প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৪ আগস্ট, ২০২৫
নিউইয়র্ক টাইমস গত ২ আগস্ট এক প্রতিবেদনে বলেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনার জন্য ভারতের ওপর শুল্কারোপ করা হলেও ভারত রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ রাখবে না। আরও বড় জবাব হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে নতুন অস্ত্র ও বিমান কেনার পরিকল্পনাও আপাতত স্থগিত করেছে দেশটি। ভারতের তিন সরকারি কর্মকর্তার বরাতে জানা গেল, ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের রপ্তানিপণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের পর সম্পর্ক কয়েক দশকের মধ্যে এখন সবচেয়ে নাজুক হয়েছে। অস্ত্র ও বিমান কেনা স্থগিত করা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম বড় ধরনের অসন্তোষের প্রকাশ।
দুই ভারতীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। একজন কর্মকর্তা জানালেন, ভারত সরকার ‘তেল কোম্পানিগুলোকে রাশিয়া থেকে আমদানি কমানোর কোনো নির্দেশনা দেয়নি।’ ট্রাম্প গত ৩০ জুলাই এই মর্মে হুমকি দেন যে, ভারত যদি রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ না করে, তবে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন। তবে ১ আগস্ট তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি জানি না এটা সত্য কি না, তবে শুনেছি ভারত আর রাশিয়া থেকে তেল কিনবে না।’ এর আগে ট্রাম্প ভারতের সমালোচনা করে বলেছিলেন, তারা ‘অন্যায়ভাবে’ রাশিয়ার তেল কিনছে। তিনি ভারতের ওপর দুই দফায় মোট ৫০ শতাংশ শুল্কারোপ করেন। কে রাশিয়ার তেল কিনছে?
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রধান তিন ক্রেতা হলো চীন, ভারত ও তুরস্ক। এর মধ্যে ভারতের অংশই সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে ভারত চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ। রাশিয়া ভারতের সবচেয়ে বড় তেল সরবরাহকারী। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ভারত রাশিয়া থেকে দৈনিক ৬৮ হাজার ব্যারেল তেল আমদানি করলেও জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ লাখ ২০ হাজার ব্যারেলে। সর্বোচ্চ সময়ে এই পরিমাণ ২০ লাখ ব্যারেল ছাড়িয়েছে, যা কখনও কখনও চীনের চেয়েও বেশি।
ডিসকাউন্টে কেনা রাশিয়ার তেল ভারতের মোট তেল আমদানির ৪০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। ভাবুন তো, রাশিয়ার তেল বন্ধ করে দিলে ভারতের জ্বালানি সরবরাহ ও সমগ্র অর্থনীতির কী অবস্থা হবে? ট্রাম্প ভেবেছেন, ভারতের পরিস্থিতি নাজুক, চাপ দিলেই তারা রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করে দেবে; কিন্তু তিনি ভুল ভাবছেন। এখানে শুধু অর্থনৈতিক স্বার্থই নয়, জটিল ভূ-রাজনৈতিক কারণও জড়িত।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো হলেও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরো গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি। স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র। ভারতের বেশির ভাগ অস্ত্রই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে এসেছে। তা ছাড়া পুতিন ও মোদি দীর্ঘদিনের বন্ধু। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, ‘বিশ্বরাজনীতিতে ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক একটি অপরিবর্তনীয় ধ্রুবক।’ পশ্চিমা গণমাধ্যমের মতে, জ্বালানি, প্রতিরক্ষা, পরমাণুশক্তি ও কূটনীতির মতো কৌশলগত ক্ষেত্রে ভারত ও রাশিয়ার পারস্পরিক গভীর নির্ভরতা শুধু শুল্কের মতো অর্থনৈতিক চাপে ভাঙার নয়। এর মানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অতিরিক্ত শাস্তি’ ভারতের কৌশলগত সিদ্ধান্ত বদলাতে পারবে না। কারণ এই সম্পর্ক ছিন্ন করা ভারতের জন্য আরো বড় ক্ষতির কারণ হবে।
এছাড়া উভয় পক্ষের মতবিরোধ এই প্রথম নয়। এর আগে ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, তাঁর মধ্যস্থতা ও চাপের কারণেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়। ভারত এই দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে জানায়, কোনো বহিঃশক্তি যুদ্ধবিরতিতে ভূমিকা রাখেনি। ট্রাম্প আরো বলেছিলেন, ‘ভারত রাশিয়াকে কীভাবে সাহায্য করে তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই, তারা একসঙ্গে তাদের মৃত অর্থনীতিকে ভেঙে ফেলুক।’ এটি ছিল ভারতের প্রতি প্রকাশ্য অবমাননা।
সবশেষে তিনটি বিষয় বিবেচ্য-
১. ট্রাম্পের ধারণা ভুল। তিনি ভেবেছেন, চাপ দিলেই ভারত রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করবে। কিছু ক্ষেত্রে শুল্ক কাজে লাগতে পারে, কিন্তু কিছু সম্পর্কে শুল্কের কোনো প্রভাব নেই। এখন ট্রাম্প বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। তিনি তাঁর হুমকি বাস্তবায়ন করবেন কীভাবে?
২. কৌশলগত ভারসাম্য ভেঙে পড়ছে। ব্লুমবার্গ-এর ভাষায়, আগে ভারত ভূ-রাজনীতির ‘মধুর স্থানে’ ছিল- একদিকে কোয়াড গ্রুপিংয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, অন্যদিকে ব্রিকস-সদস্য হিসেবে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গেও সহযোগিতা বজায় রেখেছে। ‘মোদি একদিন হোয়াইট হাউসে অতিথি হচ্ছেন, আবার পরের দিন পুতিনের সঙ্গে রাশিয়ায় বৈঠক করছেন। কিন্তু ট্রাম্প এই ভারসাম্য ভেঙে দিচ্ছেন।’
৩. ভারতের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই দ্বন্দ্বে নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া। যেমন- কানাডা দেখেছে, যুক্তরাষ্ট্র জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক বসালেও কানাডা সর্বদা যুক্তরাষ্ট্রের পাশে থাকার পরও ৩৫ শতাংশ শুল্কের শিকার হয়েছে। কানাডার সাবেক কর্মকর্তা ব্রায়ান ক্লাফ বলেছেন, অন্যান্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আপস করলেও, কানাডা এখন ‘একা যুদ্ধ’ করছে। দুঃখের বিষয়, এখন চীনের মতো কানাডাই একমাত্র দেশ, যে এই প্রেসিডেন্টের (ট্রাম্প) বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পেরেছে। এখন সেই তালিকায় ভারতও যোগ দেবে কি? এটা একটা প্রশ্ন বটে।
লেখক : সাংবাদিক, সিএমজি বাংলা