প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৪ আগস্ট, ২০২৫
আমাদের দেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অত্যধিক। ফলশ্রুতিতে অন্তহীন সমস্যার মধ্য দিয়ে আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিটি ঘণ্টা পার করতে হয়। ১৮ কোটি মানুষের দেশে সমস্যা সমাধানের যে গতি তারচেয়ে বাড়ার গতি বেশি। এমন কিছু সমস্যা আছে যা সমাধানের প্রতিনিয়ত চেষ্টা করা হলেও পূর্ণ সমাধান করা সম্ভব নয়। এর একটি হলো যানজট। বাংলাদেশের যানজটের বেহাল অবস্থা বুঝাতে নিচের একটি ছড়ার কটা লাইনই যথেষ্ট।
যানজটে আটকা পড়ে
জাটকা মাছের মতো
খাঁচার ভেতর অচিন পাখি
লাফায় অবিরত।
আসলেই তাই। মাঝে মাঝে এমন ভয়ংকর যানজটের সৃষ্টি হয় যাতে মুমূর্ষু রোগীর তেরোটা বাজার পাশাপাশি সুস্থ মানুষের বাজে বারোটা। ডিজিটাল যুগে মানুষ গ্রাম নামক বাপ-দাদার স্মৃতি বিজড়িত অনিন্দ্য সুন্দরে সন্তুষ্ট নয়। মানুষ আরও ভালো আরাম আয়েশের প্রত্যাশায় ছুটছে শহরে নগরে। আহা কী সুখ! মবিল পোড়া তেলের পেঁয়াজি কত মজা? ফলে বাড়ছে মানুষ, বাড়ছে যানবাহন, বাড়ছে যানজট-জনজট। গাড়ির সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে বটে কিন্তু সেই তুলনায় রাস্তা কই? জমি তো রবার নয়, টেনে হিঁচড়ে বড় করা যাবে। এরপরও তৈরি হয়েছে, এখনো হচ্ছে একতলা, দোতলা রাস্তা, মাটির নিচে টানেল, মেট্রোরেল। তবু শান্তি নেই। স্বস্তি নেই। এর ফলে প্রতিদিনই সাধারণ মানুষকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে অসহনীয় যানজটের।
এই যানজটের ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান যেমন- ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি বিপুল কর্ম ঘণ্টার অপচয়ের ফলে জাতির সার্বিক আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যানজটের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রামে একটি যানবাহন ঘণ্টায় যেতে পারে গড়ে পাঁচ কিলোমিটার। এর ফলে দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
২০১৬ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক গবেষণায় বলা হয়, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিসীমা ছিল গড়ে ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার। যানবাহনের পরিমাণ যদি একই হারে বাড়তে থাকে, তাহলে ২০২৫ সালে মানে এ বছরে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম। গত বছর আগস্টে এক গবেষণায় এসেছে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ও এর প্রভাবে সৃষ্ট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। গত সাড়ে তিন বছরে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৫ হাজার ১২০ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ২০ জন।
এই সময়ে আহত হয়েছেন ৬২ হাজার ৪৮২ জন। এই হিসাব যাত্রীকল্যাণ সমিতির। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ সালের প্রতিবেদন বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে প্রাণহানি প্রায় ২১ হাজার। এই যখন অবস্থা তখন সমস্যার দ্রুত ও কার্যকর সমাধান প্রয়োজন। তা না হলে আরও বড় ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যানজট দেখা যায় ঢাকা শহরেই। ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্বের সর্বাধিক যানজটের শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। এর আগের দুই বছর ঢাকার স্থান ছিল দ্বিতীয়, ২০১৬ সালে ছিল তৃতীয়। অর্থাৎ এই সমীক্ষা সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে, ঢাকা মহানগরের যানজট অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে। বাণিজ্যিক রাজধানী নামে খ্যাত মহানগর চট্টগ্রামের অবস্থাও একই রকম। যানজটের কবলে পড়ে মুমূর্ষু রোগীর মৃত্যুর হার বাড়ছে। যানজটের ফলে সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে না পারায় রাস্তাতেই অনেক মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। সরকার এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য নানামুখি পদক্ষেপ নিচ্ছে। রাস্তাঘাট বেড়েছে। প্রশস্ত হয়েছে। কিন্তু কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। কেন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না তা আমাদের ভাবতে হবে।
যানজটের কারণ বিবিধ। তারমধ্যে চালকদের আইন না মানা, অনিবন্ধিত ও মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি রাস্তায় নামা, দুর্বল ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, আনাড়ি চালকদের দৌরাত্ম্য, সাধারণ মানুষের নিয়ম ভাঙার প্রবণতা, কার আগে কে যাবে এই নিয়ে প্রতিযোগিতা, সেক্রিফাইসহীন মানসিকতা মোটামুটি এসব কারণের কথা সবাই বলে থাকেন। কিন্তু যানজটের বড় কারণ রাস্তাজুড়ে হকারদের অবাধ দখল। বাংলাদেশের এমন কোনো শহর, নগরের ব্যস্ততম সড়ক, মোড় নেই যেখানে হকার নেই। নতুন নির্মাণাধীন ভবনের লোহা-লক্কড়, ইট-বালি-সিমেন্ট আরামে রাখা হয় ফুটপাত ছাড়িয়ে রাস্তার ওপর। আর হকারদের তো পোয়াবারো। এরা ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসেন।
কোনো কোনো ব্যস্ততম সড়কের অর্ধেকেরও বেশি অংশজুড়ে থাকে বাহারি হকারের দোকান। এদের দাপটে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে দোকান নেওয়া প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিকমতো করতে পারেন না।
ঢাকা, চট্টগ্রামের এমন কোনো ব্যস্ততম সড়ক নেই যেখানে হকার নেই। ফলে এসব এলাকার নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে এ ফুটপাত ব্যবসা। আমরা কি যানজটমুক্ত শহর কখনও দেখতে পাবো না! নাকি এটি স্বপ্নই থেকে যাবে? যানজটমুক্ত শহরের জন্য আমাদের আগেই পরিষ্কার করে জানতে হবে ফুটপাথ তুমি কার? এই প্রশ্নের সুস্পষ্ট উত্তর ছাড়া যানজট ইহজনমে দূর করা বা কমিয়ে আনা কোনোটাই সম্ভব নয়। ফুটপাতে যারা ব্যবসা করেন তাদেরও জানতে হবে বিষয়টি।
তাদের পেটের কথা, সংসারের কথা সবাই বুঝেন, জানেন। কিন্তু ফুটপাত তো সাধারণ মানুষের হাঁটার পথ আর রাস্তা হচ্ছে যানবাহন চলাচলের জন্য। এখন কোন বিবেকে ফুটপাতে ও রাস্তা দখল করে ব্যবসা করা হয়? সরকারের উচিত নির্দিষ্ট কিছু সড়কে হকারদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। এই সুযোগ যদি ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা গ্রহণ করে ভালো, আর যদি না করে তাহলে কিছুই করার নেই। ফুটপাতে নিরাপদে চলাচল নাগরিক অধিকার। কোনো যুক্তিতেই একজন নাগরিককে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। আমরা আশা করি, যানজটে পড়ে জাটকা মাছের মতো লাফানোর মতো বেহাল অবস্থা থেকে নাগরিকদের পরিত্রাণ দিতে দায়িত্বশীলরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক