প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০২ আগস্ট, ২০২৫
বাংলাদেশের রাজনীতির অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি হলো, যাকে কাল পর্যন্ত নির্ভরতার প্রতীক বলে বিবেচনা করা হয়, আজ তার বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্রতত্ত্ব রচনা করা হয়। এমন প্রবণতা সম্প্রতি আবারও দেখা গেল জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের (ওএইচসিএইচআর) ঢাকায় দপ্তর স্থাপন নিয়ে শুরু হওয়া বিতর্কে।
দীর্ঘ স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সময় আন্তর্জাতিক মহলের সহানুভূতি ও সমর্থন অর্জনের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিবৃতির প্রতি যে আগ্রহ দেখিয়েছিল, এখন তারাই একই সংস্থাকে ‘সাম্রাজ্যবাদের দোসর’ আখ্যা দিতে পিছপা হচ্ছেন না। বামণ্ডডান, ধর্মবাদী-ধর্মনিরপেক্ষ সব মতাদর্শের প্রতিনিধিরা যেন একটি অভিন্ন সুরে জাতিসংঘের দপ্তর স্থাপনের বিরোধিতায় নেমে এসেছেন।
অবাক করার মতো বিষয় হলো, এই বিরোধিতার যুক্তি যতটা না তথ্যভিত্তিক, তার চেয়ে অনেক বেশি জড়িত ভীতি, অজ্ঞতা এবং কখনও কখনও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচারে। কোনো কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী উদ্বেগ জানাচ্ছে, ওএইচসিএইচআরের উপস্থিতিতে ‘সমকামিতা উৎসাহিত হবে’, ‘নারী স্বাধীনতার নামে ইসলামী বিধান লঙ্ঘিত হবে’, কিংবা ‘সংখ্যালঘুদের প্রভাব বাড়বে’। এসব কথা শুনে মনে হয়, যেন মানবাধিকার মানে শুধু পশ্চিমা সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া, অথচ মানবাধিকার মানে তো নিজ জাতি, সমাজ ও জনগণের প্রতিই একটি ন্যায্য আচরণের নিশ্চয়তা।
মানবাধিকার দপ্তর স্থাপন নিয়ে বামপন্থি নেতাদের ভাষ্যও কম বিস্ময়ের নয়। তারা জাতিসংঘকে ‘সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার’ হিসেবে অভিহিত করছেন, অথচ তারাই অতীতে দেশে গুম-খুন, দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের বিবৃতি উদ্ধৃত করে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের যুক্তি পেশ করেছিলেন। জাতিসংঘের দপ্তর কি তবে শুধু তখনই গ্রহণযোগ্য, যখন তা নিজের রাজনৈতিক অবস্থানের পক্ষে কথা বলবে?
বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার একটি দপ্তর স্থাপন কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। বরং গত এক দশকে দেশে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নিরাপত্তা বাহিনীর অপব্যবহার, সংখ্যালঘু নির্যাতন, রাজনৈতিক নিপীড়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দুশ্চিন্তা ক্রমশ গভীর হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই ৩ বছরের জন্য ওএইচসিএইচআরের উপস্থিতি নির্ধারিত হয়েছে। অথচ আজ এই উপস্থিতিকে অনেকেই দেশের ভাবমূর্তির সংকট বলে মনে করছেন, অজানা আশঙ্কা দেখিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যিই কি জাতিসংঘের একটি দপ্তর বাংলাদেশে ইমেজ সংকট তৈরি করবে? দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মেক্সিকোসহ বিশ্বের অন্তত ১৮টি দেশে ওএইচসিএইচআরের দপ্তর রয়েছে। এসব দেশ কি তাদের আন্তর্জাতিক অবস্থান হারিয়েছে? বরং মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নের মাধ্যমেই তারা বিশ্বে আরও মর্যাদা অর্জন করেছে।
উল্লেখযোগ্য একটি দিক হলো, আমাদের শান্তিরক্ষী বাহিনী। জাতিসংঘের বিভিন্ন মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা দক্ষতা ও মানবাধিকার মেনে চলার জন্য বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। কিন্তু দেশে ফিরে তাদের সেই পেশাদারিত্ব অনেক সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কেন? কারণ, দেশে এমন একটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবেশ বিরাজ করে, যেখানে জবাবদিহির কাঠামো দুর্বল এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রায়শই উপেক্ষিত থেকে যায়।
জাতিসংঘের দপ্তর থাকলে সেটি নিঃসন্দেহে একটি মনিটরিং ও প্রতিবেদন তৈরির প্ল্যাটফর্ম হবে, যা রাষ্ট্রযন্ত্রকে আরও দায়িত্বশীল হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এটি যদি কারও জন্য ‘ভয়ংকর’ হয়, তাহলে নিশ্চয়ই কোথাও কিছু গলদ আছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নিরপেক্ষ নয়, এমন অভিযোগ অনেক সময় সত্যও হতে পারে। তবে সেজন্য সমালোচনার ভাষা হওয়া উচিত যৌক্তিক ও তথ্যনির্ভর, গোঁড়ামি বা আতঙ্কসৃষ্টিকারী নয়। বিশেষ করে যখন ওএইচসিএইচআর গুম, ছাত্রহত্যা, শাপলা চত্বরের সহিংসতা ইত্যাদি প্রসঙ্গে নির্ভীক অবস্থান নিয়ে এসেছে- তখন তাদের বিরুদ্ধেই পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলা আত্মঘাতী। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা কী করে, তার ব্যাপারে আমাদের অনেকের জ্ঞান সীমিত। এ সংস্থা নিরাপত্তা পরিষদের মতো নীতিনির্ধারক নয়, বরং তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং নীতিনির্ধারকদের সামনে তা তুলে ধরাই তাদের প্রধান কাজ। গাজা বা ফিলিস্তিনে জাতিসংঘ ‘কিছুই করতে পারেনি’ বলে যারা ওএইচসিএইচআরের বিরোধিতা করছেন, তারা সম্ভবত জানেন না- এই সংস্থার প্রতিনিধি ফ্রান্সেসকা আলবানিজ ফিলিস্তিনে গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আজ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছেন। এরকম নির্ভীক কণ্ঠকে দমন করার চেষ্টা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মানবাধিকার কর্মীদের জন্য একটি ভয়ংকর বার্তা।
মানবাধিকারের প্রশ্নে যদি বাংলাদেশে কিছু লুকানোর না থাকে, তবে জাতিসংঘের উপস্থিতি কোনো হুমকি নয়- বরং তা হতে পারে এক ধরনের আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। বরং দেশের বাস্তবতা পাল্টানোর রাজনীতিই হোক আমাদের অগ্রাধিকার, গা ঢাকা দেওয়ার কিংবা ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিভ্রান্ত করার চর্চা নয়।
তিন বছরের চুক্তিতে জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর আসছে। এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্র যদি মানবাধিকার পরিস্থিতির বাস্তব উন্নয়ন ঘটাতে পারে, তবে তিন বছর পর তাদের আর দরকার হবে না। তবে তার আগে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নাগরিকদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, এবং একটি স্বচ্ছ ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি।
যারা জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর খোলাকে ‘সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত’ বলে প্রচার করছেন, তাদের জ্ঞাতার্থে বলা দরকার- মানবাধিকার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক জবাবদিহি মানে দেশের অভ্যন্তরে শোষণ, নিপীড়ন ও অনিয়মকে আরও জোরালোভাবে ঢেকে রাখার সুযোগ না থাকা। আসলে যারা গুম, খুন, নির্যাতনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত বা উপকৃত, তারাই আজ সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছেন। জাতিসংঘ আসলে ওদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে- দোষ যেন পানির মতো ভেসে না ওঠে, এই আতঙ্কেই তারা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বানাচ্ছেন।
ধর্মীয় গোঁড়ামির ছায়া নিয়ে যারা নারী স্বাধীনতা, সংখ্যালঘু অধিকার কিংবা সমান সুযোগের বিরুদ্ধে আজ রাস্তায় নামছেন, তারা আসলে সেই পুরোনো ফতোয়াবাজির রাজনীতিকেই পুনরুজ্জীবিত করছেন। নারীদের ভোটাধিকার বা শিক্ষা প্রসারে যাদের মাথাব্যথা ছিল, তারাই আজ মানবাধিকারের নামে ‘পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসন’ দেখতে পাচ্ছেন। অথচ গৃহকর্মী বা শ্রমিক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে নারী পাঠাতে তাদের কোনো আপত্তি নেই- সেখানে ইসলাম বিপন্ন হয় না, হয় শুধু যখন নারী তার অধিকারের কথা বলে।
আর কিছু তথাকথিত বামপন্থি- যারা অতীতে আন্তর্জাতিক সহায়তার কাগুজে ছায়া দেখেও কেঁদে উঠতেন- তাদের এখন জাতিসংঘের দপ্তর খারাপ লাগে, কারণ এতে ক্ষমতাসীনদের চটানো হতে পারে। আদর্শ নয়, সুবিধাবাদই তাদের রাজনীতির আসল চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসলে যারা আজ জাতিসংঘের উপস্থিতি চান না, তারা চান না বাংলাদেশের মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা আন্তর্জাতিক মানদ-ে যাচাই হোক। কারণ সেটি হলে তাদের নির্মিত মিথ্যের দেয়ালটি ভেঙে পড়বে।
লেখক : সাংবাদিক, লন্ডন, যুক্তরাজ্য