প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১১ আগস্ট, ২০২৫
আজ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই চলছে মানবতার ওপর চরম জুলুম। হাল জামানায় দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর অনেক দেশেই হক কথা বলার কারণে অনেক বরেণ্য আলেমে-দ্বীনের উপর চরম নির্যাতন ও জুলুম চলছে। তাদের অনেককেই দীর্ঘদিন কারাগারে আটকে রেখে রিমান্ডসহ অমানুষিক নিপীড়ন চালাচ্ছে স্বৈরশাসক। আল্লাহর কোরআন ও হাদিসের সঠিক ও নির্ভুল তাফসির করার অপরাধে পৃথিবীর অনেক দেশে আলেমণ্ডওলামাদের চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তাদের অনেককেই অকথ্য নির্যাতন, নিপীড়ন, ডান্ডাবেরি পরিয়ে হাজিরা দেওয়ার নামে অমানবিক জুলুম চালাচ্ছে। আল্লাহর কোরআনের খাদেমদের বছরের পর বছর কারারন্তীন রেখে মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হচ্ছে। এই জুলুমের শেষ কোথায়? মজলুমের আর্তনাদ যেন আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠছে। মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর নিজের জন্য জুলুম হারাম করে নিয়েছেন এবং তা মানুষের জন্যও হারাম ঘোষণা করেছেন। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, হযরত আবু যার (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘আমি নিজের উপর ও বান্দাদের উপর জুলুম হারাম করে নিয়েছি। অতএব, তোমরা পরস্পরের উপর অত্যাচার কর না (মুসলিম ৬৪৬৯)।
জুলুম তিন প্রকার
এক : আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা। আর এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় জুলুম। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, আর স্মরণ করুন, যখন হযরত লোকমান উপদেশ দিত গিয়ে তার বৎসকে বলেছিলেন, হে আমার প্রিয় বৎস, আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক কর না। নিশ্চয় শিরক মহাপাপ (সূরা লোকমান ১৩)।
দুই : বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে নিজের প্রতি জুলুম করা। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বস্তুত যারা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমালঙ্ঘন করবে, তারাই জালিম’-(সূরা বাকারা ২২৯)।
তিন : আল্লাহর সৃষ্টি ও তাঁর বান্দাদের উপর জুলুম করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ। অতপর যে ক্ষমা করে দেয় ও আপোষ নিষ্পত্তি করে তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে আছে। নিশ্চয় তিনি জালিমদের পছন্দ করেন না’ সুরা আশশূরা ৪০। সবচেয়ে ঘৃণিত পাপ হচ্ছে অন্যের ওপর জুলুম করা। জালিম তার জুলুমের পরিণতি দুনিয়াতে ভোগ করবে আর পরকালের শাস্তি আরও ভয়াবহ। জুলুমের পরিণতি দুনিয়াতেও ভোগ করতে হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘অবশ্যই মহান আল্লাহ জালিমদের সুযোগ দেন। এরপর তিনি যখন তাকে পাকড়াও করেন, তখন তাকে ছাড়েন না। আল কোরআন বলছে, ‘তোমার রব যখন কোনো জনপদকে তাদের অধিবাসীদের জুলুমের কারণে পাকড়াও করেন, তখন তার পাকড়াও এমনিই হয়, অবশ্যই তার পাকড়াও অত্যন্ত কষ্টদায়ক, অত্যন্ত কঠোর’। জালেমরা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। হযরত জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বলেছেন, ‘আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন না, যে মানুষের প্রতি দয়া করে না’ (সহীহ বুখারি ৭৩৭৬)। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সাবধান জালিমদের উপর আল্লাহর লানত (সুরা হুদ ১৮)। মহান আল্লাহতায়ালা জালিমদের দুনিয়াতে লাঞ্চিত ও অপদস্ত করে থাকেন। এটি আল্লাহতায়ালার নিয়ম। যুগে যুগে আল্লাহতায়ালা বিভিন্ন জালিম সম্প্রদায় ও অত্যাচারীদের লাঞ্চিত ও অপদস্ত করেছেন। সুরা ইব্রাহীমের ১৩নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘কাফিররা নবীদের বলেছিল, আমরা তোমাদের দেশ থেকে বের করে দিব নয়তোবা তোমরা আমাদের ধর্মে ফিরে আসবে। তখন তাদের কাছে তাদের রব অহি পাঠালেন যে, আমি জালিমদের অবশ্যই ধ্বংস করে দেব’। এই পৃথিবীর মাটির নিচে অনেক শক্তিশালী সভ্যতার জনপদ আল্লাহতায়ালা ধ্বংস করে দিয়েছেন শুধুমাত্র তাদের জুলুমের কারণে। শক্তিশালী আদ, সামুদ, লুত, ফেরাউন, নমরুদ জাতিকে আল্লাহতায়ালাকে অস্বীকার ও তাঁর রাসুলদের (সা.) কে অস্বীকার করার কারণে জনপদের পর জনপদ ধ্বংস করে দিয়েছেন। উল্টিয়ে দিয়েছেন অনেক জনপদকে, নূহ জাতিকে ৬ মাস পানির নিচে রেখেছেন। অথচ সেই সভ্যতার উপর দাঁড়িয়ে আমরা বিশালাকায় ইমারত নির্মাণ করছি, ‘অথচ তোমরা তাদের বাসভূমিতেই বাস করতে, যারা নিজেদের উপর নিজেরা জুলুম করেছিল এবং আমি তাদের প্রতি কি ধরনের আচরণ করেছিলাম তাও তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট ছিল, তোমাদের জন্য আমি তাদের দৃষ্টান্ত বারবার উপস্থাপন করেছিলাম’ সুরা ইব্রাহিম ৪৫।
পৃথিবীর এক অত্যাচারী শাসক ফেরাউন। তার পরিণতি মহান আল্লাহতায়ালা এভাবেই বর্ণনা করেছেন, ‘অতপর আমি তাকে ও তার বাহিনীকে পাকড়াও করলাম এবং তাদের সাগরে নিক্ষেপ করলাম। অতএব, জালিমদের পরিণতি কেমন হয়েছিল’ সুরা কাসাস ৪০। জালিমরা কখনও সফল হয় না, সফল হতে পারে না। সাময়িকভাবে সে নিজেকে সফল মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে সে কখনও সফল হতে পারে না এবং সঠিক পথও পায় না। আল্লাহতায়ালা তাঁর কোরআনে বলছেন, ‘তার চাইতে বড় জালেম আর কে আছে, যে স্বয়ং আল্লাহতায়ালার উপর মিথ্যা আরোপ করে : কিংবা তাঁর আয়াতগুলো অস্বীকার করে, আসলে জালেমরা কখনও সাফল্য লাভ করে না’ সুরা আনয়াম ২১। জালেমদের কাছ থেকে আল্লাহতায়ালা বরকত ছিনিয়ে নেন এবং তার সম্পদ ও সন্তানের জীবনের বরকত কেড়ে নেওয়া হয়। যে সমাজে অত্যাচার ছড়িয়ে পড়ে, সে সমাজ থেকে আল্লাহতায়ালা বরকত ছিনিয়ে নেন এবং সেখানে বিভিন্ন রোগব্যাধি ছড়িয়ে দেন। জালিমদের উপর মজলুমের দোয়া পতিত হয়। মজলুমের অসহায় আর্তনাদের গোঙানি আরশে আজিমে চলে যায়। হাদিসে এসেছে, মজলুম ও আল্লাহর মধ্যে কোনে পর্দা থাকে না। তার আবেদন আল্লাহতায়ালা সরাসরি গ্রহণ করে নেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা:) কে ইয়েমেনে পাঠান তখন তাকে বলেন, ‘মজলুমের ফরিয়াদকে ভয় করবে। কেননা, তাঁর ফরিয়াদ ও আল্লাহর মধ্যে কোনো পর্দা থাকে না’ (সহীহ বোখারি ২৪৪৮)। সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে জুলুমের শিকার এক চরম পরাকাষ্টা আমরা দেখেছি। সেটি হল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফুলপরি খাতুনের উপর ছাত্রলীগ নামধারী ছাত্রী সন্ত্রাসীরা নির্মম শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার চালিয়েছে, বিবস্ত্র করে দেওয়া হয়েছে আর সেটার প্রতিফলন হিসাবে তাদের হল থেকে চিরস্থায়ী বহিষ্কার এবং দল থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। এ তো দুনিয়ার সাজা কিন্তু পরকালের সাজা তো আরও ভয়াবহ। এভাবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র্যাগিং এর নামে নিরীহ শিক্ষার্থীদের উপর চলছে চরম নির্যাতন আর এটাই হচ্ছে জুলুম। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের জালিমদের হাত থেকে রক্ষা করুন- আমিন।
লেখক : সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি) রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল