প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৬ আগস্ট, ২০২৫
বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ দেশ। এ দেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলজুড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা, যা আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে আসছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার সুউচ্চ পর্বতমালা এবং সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট ও নেত্রকোনা জেলার টিলা অঞ্চল বাংলাদেশের ভূপ্রাকৃতিক চরিত্রকে করে তুলেছে বৈচিত্র্যময় ও মনোমুগ্ধকর।
যার অধিকাংশই টারসিয়ারি যুগে হিমালয় পর্বত উত্থিত হওয়ার সময় সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের ভাওয়াল ও মধুপুরের গড় ও উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলের কিছু জায়গা জুড়ে ঘন অরণ্যের দেখা পাওয়া যায়। বন বিভাগের তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট ভূমির ৯.৩৩ শতাংশের অধিক প্রায় ১৩ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর জায়গাজুড়ে পাহাড়ি বনভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত। একসময় এসব পাহাড়ই ছিল প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের প্রাণকেন্দ্র। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনগোষ্ঠীর জীবনধারার অভয়ারণ্য এবং পরিবেশগত ভারসাম্যের মূল কেন্দ্রস্থল। পাহাড়ি অঞ্চলের অরণ্য, ঝরনা, পশুপাখি ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের সংস্কৃতির মিলনে গড়ে উঠেছে এক অনন্য জীবনব্যবস্থা। এখানে রয়েছে গর্জন, চাপালিশ, তেলসুর, উড়িআম, ঢাকিজাম, সিভিট, সেগুন, গামার, চম্পা, জারুল, বৈলামসহ অন্যান্য স্থানীয় বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের সমাহার। এ ছাড়া পাহাড়ি বনাঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বাঁশ ও বেত জন্মে। হাতি, চিতাবাঘ, বন্যশূকর, হরিণ, বানর, উল্লুক, অজগর, উদয়ী পাকরা ধনেশ, বড় র্যাকেট ফিঙে, পাতি-ময়না, গলাফোলা ছাতারেসহ বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখির প্রধান আশ্রয়স্থল হলো পাহাড়।
এ ছাড়া পাহাড়ে বসবাস করে চাকমা, মারমা, গারো, ওরাওঁ, বক, রাখাইন, ত্রিপুরাসহ অসংখ্য ছোট-বড় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। পাহাড় শুধু প্রকৃতি নয়, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়েরও প্রতীক। আদিবাসীদের ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, নৃত্য, সংগীত ও ধর্মবিশ্বাসে এ পাহাড়ের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু কালের বিবর্তনে এ জীবনব্যবস্থা ক্রমেই বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। নির্বিচারে পাহাড় কাটা, বন উজাড়, ভূমিদস্যুদের আগ্রাসন, খনিজ আহরণ ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে পাহাড়ি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। অপ্রতুল পরিবেশ আইন, দুর্বল প্রশাসনিক নজরদারি এবং অর্থনৈতিক লোভ পাহাড়ি অঞ্চলকে করে তুলেছে ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিবেশবিধ্বংসী। বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাবার বাগান, তামাক চাষ ও বিদেশি বিনিয়োগের নামে পাহাড়ি জমি দখলের প্রবণতা বেড়েই চলেছে। এ ছাড়া পাহাড়ে পর্যটন ব্যবসা লাভজনক হয়ে ওঠায় প্রতিনিয়ত পাহাড় ও বনভূমি কেটে গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত রিসোর্ট ও পর্যটনকেন্দ্র। এতে ভূমিহীন হচ্ছে পাহাড়ে বসবাসকারী স্থানীয় মানুষরা। একদিকে বনভূমি কমছে; অন্যদিকে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হারাচ্ছে। পাহাড়ি অঞ্চলে জুম চাষ খুব জনপ্রিয়। ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড় কেটে জুম চাষ ও বসতবাড়ি নির্মাণের ফলে প্রতি বছর বর্ষায় পাহাড় ধসের ঘটনাও বেড়ে চলেছে। এছাড়া খনিজ আহরণ, শিল্পকারখানা স্থাপন, বনভূমি উজাড়, বন্যপ্রাণী হত্যার ফলে পাহাড়ি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। শুধু প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতি নয়, পাহাড়ি অঞ্চলে সামাজিক বৈষম্য, অবহেলা ও নিরাপত্তাহীনতার চিত্রও ভয়াবহ। পাহাড়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যগত সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। শিশুদের এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে চড়ে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। জরুরি চিকিৎসাব্যবস্থাও অপ্রতুল্য।
উন্নয়ন কার্যক্রমে ঘাটতি, জাতিগত সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য অবজ্ঞা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণহীন উন্নয়ন পরিকল্পনা পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জন্ম দিয়েছে চরম অসন্তোষ ও অবিশ্বাস। ফলে পাহাড়ে উন্নয়ন নয়, বরং একধরনের অব্যবস্থাপনা ও শোষণের চিত্রই স্পষ্ট হচ্ছে বারবার। অথচ চাইলে এ পাহাড়ই হতে পারে টেকসই উন্নয়নের অনন্য ক্ষেত্র।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়