ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গাজায় মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ

জিয়াউদ্দিন সাইমুম
গাজায় মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ

অবশেষে পরিকল্পিত প্রচারণার কুয়াশা ভেদ করে ছবিগুলো আলোর মুখ দেখছে। গাজার ক্ষুধার্ত শিশুদের হাড্ডিসার পাঁজরের অসহ্য তীক্ষ্ণতা দ্য ডেইলি এক্সপ্রেস থেকে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পর্যন্ত প্রথম পাতায় স্থান পেয়েছে। সাহায্য সংস্থাগুলো এখন কয়েক মাস ধরে যা বলে আসছে : ‘গাজায় এটি কোনো মানবিক সংকট নয়। এটি একটি মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ। এটি গণহত্যা।’

বিলম্বে হলেও জাতিসংঘ সমর্থিত ইন্টেগ্রিটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) একটি জরুরি সতর্কতা জারি করেছে : ‘গাজা উপত্যকায় দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।’ খাদ্য গ্রহণের হার এবং তীব্র অপুষ্টির জন্য দুর্ভিক্ষের সীমা এরইমধ্যে পার হয়ে গেছে। অনাহারের পাশাপাশি রোগও ত্বরান্বিত হচ্ছে।

কিন্তু মুক্তবিশ্বের স্বঘোষিত নেতারা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখালেন? তারা বেশি কিছু করেননি। স্রেফ তিনটি উপভাষায় ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার স্বাক্ষর এঁকে দিলেন। তাদের প্রতিক্রিয়া বন্দুকের নলের মুখে সামাজিক প্রকৌশল ছাড়া আর কিছু নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্টভাবে বলপ্রয়োগের ভঙ্গিটি ফুটিয়ে তুলেছেন। গাজার কঙ্কালসার শিশুরা যখন পর্দার সামনে নির্মম ক্ষুধায় হাহাকার করছিল, ট্রাম্প তখন চোখ পিটপিট না করেই অবলীলায় মিথ্যা বলে গাজায় দুর্ভিক্ষের কথা অস্বীকার করেছেন। ট্রাম্পের উদাসীনতা ছিল বড়ই অবজ্ঞাপূর্ণ। গাজাবাসীর জন্য তার চোখে ঘৃণাই ছিল শেষ কথা। হামাস তো ঠিক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দাবির মতোই প্রস্তাব করেছিল: জাতিসংঘের নেতৃত্বে খাদ্য বিতরণ, বেসামরিক এলাকা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার এবং জিম্মিদের বিনিময়ে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি। কিন্তু ওয়াশিংটন ও তেল আবিবের জন্য এটি অনেক বেশি ‘মানবিক’ ছিল। তথাকথিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ), একটি ইসরায়েলি-আমেরিকান ব্যর্থ ‘মানবিক’ প্রকল্প, যাকে গাজায় খাদ্য সরবরাহের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়েছিল। পরিবর্তে, এটি হত্যার অঞ্চলগুলো চিহ্নিত করতে সহায়তা করেছিল।

ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা গেছে, ফিলিস্তিনিদের ‘পুনরায় শিক্ষিত’ করার জন্য দুই বিলিয়ন ডলারের ‘ট্রানজিট ক্যাম্প’ তৈরির মাধ্যমে পাওয়ার পয়েন্টে ঔপনিবেশিকতার রিব্র্যান্ড করতে হবে। ত্রাণ নয়, বরং বন্দুকের মুখেই এই সামাজিক প্রকৌশল রচিত হবে। ট্রাম্প কেবল গাজায় ‘গণহত্যা’ প্রসঙ্গ এড়াতে চাইছেন না; তিনি জেফ্রি এপস্টাইনের ছায়া থেকেও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ট্রাম্পের মহাবিশ্বে তো ফিলিস্তিনিরা নেহাত অচ্ছুত। তিনি শুধু সম্পত্তির মূল্য এবং ডিনার রিজার্ভেশন দেখেন। পৃথিবীর বাকি সবকিছু তার বিবেচনায় ব্যয়যোগ্য। ট্রাম্প বোঝাতে চেয়েছেন, ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রাখার জন্য, রাতে পুড়িয়ে দেওয়া তাঁবুর জন্য এবং মার্কিন বোমায় গাজার শিশুরা ছিন্নভিন্ন হওয়ার জন্য ফিলিস্তিনিদের উচিত ট্রাম্পের বরাবরে ‘থ্যাংক ইউ’ কার্ড পাঠানো। তিনি গাজায় এমন খাবারের প্রশংসা চান, যা কখনও সেখানে পৌঁছায়নি এবং যে নীতিগুলো গাজায় খাদ্য পৌঁছাতে বাধা দিয়েছে, তার জন্য ইসরায়েলের দায়মুক্তিও চান। ট্রাম্পের পেছন পেছন হাঁটছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্টারমার, যিনি নরম ভেটোর মেজোকর্তা। যেখানে ট্রাম্প চিৎকার করেন, স্টারমার সেখানে ইশারা করেন। হাজার হাজার ব্রিটিশ যখন গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য স্লোগান দিচ্ছিল, তখন তিনি ব্রিটেনে আহত কয়েকজন ফিলিস্তিনি শিশুর চিকিৎসার জন্য একটি পালিশ করা ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন। অসাধারণ মানবিক তিনি! স্টারমারের এই সংযত সুরের পেছনে রয়েছে ইসরায়েলের প্রতি বিস্ময়কর সহযোগিতা। স্টারমার ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করার জন্য কিছুই করেননি, যার মধ্যে এফ-৩৫ জেটের যন্ত্রাংশও রয়েছে। তিনি বিমান থেকে খাবার ফেলে দেওয়ার কথা এমনভাবে বলেন, যেন তিন হাজার মিটার দূর থেকে খাবার ছুড়ে ফেলা শুধু একটি ছবির অপশনের চেয়েও বেশি কিছু। এই খাবার যতবারই খাওয়ানো হোক না কেন, গাজার ক্ষুধার্ত শিশুটি যেন মারা যায়। স্টারমার যুক্তিসংগত ব্যক্তির ভূমিকায় চমৎকার অভিনয় করেন- নিরেট ভারসাম্যময়, কোনো চাপ নেই, যেন একটি সুশৃঙ্খল বিবৃতি রাফাহর চিৎকারকে এখনই থামিয়ে দেবে। ব্রিটেন কেন পদক্ষেপ নেবে না, জানতে চাইলে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেন, আমাদের অবশ্যই আমেরিকাকে অনুসরণ করতে হবে। তারা সম্ভবত ভুলেই গেছেন, যখন ট্রাম্প ইউক্রেন ত্যাগ করেছিলেন, তখন ব্রিটেন একাই নেতৃত্ব দিয়েছিল।

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত