ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বৈষম্যহীন সমাজের জন্য জুলাই গণঅভ্যুত্থান

ফারহানা মানিক মুনা
বৈষম্যহীন সমাজের জন্য জুলাই গণঅভ্যুত্থান

২০২৫-এ দাঁড়িয়ে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে ‘বাংলাদেশ’ মানে কী? নিঃশঙ্কোচে বলব, বাংলাদেশ মানে ফ্যাসিবাদবিরোধী যাত্রায় গড়ে ওঠা সেসব মিছিল, যেসব মিছিলে আমরা ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গসহ সব পরিচয় ভুলে হাতে হাত রেখে হেঁটেছিলাম। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মৃত্যুর সামনে বুক টান করে দাঁড়িয়ে তীব্র চিৎকারে বলেছিলাম, ‘বুকের ভেতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি, গুলি কর।’ কিংবা মিছিলে হাত উঁচিয়ে বলেছিলাম, ‘মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’। হ্যাঁ, বৈষম্যহীন একটি সমাজের জন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা সেই যাত্রার নাম ‘বাংলাদেশ’।

আর এই যাত্রাপথে তৈরি হওয়া ঐক্য হলো ‘বাংলাদেশের শিরদাঁড়া’। আমি ’৭১ দেখিনি। আমার পূর্বসূরিদের রক্তবীজ থেকে মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা ’৭১-এ জন্ম নিয়েছিল, আমরা তার ভাষা বোঝার চেষ্টা করেছি। মুক্তিসংগ্রামের সে আকাঙ্ক্ষা আমাদের সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলে। অর্থাৎ ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গভেদে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের সমমর্যাদার কথা বলে ’৭১। ১৯৯০ কিংবা তারও আগে ’৬৯, ৬৬, ৫২ এমনকি ’৪৭-এ বারবার আমাদের পূর্বসূরিরা একটি বৈষম্যহীন জাতি গঠনের সামাজিক চুক্তি করেছিল। বলেছিল, ‘রাষ্ট্র হবে সবার’। জুলাই হলো সে সময়, যে সময়ে আমাদের শত-সহস্র বছর ধরে লালন করা সেই বৈষম্যহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষা নতুন করে গর্জে উঠেছে।

যে সময় এ দেশের কিশোর-তরুণরা ফ্যাসিবাদী জালিম শোষকের অস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছে রাষ্ট্র যেন ন্যায্যতার ভিত্তিতে চলে। রাষ্ট্র যেন বৈষম্যহীন হয়, ফ্যাসিবাদী না হয়। এই কিশোর-তরুণদের অংশ হিসেবে এবং অভ্যুত্থানের একজন সংগঠক হিসেবে আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার পতন হলেও ফ্যাসিবাদবিরোধী এই লড়াই আরও বহু আগেই আমরা শুরু করেছিলাম।

সারা দেশে গুম-খুন-ক্রসফায়ার-মামলা-হামলার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ এক ফ্যাসিবাদী রাজত্ব তৈরি করেছিল আওয়ামী লীগ। এ সময়ে রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রতি তীব্র তাচ্ছিল্যের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ২০১৪, ১৮ ও ২৪ সালের কথিত ‘নির্বাচন’ তিনটি।

’২৪-এর ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে আমরা বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্রদলসহ সরকারবিরোধী ১৫টি ছাত্রসংগঠন সরাসরি হাসিনা সরকারের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্রঐক্য গড়ে তুলি। এই জোট ক্যাম্পাস ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শিক্ষার্থী-জনতাকে আহ্বান জানায় ভোট বর্জনের। আওয়ামী লীগের ক্ষমতার ঔদ্ধত্যে জনতা আঘাত করে ভোট বর্জনের মাধ্যমে। দেশের জনগণ নিজেদের মর্যাদা-অধিকারের পক্ষে অবস্থান জানান দেয়। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে রোপিত হওয়া অভ্যুত্থানের বীজ পুষ্ট হয়।

বলা চলে ’২৪-এর অভ্যুত্থান শুরু হয় জনতার সম্মিলিতভাবে ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়েই। এর মধ্যেই ঘোষণা হয় ’১৮-এর কোটা পরিপত্র বাতিলের। শুরু হয় শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ। আন্দোলনটা শুরু হয় নিছকই কোটা সংস্কারের দাবিতে। একদমই ক্ষুদ্র জায়গা থেকে গড়ে ওঠা একটা আন্দোলনকেও সইতে পারেনি আওয়ামী সরকার। প্রথমে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে তাচ্ছিল্য এবং পরে তাদের ওপর নির্বিচারে হামলা ও গুলি চলে।

রংপুরে আবু সাঈদ সেই বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়ে আমাদের পথ দেখান! সাঈদের বুকে বিদ্ধ গুলি যেন নবারুণ ভট্টাচার্যের সেই কবিতার ‘ফুলকি’, যা সারা শহর-বন্দর-গঞ্জ উথাল-পাথাল করে তুলেছিল।

সাঈদ-ওয়াসিমদের রক্তের স্রোতে লড়াইয়ের ময়দানে ভেসে আসে আপামর জনতা। সারা দেশ এক হয়ে ভাই হত্যার বিচার চাইলে আওয়ামী সরকার রাষ্ট্রের সব শক্তি প্রয়োগ করে তরুণ-কিশোরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মানুষ তার কর্তব্য বুঝে নেয়।

আন্দোলন তার রূপ পাল্টে হয়ে ওঠে ‘গণঅভ্যুত্থান’। নারায়ণগঞ্জের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়া বলা যায় গডফাদার শামীম ওসমানের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা ১৬ বছরের হিসাব চেয়েছিলাম। আবু সাঈদের পাশাপাশি আমরা হিসাব চেয়েছিলাম আমাদেরই বয়সী সেই নিষ্পাপ কিশোর ‘ত্বকী’ হত্যার। যাকে খুন করে শীতলক্ষ্যায় লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমরা হিসাব চেয়েছিলাম আশিক, ভুলু, চঞ্চল, শুভ্রসহ নারায়ণগঞ্জের সব হত্যাকাণ্ডের। কিশোরদের এই রুখে দাঁড়ানো গডফাদারের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। প্রতীকীভাবে ত্বকীরাই যেন শহরে মিছিল করছিল। পতনের আগে শামীম ওসমান তার সন্ত্রাস ও অস্ত্রবহর নিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে শহরকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। নারায়ণগঞ্জ ভয় পায়নি। উল্টো তীব্রগতিতে রুখে দাঁড়িয়েছিল।

তবে তার আগে আমরা হারাই ছোট্ট রিয়া গোপকে। শামীম ওসমানের ছোড়া গুলিতে শহিদ হয় ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপ। একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণের যে লড়াই আমাদের পূর্বপুরুষরা শুরু করেছিল, ৩৬ জুলাই তার নতুন সম্ভাবনার উন্মোচন ঘটে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে পারি জমায়। গঠন হয় অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার।

সব মতভেদ ভুলে সারা দেশ যখন এক হয়ে দাঁড়াল, ঠিক তখনই জুলাই অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো বিভক্ত হতে শুরু করল। সেই বিভক্তি রেখা স্পষ্ট করে তুলল একটি পক্ষ, যারা আওয়ামী লীগের মতো করে জুলাইয়ের মালিকানা দখলের নির্লজ্জ ও দুঃখজনক চেষ্টা চালাল। তারা নিজেদের ছাড়া সব রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক শক্তির লড়াইকে অস্বীকার করার ঔদ্ধত্য দেখাল। এর মধ্যে রাষ্ট্র বিনির্মাণের শক্তি ‘জাতীয় ঐক্য’ নষ্ট হলো। যেই জনতার রক্তের শক্তিতে শেখ হাসিনা নামক জগদ্দল পাথর সরানো হলো সেই জনতাকেই বিচ্ছিন্ন করা হলো রাষ্ট্র গঠন থেকে।

জনতার সম্মিলনের যে শক্তিতে বাংলাদেশ তার মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়েছিল, সেই মেরুদণ্ডে বারবার আঘাত শুরু হলো- কখনও মন্দির, কখনও মাজার, কখনও নারী, কখনও ভিন্ন লিঙ্গে, ভিন্ন মত-পথ-চিন্তার ওপর আঘাতের মাধ্যমে। আমরা জানি, রাষ্ট্র বিনির্মাণ নিশ্চয়ই সহজ কর্ম নয়! সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ! আমরা সেই কাজটুকু করে যেতে চাই।

যে ব্যবস্থা আমাদের অনিরাপদ রাখে, যে ব্যবস্থা নারীকে অপদস্থ করে, ভিন্ন মত-চিন্তার ওপর নিপীড়ন চালায়, মন্দির-মাজার-গির্জায় আঘাত করে, শিশুর শৈশব কেড়ে নিয়ে তাকে শ্রমিক বানায়, শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ না করে বরং তার ওপর অত্যাচার চালায়, অপরিকল্পিত কাঠামোর কবলে মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়, নিপীড়কের উল্লাসমঞ্চ হয়, যে ব্যবস্থা চর দখলের মতো জনতার ইতিহাস দখলে নিতে চায়, রক্তের অমর্যাদা করে, শহিদের সঙ্গে বেঈমানি করে- সেই ব্যবস্থা ভেঙে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে তোলাই এখন আমাদের কর্তব্য।

সব ভেদ ভুলে যে ‘মানুষ’ পরিচয় বাংলাদেশের শিরদাঁড়াকে গঠন করেছে, আমরা সেই মানুষের সমাজ বিনির্মাণের লড়াইয়ে শপথবদ্ধ। জুলাই অভ্যুত্থানের বছরপূর্তিতে আমরা শপথ করছি : একাত্তরের আকাঙ্ক্ষা এবং জুলাইয়ের আত্মত্যাগকে কেউ ধ্বংস করতে পারবে না। কেউ যদি আকাঙ্ক্ষার সেই পতাকা নামিয়ে দেয়- কোনো না কোনো তরুণ সেই পতাকা আবার তুলে ধরবে। আবারও এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ বুকের পাঁজর দিয়ে অন্যায়-জুলুমের বিরুদ্ধে ব্যারিকেড গড়ে তুলবে।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন নারায়ণগঞ্জ জেলা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত