প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৪ আগস্ট, ২০২৫
সাউথপোর্ট হামলার এক বছর পার হয়েছে। সেই ঘটনার পর যুক্তরাজ্যের রাস্তায় ভয়াবহ বর্ণবিদ্বেষী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল। এই দাঙ্গার সময় আমি আমার উপন্যাস দ্য সেকেন্ড কামিং-এর শেষ অংশ লিখছিলাম। এই বইয়ের কাহিনি এমন এক ভবিষ্যতের ইংল্যান্ড নিয়ে, যেখানে খ্রিষ্টান জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত একদল মিলিশিয়া লন্ডন দখল করে, ইসলাম নিষিদ্ধ করে এবং মুসলিমদের বার্মিংহামে আশ্রয়শিবিরে পাঠিয়ে দেয়। যখন আমি বইটি শেষ করছিলাম, তখন রাস্তায় যা ঘটছিল, তা দেখে মনে হচ্ছিল আমার কল্পনার জগৎ আসলে বাস্তবের জগৎ থেকে খুব বেশি দূরে নয়। আমি ছোটবেলায় যে ইংল্যান্ডে বড় হয়েছি, সেখানকার অভিজ্ঞতা দিয়ে এই কল্পনার জগৎ গড়েছি। তখন বর্ণবাদী সহিংসতা খুবই সাধারণ ছিল।
সাদা চামড়ার যুবকদের দল রাস্তায় আমাদের পেছনে লাগত। বিশেষ করে পানশালা (পাব) বন্ধ হওয়ার পর তারা বেশি উত্ত্যক্ত করত। তারা একে বলত ‘পাকি বাশিং’ (পাকিস্তানিদের ধোলাই করা)। অশ্বেতাঙ্গ লোকদের ওপর ছুরি হাতে হামলা, তাদের বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া- এসব তখন অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। ছাত্রজীবনে কতবার যে আমাকে মারধর করা হয়েছে, তার হিসাব নেই- স্কুলে, রাস্তায়, পাব বা অন্য কোনো জায়গায়। ইস্ট লন্ডনে যখন থাকতাম, তখন ব্রিকলেনের স্থানীয় তরুণদের সঙ্গে মিলে বর্ণবাদী হামলা ঠেকাতে আমাদের হাতে হাতে লড়তে হয়েছে। সে সময় আমি ও আমার কয়েকজন বন্ধু ‘বিস্ফোরক তৈরির ষড়যন্ত্র’-এর অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলাম। দুধের বোতলে পেট্রল ভরে নিজেদের রক্ষা করতেই আমরা তা করছিলাম। এ ঘটনাই পরে ‘ব্র্যাডফোর্ড টুয়েলভ’ নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়। ব্রিকলেন থেকে ব্র্যাডফোর্ডজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এসব আন্দোলন ছিল বৃহত্তর বর্ণবাদবিরোধী লড়াইয়ের অংশ। দেশে যেভাবে বর্ণবাদের চর্চা হচ্ছে, তা আসলে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক ইতিহাসেরই এক অংশ। সাম্রাজ্যবাদ যেভাবে ‘অসভ্য’ জাতিগুলোকে দমন ও শাসন করার কথা বলত, আজও সেই ধারাই চলছে। এই পুরোনো বর্ণবাদী চিন্তা আজ যুক্তরাজ্যে গভীরভাবে ফিরে এসেছে। তখনকার বর্ণবাদী সহিংসতা ভয়ংকর ছিল। সেসব সহিংসতা আসত সমাজের প্রান্তিক গোষ্ঠী থেকে। শাসকশ্রেণি যদিও অনেক সময় চুপচাপ সমর্থন দিত, তবে তারা খোলাখুলি তাদের পাশে দাঁড়াত না। কিন্তু আজ সেই দূরত্ব আর নেই।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এবং লেবার পার্টির অনেক নেতাই আজ বর্ণবাদীদের মতো কথা বলছেন। যারা যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চাইছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ও তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রাভারম্যানও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। সুয়েলা মিথ্যা দাবি করে বলেছিলেন, যৌন নিপীড়নে জড়িত গ্যাংগুলো প্রধানত ‘ব্রিটিশ পাকিস্তানি পুরুষদের দ্বারা পরিচালিত’, যাদের সংস্কৃতি নাকি ব্রিটিশ মূল্যবোধের সঙ্গে খাপ খায় না। আদতে আগের সাদা চামড়ার বর্ণবাদ এখনও আছে। শুধু তাই নয়, এখন আরও ভয়াবহ এক রূপ দেখা যাচ্ছে। সেটি হলো ইসলামবিদ্বেষ। মনে হচ্ছে যেন আগের পাকি বাশিং এখন এক নতুন ধর্মযুদ্ধের রূপ নিয়েছে, যেখানে ইসলাম মানেই সন্ত্রাস, পাকিস্তানি মানেই যৌন সহিংসতা, আর শরণার্থী মানেই দেশ দখলকারী পোকামাকড়ের দল।
এই মাটি থেকেই রিফর্ম পার্টি গড়ে উঠেছে ও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এরা এমন সব ঘৃণার রাজনীতি করছে, যা এখন গ্রহণযোগ্য ও নির্বাচিতযোগ্য হয়ে উঠেছে। যখন লেবার ও কনজারভেটিভ দুই দলই দুর্নীতিতে জর্জরিত, তখন রিফর্ম পার্টির সোজাসাপটা ও রাখঢাকহীন ভাষার মুসলিমবিরোধী ও অভিবাসনবিরোধী বক্তব্যকে ‘সততার প্রতিচ্ছবি’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ফলে এখন রিফর্ম পার্টি ৩০ শতাংশ জনসমর্থন পাচ্ছে, যেখানে লেবার পাচ্ছে ২২ শতাংশ ও কনজারভেটিভ ১৭ শতাংশ। দাঙ্গার এক বছর পর দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা একটি জরিপ চালায়। তারা জরিপে বর্ণবাদ নিয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে; কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক সংকট, দারিদ্র্য বা সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা তেমন কিছু বলেনি। সেই জরিপে দেখা গেছে, প্রায় অর্ধেক মানুষ মনে করেন, বিভিন্ন জাতি-ধর্মের মানুষ মিলে থাকা (বহুসংস্কৃতিবাদ) যুক্তরাজ্যের জন্য ভালো নয়। আর ৭৩ শতাংশ মানুষ মনে করেন, খুব শিগগির দেশে আবার জাতিগত দাঙ্গা হতে পারে। দেশে যেভাবে বর্ণবাদের চর্চা হচ্ছে, তা আসলে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক ইতিহাসেরই এক অংশ। সাম্রাজ্যবাদ যেভাবে ‘অসভ্য’ জাতিগুলোকে দমন ও শাসন করার কথা বলত, আজও সেই ধারাই চলছে। এই পুরোনো বর্ণবাদী চিন্তা আজ যুক্তরাজ্যে গভীরভাবে ফিরে এসেছে।
লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা