প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২২ আগস্ট, ২০২৫
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিপথ গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য সাফল্য প্রদর্শন করেছে। তবে দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতার ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিও দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে লক্ষ্যণীয় হয়েছে; যা অর্থনীতিকে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্রবৃদ্ধি শুধু একটি পরিসংখ্যানের টেবিলে ওঠানামা করা সংখ্যা নয়; বরং এটি হলো জাতীয় স্বপ্ন, প্রজন্মান্তরের আশা ও ঐতিহাসিক গতিপথের অনিবার্য নির্ণায়ক। এটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রশ্ন, যা নির্ভর করে সুশাসন, প্রাতিষ্ঠানিক দৃঢ়তা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতার ওপর। সেই ভিত্তিতে ফাটল ধরলে অর্থনীতি আর শুধু অর্থনীতি থাকে না, এটি পরিণত হয় অন্তর্দ্বন্দ্ব, অব্যবস্থাপনা ও অনিশ্চয়তার বেড়াজালে। দুর্নীতি কোনো একক অপরাধ নয়, বরং এটি একটি বিস্তৃত কাঠামোগত বিকৃতি। এর অন্তর্ভুক্ত ঘুষ, স্বজনপ্রীতি, সম্পদ আত্মসাৎ, নীতিনির্ধারণে গোষ্ঠীগত প্রভাব, সরকারি অর্থের অপব্যবহার, যা প্রত্যক্ষভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে অকার্যকর করে তোলে। অন্যদিকে অস্বচ্ছতা হলো তথ্যের অপ্রকাশ ও অপারদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে দুর্নীতিকে সহায়তা করার প্রক্রিয়া। এ দুই উপাদান একত্রে অর্থনীতিকে এমন এক দুষ্টচক্রে আবদ্ধ করে, যেখানে উৎপাদনের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়, কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা সীমিত হয় এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এ দুষ্টচক্রের প্রতিচ্ছবি রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যায়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতি উপলব্ধি সূচক (CPI) ২০২৪-এ বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫১তম স্থানে অবস্থান করছে, যার স্কোর মাত্র ২৩, গত বছরের তুলনায় ১ পয়েন্ট হ্রাস পেয়েছে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি লজ্জা; বিদেশি বিনিয়োগকারীর আস্থা, বৈদেশিক সাহায্যের ধারাবাহিকতা এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার ওপর এক বিশাল ধাক্কা। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, কোনো অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো বিনিয়োগ। কিন্তু যখন বিনিয়োগকারীরা দেখেন, প্রশাসনিক জটিলতা অতিক্রম করতে ঘুষ অপরিহার্য অথবা প্রকল্প অনুমোদনের জন্য রাজনৈতিক সংযোগ অপরিহার্য, তখন তারা দুর্নীতিতে জর্জরিত দেশগুলোতে বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকে এবং আগে কোনো বিনিয়োগ থাকলেও সেটা উঠিয়ে নেন। তারা ঝুঁকির চেয়ে নিরাপত্তাকে অধিক অগ্রাধিকার দেন। ফলে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (FDI) হ্রাস পায় এবং প্রবৃদ্ধির শিকড়ে আঘাত করে। আরও হতাশার বিষয় হলো, এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে গড় ব্যয় আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় ৩০-৪০ শতাংশ বেশি। এ তথ্য প্রমাণ করে যে, দুর্নীতি শুধু নৈতিক অবক্ষয় নয়, এটি অর্থনৈতিক ব্যয়বহুল এক মহামারি।
দুর্নীতির ক্ষতিকর প্রভাব সর্বাধিক প্রতিফলিত হয় অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়নে। যখন একটি রাস্তা নির্মাণে ঘুষের কারণে ব্যয় বৃদ্ধি পায়, তখন একই অর্থের কম ব্যয়ে অন্যান্য দেশে রাস্তা তৈরি হয়। যখন একটি স্কুল নির্মাণে বরাদ্দ অর্থ আত্মসাৎ হয়, তখন প্রজন্মের শিক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যখন স্বাস্থ্য খাতে নিম্নমানের সরঞ্জাম কেনা হয় উচ্চপদস্থের কমিশন, কারচুপির কারণে, তখন জনগণের জীবন সরাসরি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। এসব ক্ষয়ক্ষতির অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব নয়; কিন্তু এর প্রভাব প্রতিদিনের উৎপাদনশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধিতে অবিসংবাদিতভাবে প্রতিফলিত হয়। এ অবস্থায় বাংলাদেশ যদি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDGs) অর্জন করতে চায়, তবে তাকে দুর্নীতিকে শুধু নৈতিক ব্যর্থতা নয়, অর্থনৈতিক হুমকি হিসেবে স্বীকার করতে হবে। পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পুরো সিস্টেমের গোড়া থেকে দুর্নীতির শিকড়কে অপসারণ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, যা দুর্নীতি দমন কমিশনকে প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন ও ক্ষমতাশালী করে তুলবে। আরও প্রয়োজন প্রশাসনিক সংস্কার, যেখানে ডিজিটাল গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে মানবিক হস্তক্ষেপ কমিয়ে আনা হবে, যাতে ঘুষের সুযোগ সংকুচিত হবে।
এ প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, যেখানে দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করলে সাংবাদিককে ভয় দেখানো হবে না, বরং তাকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। পাশাপাশি আমাদের সামাজিক ও মানসিকতার পরিবর্তন অতীব জরুরি। যদি কোনো সমাজে দুর্নীতি এতটাই বিস্তার লাভ করে যে, তা একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়, তখন আইন ও নীতি কখনোই তা দমন করতে সক্ষম হয় না। এ অবস্থায় সবাইকে এখনই সোচ্চার হতে হবে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে দুর্নীতিবিরোধী সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করতে হবে যেন তারা ঘুষ বা অনিয়মকে সুবিধা নয়, লজ্জা হিসেবে দেখে। বাংলাদেশ যদি টেকসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগোতে চায়, তবে দুর্নীতিবিরোধী লড়াইকে শুধু আইন বা নীতিপর্যায়ে নয়, জাতীয় চেতনার অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, স্বচ্ছতা কোনো বিলাসিতা নয়; এটি মৌলিক অর্থনৈতিক অবকাঠামো, যার অনুপস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি শুধু কাগজ-কলমে থেকে যাবে, বাস্তবের মাটিতে তা হবে অবাস্তব। এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। মুখ থুবড়ে পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতি; যা কখনওই কাম্য নয়।