাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথা নেট দুনিয়াই বেশি সময় ব্যয় করে। তারা অপ্রয়োজনীয়ভাবেই ফেসবুক, ইন্সট্রগ্রাম, ইউটিউব, ভিডিও গেম, পর্নোগ্রাফী ভিডিওর প্রতি আসক্তি হয়ে পরে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, তরুণদের একটা বড় অংশ ৮৪ শতাংশ দিনে ২-৬ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেসবুকে আসক্তি।
বাংলাদেশ সর্বশেষ আদমশুমারীর তথ্যনুযায়ী ১৬ কোটির বেশি জনসংখ্যা। দ্রুত নগরায়ন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শহরায়নও বাড়ছে। সেই সঙ্গে থেমে নেই, নেট দুনিয়াই স্মার্ট ফোনের ব্যবহার। একটি নির্ভরযোগ্য অনলাইন পোর্টাাল ঢাকা পোষ্টে উল্লেখিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ দ্বারা পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, শহরে বসবাসকারী বাংলাদেশি ৬২ শতাংশ ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি। যা খুবই উদ্বেগজনক। ২০২১ সালে ৫২০ জন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের উপর গবেষণায় দেখা গেছে করোনাকালীন সময়ে অসংখ্য যুবক আসক্তি হয়ে পরে। যারা বর্তমানে নানা ধরনের মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় ভুগছেন। মেডিকেল রিসার্চ ইন্টারনেট জার্নালে প্রকাশিত গবেষনায় দেখা যায়, ঘন ঘন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে একাকিত্বে ভুগছেন ৬৪ শতাংশ, বিষণ্ণতায় ভুগছেন ৩৮ শতাংশ, ৬৩ শতাংশ উদ্বেগ এবং ৭৫ শতাংশ ঘুমের ব্যাঘাতজনিত সমস্যায় আক্রান্ত। ডোপামিন অতিদ্রুত নিঃসরণ ঘটায় এমনসব কাজের মধ্যে প্রধানতম মাধ্যম হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যা আসক্তি তৈরি করার সম্ভাবনা খুবই বেশি। আমরা সকলেই নিত্যদিন কোনো না কোনো কাজ করি। যেমন পড়াশোনা, শরীর চর্চা, গৃহস্থালীর কাজ, অফিস যাওয়া, কাছের মানুষদের খোঁজখবর নেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে এই কাজগুলো মনের স্বাচ্ছন্দ্যে পালন করা মানুষের সংখ্যা খুবই সীমিত। আর তা না হওয়ার পেছনেও রয়েছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। যে কাজগুলো করতে আমাদের ভালো লাগে না, সেই কাজগুলো আমাদের মস্তিষ্কে অতিমাত্রায় ডোপামিন ক্ষরণ করে না, যার ফলে মস্তিষ্কে উল্লেখিত কাজের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখায় না। এ ব্যাখ্যা থেকে প্রমাণিত পরিমাণ মতো ডোপামিন মানুষকে কাজের প্রতি উদ্যামী বা আগ্রহী করে তোলে। আর মাত্ররিক্ত ডোপামিন মানুষকে যে কোনো কাজের প্রতি আসক্তি করে তোলে, আর তা হতে পারে, নিজের আত্মসম্মান বৃদ্ধি, অর্থের চাহিদা, মাদক, প্রতিপত্ত বিস্তার, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যুদ্ধ, পরকিয়াসহ নানাবিষয়। আর নেট দুনিয়ার কথা তো বলার অপেক্ষায় রাখে না। এই সকলবিষয় অতিমাত্রায় চাহিদা হওয়ার কারণে মানুষ দৈনন্দিন কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। যথা সময়ে প্রয়োজনীয় কাজগুলো সমাপ্ত করতে না পারায়, একদিকে যেমন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছি, অন্যদিকে নিজের জীবন প্রতিষ্ঠিত করার মূল লক্ষ্য থেকে অনেক পিছিয়ে যাচ্ছি। একটি সময় শুধু হতাশা আর ডিপ্রেশনে ভোগা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। আর বর্তমান সমাজে মাথাব্যথার প্রথম, প্রধান এবং অন্যতম চিত্র বা আতঙ্কের নাম ‘সামাজিক যোগাযোগের প্রতি আসক্তি’ বর্তমানের পৃথিবীতে নেট দুনিয়াই আসক্তিকে তুলনা করা হচ্ছে- জীবনগ্রাসী মাদকাশক্তির সঙ্গে। খুব সুকৌশলে বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো আমাদের, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীর মস্তিষ্ক ধোলাই করে প্রায় সব মনোযোগ ছিনিয়ে নিয়ে আবদ্ধ করে ফেলেছে, বিভিন্ন পোষ্টের লাইক কমেন্ট আর শেয়ারে। তারা নিজের বাস্তব জীবনের কথা না ভেবে ডুবে আছে রঙিন স্বপ্নে। আগামীতে রাষ্ট্রের হাল ধরতে দেখা দিতে পারে সুশিক্ষিত ব্যক্তির যা একটি রাষ্ট্রের জন্য অসনিসংকেত।
বাংলাদেশে তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন ২ হাজার ২৬ জন ব্যক্তির ওপর একটি জরিপ করেন, যেখানে অংশগ্রহণকারীদের সবচেয়ে বড় অংশ ১ হাজার ৭২০ জন ছিলেন ১৮ হতে ২৫ বছর বয়সি। ২৬ হতে ৩০ বছর বয়সি ছিলেন ২৪৩ জন এবং ৩১ হতে ৩৫ বছর বয়সি ছিলেন ৬৩ জন। মোট অংশগ্রহণকারী নারী ১ হাজার ২৯৩ জন তৃতীয় লিঙ্গের ছিলেন শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ।
এই জরিপটিতে উঠে আসে ১৮-২৫ এবং ২৬-৩০ বছর বয়সি ব্যক্তিদের সবচেয়ে বেশি মানসিক চাপ, ঘুম কম হওয়া, বিষণ্ণতায় ভুগছেন। ৩১ মে ২০২৫ সালে গুরুত্বপূর্ণ অনলাইন নিউজ পোর্টাল এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ইন্টারনেট ব্যবহারে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম স্থানে। যদিও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসির) সর্বশেষ তথ্যনুযায়ী বাংলাদেশে ইন্টারনেট গ্রাহক প্রায় ১৩ কোটি ৮ লাখ ২০ হাজার এবং মোবাইল গ্রাহক রয়েছে প্রায় ১৮ কোটি ৬২ লাখ ২০ হাজার। বর্তমান নেট দুনিয়াই অনিয়ন্ত্রিত চলাফেরায় তৈরি করছে রঙিন কল্পনার জগৎ। যেখানে বিভিন্ন শব্দ, বাক্য ও ছবিসহ নানা ধরনের বিষয় অন্তর্ভুক্তি। যার দ্বারা সৃষ্টি হচ্ছে এক কৃত্রিম জগৎ। এই কৃত্রিম জগৎ ধীরে ধীরে গ্রাস করছে বাস্তব জগৎকে। তরুণ সমাজের পাশাপাশি প্রাপ্ত বয়স্করাও বাদ নেই মাত্রারিক্ত ডোপামিন হতে। বিশ্বের নামিদামি বিশ্লেষকরা অবাদ ইন্টারনেট ব্যবহারে অশনিসংকেত দিয়েছেন জোরালোভাবে।
বিজ্ঞানীরা আরও জানান দেয়, যাদের শরীরে ডোপামিন রিসেপটর জিনের অ্যালিলের সংখ্যা যতবেশি তাদের দ্বারা অন্যায়ভাবে ব্যাভিচারে লিপ্ত হওয়া হুটহাট করে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া ভুল মানুষকে নির্বাচন করা। রাগ, ক্ষোভ, অবজ্ঞা বৈবাহিক অশান্তি, পরকীয়াসহ বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটে চলছে, যার মূল কারণ হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতা। যার কারণে খুব সহজেই প্রেমঘটিত ঘটনাসহ প্রতিনিয়ত পরকীয়া বেড়ই চলছে। যে চোরাবালিতে ডুবে গিয়ে তছনছ হচ্ছে- অহরহ সাজানো সংসার। বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনাও পূর্বের চেয়ে বেড়েই চলছে। মাত্রারিক্ত ডোপামিন থেকে তরুণ সমাজকে ফিরিয়ে আনতে হলে অবশ্যই তাদের ধারাবাহিক ডোপামিন ডিটক্স গ্রহণ (মেনে চলতে হবে)। ডোপামিন ডিটক্স’ই পারে মাত্ররিক্ত ডোপামিন হতে অনেকাংশে তাদের ফিরিয়ে আনতে। ডোপামিন ডিটক্স বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত করে। যখন কেউ শান্ত থাকে তখনি তার মাথায় সুচিন্তার উদয় হয়। এর জন্য নিয়মিত মোটিভেশনাল কোর্সের প্রশিক্ষণ এবং খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী করে গড়ে তোলা সেই সাথে পুষ্টিকর খাবার ও শরীর চর্চায় অভ্যস্ত করতে হবে।
এছাড়া বিষেøষকরা বলছেন, সবচেয়ে কার্যকারীভাবে কাজ হবে যদি সম্ভব হয় আসক্তির ধরন অনুযাযী ধারাবাহিকভাবে ৭ দিন ২১ দিন ১ মাস নেটদুনিয়া তথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে একেবারে দূরে থাকতে হবে। সকালবেলা পূর্বে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা দিয়ে কাজ শুরু করা, সেই সাথে নির্জন প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে মেলে ধরা, ভালো বই পড়তে হবে। সর্বোপরি একজন অভিভাবককে সন্তানের প্রতি যথেষ্ঠ সচেতন হওয়া জরুরি। পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে সামাজিকভাবে কোন বিষয়গুলো কতটা উপকার আর কতটা ক্ষতিকর, সেটি বিশ্লেষণ করে সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেওয়াও জরুরি। নতুবা তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের অন্তরালে ঘটে চলা ঘটনা প্রবাহের চোরাবালির অতল গহ্বরে ডুবে যেতে পারে বর্তমানের তরুণ সমাজ।
লেখক ও সাংবাদিক