প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৯ আগস্ট, ২০২৫
ড. নওয়াজেশ আহমদ তার ‘মহাবনস্পতির পদাবলী’ বইয়ে কুঞ্জলতার গুঞ্জরণ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘পুরান ঢাকার বিরাট এলাকায়- লালবাগ থেকে সূত্রাপুর, গাছগাছালির সবুজ ছাউনি প্রায় চোখেই পড়ে না। অলিগলি কংক্রিটের জঙ্গলে ভর্তি, তার ওপর নোংরা রাস্তাঘাট, বসতি, খোলা নর্দমা আর পায়খানা, ধুলোবালি- এককথায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। এর মধ্যে এক খণ্ড সবুজ দ্বীপের বিশেষ প্রয়োজন।’ কয়েক দশক আগে রাজধানী ঢাকা ছিল সবুজে ঘেরা এক স্নিগ্ধ নগরী। কিন্তু কালের বিবর্তনে ঢাকা যেন আজ বৃক্ষশূন্য, বিবর্ণ নগরী। অপরিকল্পিত নগরায়ণের মাধ্যমে নগরীর বুক চিরে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় দালানকোঠা। আমাদের অতিরিক্ত লোভ এবং আগ্রাসী মনোভাবের কারণে নগরীতে উল্লেখযোগ্য হারে কমছে গাছপালা; দিনদিন ঢাকা যেন মৃত নগরীতে পরিণত হচ্ছে। রাইজিং টাইডস, বোরিং ফিউচার্স: দ্য সুন্দরবনস কোয়েস্ট ফর সারভাইভাল-২০২৪’ শীর্ষক গবেষণা মতে, ১৯৭৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ দশকে সুন্দরবনের ঘন বনাঞ্চল ২৭ ভাগ কমেছে। ৯০ শতকের প্রায় ৩৬ শতাংশ বৃক্ষশোভিত এই মহানগরীতে বর্তমানে উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় গাছ রয়েছে মাত্র ১৪ শতাংশ (ইউএস এইড জরিপ, ২০২২) এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১০ শতাংশেরও কম। অথচ একটি নগরে জনজীবনের জন্য ৩০-৪০ শতাংশ সবুজায়ন জরুরি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসেব মতে, বাংলাদেশে বার্ষিক ২ দশমিক ৬ শতাংশ হারে বন উজার হয়েছে যা বার্ষিক বৈশ্বিক গড় হারের প্রায় দ্বিগুণ।
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ঢাকা মহানগরীতে অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যাই ৯৪ শতাংশেরও বেশি। শুধু ঢাকা নয়, বাংলাদেশের সর্বত্রই এরূপ অবস্থা। পুঁজিবাদের অভিশপ্ত আশীর্বাদে আমরা নিজের বিবেক বিসর্জন দিয়ে অর্থ আয় করছি পরিবেশের জীবনের দামে।
সবুজে ঘেরা এই বাংলাদেশে এখন সবুজ পাওয়াই বরং আমাদের আশ্চর্য করে। আমরা গাছ কেটে সভ্যতা গড়ি, টাকা উপার্জন করি, আবার সেই টাকায় পার্ক তৈরি করে নিজেকে একটু সতেজ করতে যাই।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের উচিত নগর পরিকল্পনায় সবুজের জন্য নির্ধারিত জায়গা বাধ্যতামূলক করে প্রতিটি ভবন ছাদবাগান, ব্যালকনিতে উদ্যানের মতো ধারণা বাস্তবায়ন করতে হবে। অনুমোদনহীন ভবনের বিরুদ্ধেও আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। তাছাড়া, অবৈধ গাছ কাটার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ প্রয়োজন। সরকারি প্রকল্পেও গাছ কাটার ক্ষেত্রে পুনঃরোপণের বিধান থাকা উচিত।
নগরে খালি জায়গা, পার্ক, খেলার মাঠ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে শহরের মধ্যেই ছোট ছোট ‘আরবান ফরেস্ট’ তৈরি করতে হবে। এছাড়া, আইন প্রনয়ণ দ্বারা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বন উজাড় ও গাছ নিধনের উপর নজরদারি জোরদার করে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, আমাদের সবার। গণমাধ্যম, শিক্ষাব্যবস্থা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান- সব জায়গা থেকে পরিবেশের গুরুত্ব নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। নয়তো শিগগিরই আমরা এক মৃত নগরীতে বাস করব। যেখানে বেঁচে থাকাই দুষ্কর হবে।