প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
লেখক হলো সমাজের বিবেক। যিনি কলম ধরে সমাজের অন্ধকারকে আলোকিত করেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে শব্দ উচ্চারণ করেন, ইতিহাসের গোপন সত্যকে প্রকাশ্যে আনেন- তারাই মূলত সমাজের জীবন্ত শিকড়। কিন্তু বাস্তবতা নির্মম। যিনি কলম ধরে মানুষের হৃদয় জাগান, তার ঘরে হয়তো অন্নের অভাব, ওষুধের অভাব, সন্তানদের পড়াশোনার ব্যয় বহন করতে পারেন না। আমি নিজেই সেই দরিদ্র লেখকের একজন। পেটে পাথর চাপা দিয়ে লিখে যাই, শব্দের বিনিময়ে কখনো অর্থ পাই না। কখনও পাঁচ টাকা মিললেও যে আনন্দ হয়, সেই আনন্দও আমাদের মতো অসংখ্য লেখক পান না। আমরা লিখি, কারণ আমাদের লেখা না থাকলে সমাজের বিবেক নিঃশব্দ হয়ে যাবে। আমরা লিখি, কারণ কলম ছাড়া বাঁচা আমাদের জন্য অসম্ভব। প্রতিটি শব্দ আমাদের জীবনের প্রতিফলন, আমাদের যন্ত্রণা এবং স্বপ্নের নিদর্শন। সম্মানিত সম্পাদক মহোদয়, আমি জানি আপনার কাছে ক্ষমতা রয়েছে। আপনার একটি সুপারিশ, একটি পরামর্শ, একটি ছোট উদ্যোগ একজন দরিদ্র লেখকের জীবন বদলে দিতে পারে। আপনার মাধ্যমে একজন লেখক চিকিৎসা পেতে পারে, সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে পারে, ঘরে ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- আপনার পাশে দাঁড়ানোর সুযোগটি খুব কম লেখক পায়। আমাদের মতো যারা নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন, তাদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের জন্য ন্যায্য সম্মানী নিশ্চিত করা, আমাদের কলমকে বাঁচানো- এটি কেবল মানবিক কাজ নয়, এটি সামাজিক দায়িত্বও।
লেখকের জীবন মানে সংগ্রাম। একটি কলমের মাধ্যমে আমরা সত্যকে প্রকাশ করি, সমাজকে জানাই, মানুষের মনের অন্ধকার ভেদ করি। কিন্তু সেই লেখকের নিজস্ব জীবন অন্ধকারে থিতু থাকে। আমরা অনাহারে লিখি, ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করি, রাত জেগে শব্দ সাজাই। অথচ সেই লেখকের জন্য সমাজের কোনো নিরাপত্তা নেই। লেখকরা লিখে যান অন্যের আনন্দের জন্য, অন্যের সমৃদ্ধির জন্য, অন্যের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য। আর কেউ প্রশ্ন করে না- লেখক নিজে বাঁচে কীভাবে?
আমাদের দেশে অসংখ্য লেখক আছেন, যারা রক্তঝরা শব্দ লিখে সমাজকে জাগ্রত করেন। কিন্তু জীবনযাপনের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারছেন না। তারা লিখে যাচ্ছেন রাত দিন, কিন্তু সমাজ তাদের দিকে তাকায় না। এই বৈপরীত্য কেবল ন্যায়ের অভাব নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতিকে হুমকির মুখে ফেলে। কলমের শক্তি দিয়ে আমরা যেসব সত্যকে প্রকাশ করি, সেই সত্য যদি ক্ষুধার কাছে হার মানে, তবে সমাজও একদিন সত্যকে হারাবে।
মিডিয়ার মালিকরা জানেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রাণ হলো লেখক। সম্পাদকরা জানেন, লেখকের কলম ছাড়া কোনো সংবাদপত্র, কোনো চ্যানেল টিকে থাকতে পারে না। অথচ তারা প্রায়শই লেখকের দুর্দশা দেখা না-পাওয়ার অভিনয় করেন। একজন সম্পাদক চাইলে সহজেই একজন লেখকের জন্য সুপারিশ করতে পারেন। এক ফোন কল, এক সুপারিশ, এবং একজন লেখকের জীবন সহজ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেই সুযোগ পায় খুব কম লেখক। যারা নিয়মিত লিখেন, তারা হলেন সমাজের সৈনিক। তারা কলম ধরে অন্ধকার ভেদ করেন, সত্যকে তুলে ধরেন। কিন্তু তাদের নিজের ক্ষুধা, বঞ্চনা, অসহায়তা- কারও কাছে পৌঁছায় না। মালিকরা কোটি কোটি টাকা আয় করেন, বিলাসবহুল গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ- সব আছে। কিন্তু লিখনশক্তির এই সৈনিকদের হাতে পৌঁছায় না সামান্য সহযোগিতা। এটি এক ভয়াবহ বৈষম্য।
একজন লেখক যদি ক্ষুধার কাছে হেরে যান, তার কলমও দুর্বল হয়ে যায়। ক্ষুধার্ত পেটে সত্য উচ্চারণ করা যায় না। অনাহারে কাতর শরীর কি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে? লেখকরা লিখে যান সমাজের জন্য, পাঠকের জন্য, দেশের জন্য। কিন্তু যদি তারা বঞ্চিত থাকেন, কলমকে বাধা দেওয়া হয়, তবে সমাজও তার চেতনাকে হারাবে। মিডিয়া যদি লেখকের পাশে না দাঁড়ায়, তবে সেই মিডিয়া একদিন ধসে পড়বে। কারণ মিডিয়ার শক্তি লেখকের কলমে নিহিত।
বাংলা সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ইতিহাসে অসংখ্য মহৎ লেখক নিঃস্ব অবস্থায় জীবন কাটিয়েছেন। কেউ চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন, কেউ বই প্রকাশ করেও সম্মানী পাননি, কেউ সন্তানকে শিক্ষার সুযোগ দিতে পারেননি। মৃত্যুর পর আমরা দেখি স্মরণসভা, বক্তৃতা, ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জলি। কিন্তু জীবিত অবস্থায় তারা সাহায্য পাননি। এ এক ভয়াবহ সামাজিক ভণ্ডামি।
আমি লিখি কারণ কলম ছাড়া আমার অস্তিত্ব নেই। প্রতিটি লেখা আমার আত্মার রক্ত। প্রতিটি শব্দই আমার যন্ত্রণা ও স্বপ্নের প্রতিফলন। লেখা শেষ করার পর বুকের ভেতরে প্রশ্ন জাগে- এই লেখা দিয়ে আমি কি পেলাম? সমাজ কি আমাকে সম্মান দিয়েছে? সম্পাদক মহোদয় কি আমার কষ্ট দেখেছেন? আমার মতো হাজারো লেখক আছেন, যারা বিনা পারিশ্রমিকে, বিনা স্বীকৃতিতে লিখে যাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের লেখা ছাড়া মিডিয়া, সমাজ, সংস্কৃতি- কিছুই সম্ভব নয়।
আমাদের কলম বাঁচানোর জন্য মিডিয়ার মালিক ও সম্পাদকদের অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। প্রতিটি লেখা বা কলামের জন্য যথাযথ সম্মানী নিশ্চিত করা, অসুস্থ বা বিপদে পড়া লেখকদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা, প্রবীণ লেখকদের জন্য মাসিক ভাতা চালু করা, নিয়মিত লেখকদের জন্য চাকরির বা আর্থিক সহায়তার সুপারিশ করা, লেখককে কেবল কনটেন্ট প্রডিউসার মনে না করে সমাজের পথপ্রদর্শক হিসেবে মর্যাদা দেওয়া- এগুলো অত্যন্ত জরুরি। মিডিয়ার মালিকরা যদি সত্যিই তাদের প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ও শক্তি রক্ষা করতে চান, তবে তাদের প্রথম দায়িত্ব হলো লেখকের পাশে দাঁড়ানো। লেখকই মিডিয়ার প্রাণ। লেখকই সমাজের আলো। লেখক না থাকলে মিডিয়ার অট্টালিকা, বিজ্ঞাপন, পাঠক- সবই অর্থহীন। নিয়মিত লেখকদের সহযোগিতা করুন। তাদের পাশে দাঁড়ান। তাদের কলমকে বাঁচান। কারণ কলম বেঁচে থাকলে সমাজ বাঁচবে, ইতিহাস বাঁচবে, মানবতা বাঁচবে। যদি একদিন ক্ষুধায় সব লেখকের কলম নীরব হয়ে যায়, তবে মিডিয়ার ঝলমলে ভবনও একদিন অন্ধকারে ডুবে যাবে।
আমরা লিখি, আমরা সংগ্রাম করি, আমরা আমাদের কলমকে জীবন্ত রাখি। কিন্তু সেই সংগ্রামের প্রতি যদি সমাজ, সম্পাদক, মালিক কেউ দৃষ্টি না দেয়, তবে আমাদের কলমের রক্ত বৃথা যাবে। এই কলমই ভবিষ্যতের সমাজকে আলোকিত করবে। আমাদের লেখা বাঁচানো মানে মানবতার, সমাজের, ইতিহাসের জন্য দায়িত্ব নেওয়া। আমরা অনাহারে, দারিদ্র?্যরে মধ্যে থেকেও লিখি, কারণ আমাদের কলমই আমাদের অস্তিত্ব।
লেখকরা লিখে যাচ্ছেন, রাত দিন কাটাচ্ছেন, শ্বাস ফেলার মতো সময়ও নেই। কিন্তু সমাজকে, মিডিয়া মালিকদের, সম্পাদক মহোদয়দের দেখতে হবে- এই লেখকদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের সম্মান, তাদের অর্থিক নিরাপত্তা, তাদের স্বাস্থ্য- সবই আমাদের সবার দায়িত্ব। যে কলম না বাঁচে, সেই সমাজ কতো দূর পর্যন্ত টিকে থাকবে? আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে। আমাদেরকে সহায়তা করতে হবে। আমাদেরকে সেই শব্দকে বাঁচাতে হবে, যার মাধ্যমে সত্য, ন্যায়, মানবতা সমাজে পৌঁছায়।
একজন দরিদ্র লেখকের জন্য একটি সুপারিশ, একটি সহযোগিতা, একটি ন্যায্য পারিশ্রমিক- এতে তার জীবন পরিবর্তিত হতে পারে। তার সন্তান শিক্ষিত হবে, তার ঘর শান্ত হবে, তার স্বাস্থ্য নিশ্চিত হবে। একবার সুপারিশ বা সহযোগিতা দিয়েই সমাজের মূল্যবোধে নতুন আলো জ্বালা যায়। আমরা লিখি সমাজের জন্য, মানুষের জন্য, সত্যের জন্য। আর সমাজ যদি আমাদের অবহেলা করে, তবে সেই সমাজও একদিন ক্ষুধার ও অন্যায়ের কাছে হার মানবে। আমাদের কলম বাঁচান। আমাদের পাশে দাঁড়ান। কারণ আমরা লিখি, আমরা সংগ্রাম করি, আমরা ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করি, আমরা সমাজকে আলোকিত করতে চাই। আমাদের কলমের রক্ত বৃথা যাবে না- যদি আমাদের সাহায্য করা হয়। আমাদের লেখা বাঁচানো মানে সমাজকে বাঁচানো, ইতিহাসকে বাঁচানো, মানবতাকে বাঁচানো। আমি আশা করি, সম্মানিত সম্পাদক মহোদয়, আপনি আমাদের কষ্ট বুঝবেন। আপনি আপনার শক্তি, আপনার ক্ষমতা, আপনার সুপারিশ ব্যবহার করবেন। আমাদের মতো লেখকদের জন্য নিরাপদ, সম্মানজনক, এবং জীবনধারণযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করবেন। আমরা লিখতে পারি, আমাদের লেখা প্রকাশিত হয়। কিন্তু যদি আমাদের পেটের ক্ষুধা মিটানো না যায়, যদি আমরা ন্যায্য পারিশ্রমিক না পাই, যদি আমাদের পাশে কেউ না দাঁড়ায়, তবে সেই লেখা হবে নিঃশব্দ আর বৃথা।
লেখকরা ক্ষুধার মাঝেও লিখে যান, রাত জেগে লিখে যান, জীবন বাজি রেখে লিখে যান। আমাদের লেখা বাঁচানো মানে সমাজকে বাঁচানো, মিডিয়াকে শক্তিশালী করা, মানুষের চোখে সত্যের আলো জ্বালানো। আমাদের কলমকে বাঁচান। আমাদের পাশে দাঁড়ান। আমরা লিখি- আপনার জন্য, সমাজের জন্য, সত্যের জন্য। আর যদি একদিন ক্ষুধায় সব লেখকের কলম নীরব হয়ে যায়, তবে শুধু একজন লেখক নয়, পুরো সমাজ অন্ধকারে ঢুকে যাবে।
লেখক : কলামিস্ট, আমদিরপাড়া জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা