ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

জমি ও পানি প্রসঙ্গ

আব্দুল বায়েস
জমি ও পানি প্রসঙ্গ

আমার অকৃত্রিম বন্ধু বিশিষ্ট নাট্যকার (প্রয়াত) সেলিম আল দীনের ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ নাটকে আমারই অত্যন্ত স্নেহভাজন ছাত্র, সেও একজন বিখ্যাত অভিনেতা, হুমায়ুন ফরিদিকে (প্রয়াত) বলতে শুনি, ‘আমি জমি কিনি না, পানি কিনি পানি।’ পানির দরে জমি কেনা, স্বর্ণের দরে সেই জমি বেচা। জল ও জমি নিয়ে খেলা করে এমন বুদ্ধিমানদের গভীর জলের মাছও বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের বিখ্যাত আবাসন কোম্পানিগুলো পানির নিচে থাকা জমি নিয়ে জমজমাট ব্যবসা করে আসছে। সত্তরের দশকে আমার এক বন্ধু একবার তার মেস-এ দাওয়াত করল। আমার স্পষ্ট মনে আছে যে, গুলশান পেরিয়ে নৌকায় বেশ কিছুটা সফর, এ জার্নি বাই বোট বললে খুব বেশি বলা হবে না। সেই সময়কার অথই পানির উপর এখন দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে আফতাবনগর, বসুন্ধরা, বারিধারা ইত্যাদি। প্রায় একই সময়ে আমার কর্মস্থল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার ও আসার সময়ে দেখতাম রাস্তার দু’পাশে বিরাট জলাশয় (ওয়াটার বডি)। বর্ষাকালে ট্রলার দিয়ে আমিন বাজার থেকে সাভার পর্যন্ত যাওয়া যেত। এখন একটু পানির ছিটেফোঁটাও নেই- গড়ে উঠেছে আবাসন। সবাই পানি কিনছে পানি। আসতে যেতে মনটা খুব ভারী হয়ে ওঠে।

যাই হোক, একদিন পানি সরে যায়, জমি থেকে যায় জমির জায়গায়। নদীমাতৃক বাংলাদেশে মরুভূমির আচরণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফারাক্কা বাঁধ উত্তরাঞ্চলের জন্য যেন মরণ ফাঁদ। তিস্তার অভিজ্ঞতাও কম তিক্ত নয়- ‘মমতাময়ী’ মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কঠিন মন প্রাপ্য পানি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে রাখছে। সন্দেহ নেই যে পানির খুব বেশি প্রবাহ ও সময়মতো প্রাপ্তি বাংলাদেশের কৃষিকে আরও গতিশীল করতে পারত এবং সেই সূত্রে মানুষ হয়তো আরও বেশি সুখে থাকতে পারত।

গ্রামীণ জীবন-জীবিকা নাটকে জমি হচ্ছে প্রধান নায়ক। এখন না হলেও কয়েক দশক আগে তো অনেকটা তাই ছিল। এ দেশে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনাও জমিকেন্দ্রিক। জমির অংশীদারিত্ব ও কৃষিব্যবস্থাপনা বিদগ্ধ মহলের চায়ের কাপে ঝড় তুলত। ঝড় তুলবে না কেন- এক সময় গ্রামীণ খানার মোট আয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসত জমিভিত্তিক কর্মকাণ্ড থেকে; ইদানীং তা এক-তৃতীয়াংশের মতো। এত কিছুর পরও পৃথিবীর সব দেশেই উৎপাদন সংঘটনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ হচ্ছে জমি দুর্ভাগ্যবশত যেই জমি বাংলাদেশে খুবই অপ্রতুল; খানাপিছু জমির পরিমাণ আধা একরের মতো। এক হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট জমির পরিমাণ প্রায় দেড় কোটি হেক্টর (১৪.৭ মিলিয়ন) যার ৬০ ভাগ চাষের উপযোগী। ষাটের দশকে চাষযোগ্য জমির সম্প্রসারণ একপ্রকার নিঃশেষ হয়ে এসেছিল; কিন্তু বনায়ন ও চর অঞ্চলে বসতি ও দূরবর্তী দ্বীপে জেগে ওঠার কারণে ষাট ও সত্তরের দশকে চাষকৃত জমির পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি পায়। তারপর থেকে অদ্যাবধি ভারসাম্য অবস্থা বিরাজ করছে বলে মনে হয়।

বর্তমানে বিভিন্ন উৎস থেকে সীমিত জমির ওপর প্রচণ্ড চাপ অব্যাহত আছে যেমন: নগরায়ণ, সরকারি প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ, শিল্পকারখানার চাহিদা, আবাস প্রকল্প, নদীভাঙন ইত্যাদি। সময়ের বিবর্তনে শুধু জমির পরিমাণ নয়, জমির অবস্থানও আর আগের মতো নেই। যতটুকু জানা যায়, উঁচু ও নিচু জমির পরিমাণ কমে আসছে; মধ্যম জমির অংশ বেড়েছে মোট নিট জমির ৪৪ থেকে ৫৮ ভাগে। তাই আশির দশক থেকে জমি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষণীয়- একফসলি জমির হ্রাস পেয়েছে ও তিন ফসলি জমির অংশ বৃদ্ধি ঘটেছে। জমি কতটুকু ফসল দেবে তা নির্ভর করে এর উচ্চতা ও ঝুঁকির ওপর। জমির উচ্চতার হেরফের করলে শস্যের উৎপাদন, ফসল নিবিড়তা ও ফসল ধরনে ভিন্নতা সৃষ্টি হয়। কোন জমিতে কী ফসল হবে- কৃষক সে সিদ্ধান্ত নেয়, জমির উচ্চতা, বৃষ্টিপাত ও বার্ষিক বন্যার অবস্থানের চিন্তা মাথায় রেখে। এক্ষেত্রে আবার উৎপাদন বিকল্প এবং ঝুঁকি সম্পর্কিত কৃষকের ধারণা প্রভাবিত হয় ভৌত কাঠামোর দ্বারা।

জমির অবস্থানের কথায় ফিরে আসি। আশির দশকে প্রণীত জাতীয় পানি পরিকল্পনা বাংলাদেশের জমিকে চারভাগে ভাগ করেছে; যেমন- মোট জমির ৩০ শতাংশ সর্বোচ্চ বর্ষার সময়ে সর্বোচ্চ ৩০ সে.মি. পর্যন্ত প্লাবিত উঁচু জমি। সেচ সুবিধার কল্যাণে এসব জমিতে দু’টো উন্নতজাতের ধান আবাদ করা যায় এবং দু’টো ধানের মধ্যকালীন সময়ে স্বল্প স্থায়িত্বকালের একটা ডাল বা তৈলবীজ জাতীয় কখনও করা যায়। মোট চাষকৃত জমির এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে মধ্যম জমি যা বর্ষার মাসে সর্বোচ্চ ৩০-৯০ সে.মি. প্লাবিত হয়; ৬ শতাংশ জমি নিচু যা প্লাবিত হয় ৯০-১৮০ সে.মি. পর্যন্ত। এখানে শুধু একটা ফসল করা যায় (মূলত কম উৎপাদনশীল গভীর জলে ধান বা ডিপওয়াটার আমন)। সবশেষে, বাংলাদেশে প্রায় ১৬ শতাংশ জমি খুব নিচু জমি যেগুলো বর্ষা মৌসুমে কোনো ফসল আবাদ করার সুযোগ দেয় না এবং এগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে একফসলি- মাত্র বোরো ধান করা যায়- যেমন: হাওর অঞ্চল। অন্যদিকে, রাস্তাঘাট নির্মাণ, নদীর ধার ঘেঁষে বাঁধ নির্মাণের এবং বন্যার গভীরতার নিরিখে জমির প্রকারভেদ পরিবর্তন সূচিত হয়েছে।

এই পরিবর্তন শস্য উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতার ওপর ব্যাপক প্রভাব রেখেছে। তাছাড়া, ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অভিবাসন ও অকৃষিজ কর্মকাণ্ডের ব্যাপক বিস্তৃতির গ্রামীণ খানার জীবন-জীবিকার পরিবর্তন প্রভাব ফেলেছে। এগুলোর প্রভাব বোঝার জন্য একজন অর্থনীতিবিদ সংখ্যা, অনুপাত, রিগ্রেশন ইত্যাদি কঠিন সব অর্থনৈতিক শব্দ ব্যবহার করে থাকেন; কিন্তু তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘রাইকমল’ বইতে খুব সুন্দরভাবে গোটা পরিস্থিতিকে ব্যক্ত করেছেন এভাবে-

‘সে কাল আর নাই। কালের অনেক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। মাঠের বুক চিড়িয়া রেললাইন পড়িয়াছে। তার পাশে টেলিগ্রাফ তারের খুঁটির সারি। বিদ্যুৎ শক্তিবহ তারের লাইন। মেঠোপথ পাকা হইয়াছে। তাহার উপর দিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে মোটর ছুটিতেছে। নদী বাঁধিয়া খাল কাটা হইয়াছে। লোকে হুক্কা ছাড়িয়া বিড়ি-সিগারেট ধরিয়াছে। কাঁধে গামছা, পরনে খাটো, কাপড়ের বদলে ছোকরারা জামা, লম্বা কাপড় পড়িয়া সভ্য হইয়াছে। ছ-আনা, দশ-আনা ফ্যাশনে চুল ছাঁটিয়াছে। ভদ্র গৃহস্থ ঘরে হালচাল বদলাইয়াছে।’ মানুষের জন্য পানি যেমন, জমির জন্যও পানি তেমন। কথিত আছে যে, হাজার বছর আগে পানি সম্পদের প্রাচুর্য পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে এ অঞ্চলে আসতে আকৃষ্ট করেছিল, যার ফলে এই অঞ্চলটি খুব দ্রুত পৃথিবীর অন্যতম জনবসতিপূর্ণ এলাকা হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। কৃষিকাজে ব্যাপক পানি সম্পদ হলেও নানা কারণে পানি প্রায়ই পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। বিশেষত নৌ-পরিবহন ও কৃষিকে সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে উজানে ভারতের বাঁধ ও ড্যাম নির্মাণের ফলে ভূপৃষ্ঠের পানির প্রাপ্যতা হ্রাস পেয়ে কৃষিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে মরুভূমির আচরণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফারাক্কা বাঁধ উত্তরাঞ্চলের জন্য যেন মরণফাঁদ। তিস্তার অভিজ্ঞতাও কম তিক্ত নয়- ‘মমতাময়ী’ মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কঠিন মন প্রাপ্য পানি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে রাখছে। সন্দেহ নেই যে পানির খুব বেশি প্রবাহ ও সময়মতো প্রাপ্তি বাংলাদেশের কৃষিকে আরও গতিশীল করতে পারত এবং সেই সূত্রে মানুষ হয়তো আরও বেশি সুখে থাকতে পারত। তবে কথায় আছে, রাখে আল্লাহ মারে কে। এই বৈরী মনোভাব সত্ত্বেও পর্যাপ্ত বৃষ্টি ও যথোপযুক্ত ভূতাত্ত্বিক কাঠামো থাকার কারণে ভূগর্ভস্থ প্রচুর পানির প্রাপ্তি কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিয়েছে। এই দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে ১২ মিটার গভীর থেকে এবং কিছু জায়গায় ৬ মিটার নিচ থেকে পানি উত্তোলন করা যায়। তবে তারও একটা সীমা আছে। এরইমধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ফলে উত্তোলন খরচ বৃদ্ধি পেয়ে সেচ খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর্সেনিক ও বনায়ন সমস্যাও তো আছেই। নদী-নালা ও খালবিলের সংস্কার সাপেক্ষে ব্যয় সাশ্রয়ী উপায়ে ভূউপরিস্থ পানি দিয়ে সাহায্য করতে পারত; কিন্তু তার উদ্যোগ তেমন দেখা যায় না। তাছাড়া এ ব্যাপারে তেমন গবেষণাও নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেখার জন্য তারাই তহবিল জোগান দিচ্ছে, যারা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী- অর্থাৎ গরু মেরে জুতা দান করা আর কি। বাংলাদেশের সরকার তথা বিদগ্ধ সমাজ ওই তহবিলে রাখা অর্থ নিয়ে হোলি খেলায় নেমেছে। এককালের দারিদ্র্য গবেষণা দারিদ্র্য দূর করতে না পারলেও গবেষকদের দারিদ্র্য দূর করেছে, তেমনি আজকাল জলবায়ুর পরিবর্তনের অর্থে গবেষকদের অর্থনৈতিক ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে ভালোই। যাই হোক, যান্ত্রিক উপায়ে পানি উত্তোলনের ফলে ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দেরে তুই’ বলে আগের মতো বুক ফাটা চিৎকার করতে হয় না। একটু আগে বলা তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে যে পানির অবদানের কারণে হয়েছে, সে গল্প না হয় আরেকদিন বলা যাবে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট। সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত