ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আমরা পড়তে চাই বড় হতে চাই

জান্নাতি আক্তার
আমরা পড়তে চাই বড় হতে চাই

আমরা শিশু শ্রম চাই না, পড়তে চাই। মানুষের জীবনে সবচেয়ে আনন্দের সময় হলো শৈশব। এই সময়টা খেলাধুলা, হাসি, গান, কবিতা, গল্প আর বইয়ের সঙ্গে কাটানোর কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- আমাদের সমাজে হাজার হাজার শিশু আছে যারা বই হাতে নিতে পারে না। তাদের কাঁধে থাকে ভারী বোঝা, হাতে থাকে কাজের সরঞ্জাম, চোখে থাকে অবসাদের ছাপ। স্কুলে যাওয়ার বদলে তারা কাজ করতে যায়। কেউ হোটেলে থালা ধোয়, কেউ রাস্তায় বাদাম বিক্রি করে, কেউ ইটভাটায় কাজ করে, কেউ বাসাবাড়িতে ঝাড়ু দেয়। অথচ এই বয়সে তাদের বই পড়া, খেলা আর স্বপ্ন দেখার কথা ছিল। তাই আমরা বলতে চাই- শিশু শ্রম চাই না, পড়তে চাই।

একদিন সকালে আমি রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম এক ছোট্ট ছেলে রোদে দাঁড়িয়ে কলা বিক্রি করছে। বয়স হবে নয়-দশ বছর। ময়লা জামা, কপালে ঘাম, আর মুখে ক্লান্তির ছাপ। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি স্কুলে যাও না? ছেলেটি লজ্জা পেয়ে বলল, না ভাইয়া, স্কুলে যাওয়ার সুযোগ নেই, বাবা অসুস্থ, মা কাজ করে, তাই আমাকেই সংসার চালাতে হয়। তার চোখে আমি অদ্ভুত এক দুঃখ দেখলাম। সে যদি স্কুলে যেত, হয়তো আজ কবিতা মুখস্থ করত, হয়তো বন্ধুর সঙ্গে খেলত; কিন্তু তার শৈশব হারিয়ে গেছে। এ দৃশ্য দেখে আমি গভীরভাবে বুঝলাম, শিশু শ্রম শুধু একটি শিশুর নয়, পুরো জাতির জন্য এক অভিশাপ।

শিশু শ্রম কেন হয়? এর প্রধান কারণ দারিদ্র?্য। গরিব পরিবারে বাবা-মা যখন নিজেরাই সংসার চালাতে পারে না, তখন তারা সন্তানের হাতে বই না দিয়ে কাজে পাঠায়। কেউ ভাবেন, এখন যদি কাজ করে টাকা আনে, তাহলে অন্তত খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। কিন্তু এতে তারা ভুল করে, কারণ পড়াশোনা না করলে সেই শিশু সারাজীবন দারিদ্র্যে?ের শৃঙ্খলেই আটকে থাকবে। আরেকটি কারণ হলো অশিক্ষা। বাবা-মা যদি নিজেরাই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, তারা বোঝে না যে শিক্ষা ছাড়া জীবনে উন্নতি সম্ভব নয়। তাই তারা ভাবে- কাজ করলেই টাকা আসবে, পড়াশোনায় সময় নষ্ট কেন! এর ফল হলো- প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়।

কিছু মালিকও দোষী। তারা জানে শিশুদের দিয়ে কাজ করালে কম টাকায় কাজ করানো যায়। তাই তারা শিশু শ্রমিক খোঁজে। এভাবে শিশু শ্রম চলতে থাকে। অথচ আমাদের আইন আছে, শিশুদের দিয়ে কঠিন কাজ করানো নিষিদ্ধ। কিন্তু আইন মানা হয় না, নজরদারি কম। ফলে শিশুদের শৈশব কেড়ে নেওয়া হয়।

শিশু শ্রমের ক্ষতি অনেক। প্রথমত, শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না, তাই তারা অশিক্ষিত থেকে যায়। দ্বিতীয়ত, তাদের কোমল শরীর কষ্টে ভেঙে পড়ে। ভারী ইট বহন করতে গিয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে যায়, হোটেলে ধোঁয়ার মধ্যে কাজ করতে গিয়ে ফুসফুস নষ্ট হয়। তৃতীয়ত, তাদের মানসিক অবস্থাও খারাপ হয়। খেলা না করতে পারায় তারা দুঃখী হয়ে যায়, আত্মবিশ্বাস হারায়। চতুর্থত, সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো- তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যায়।

ভাবুন তো, আজ যে শিশুটি ইটভাটায় ইট বহন করছে, যদি সে স্কুলে যেত, হয়তো বড় হয়ে ডাক্তার হতো, হয়তো বিজ্ঞানী হতো, হয়তো শিক্ষক হতো। কিন্তু শিশু শ্রম তাকে সেই সুযোগ দেয় না। শুধু তাই নয়, একটি দেশের উন্নতির জন্য শিক্ষিত নাগরিক দরকার। যদি শিশুরা পড়াশোনা না করে, তাহলে সেই দেশ কখনও উন্নত হতে পারবে না। তাই শিশু শ্রম একটি দেশের জন্যও বড় ক্ষতি।

আমরা চাই পড়াশোনা করতে। আমরা চাই স্কুলে যেতে। আমরা চাই হাতে কলম ধরতে, বই পড়তে, পরীক্ষায় অংশ নিতে। আমরা চাই বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে, গান গাইতে, কবিতা পড়তে। শৈশবের আনন্দ যেন কাজে নষ্ট না হয়। প্রতিটি শিশু যেন বলার সুযোগ পায়- আমরা শিশু শ্রম চাই না, পড়তে চাই। এজন্য সরকারের বড় দায়িত্ব আছে। দরিদ্র পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে, যাতে তারা সন্তানের পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারে। স্কুলে বিনা মূল্যে শিক্ষা দিতে হবে, দুপুরে খাবার দিতে হবে। শিশু শ্রম বন্ধের আইন কঠোরভাবে কার্যকর করতে হবে। যে কোনো কারখানা, হোটেল বা বাড়িতে শিশু শ্রম পাওয়া গেলে কঠিন শাস্তি দিতে হবে।

কিন্তু শুধু সরকার নয়, আমাদের সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে, আমরা কোনো শিশুকে শ্রমিক হিসেবে কাজে নেব না। যদি দেখি কেউ শিশু শ্রম করাচ্ছে, আমরা প্রতিবাদ করব। ধনী পরিবারগুলো গরিব শিশুদের পড়াশোনার খরচ বহন করতে পারে। শিক্ষকরা চেষ্টা করবেন, যাতে সব শিশু স্কুলে আসে। আর আমরা যারা ছাত্র, তারাও আমাদের বন্ধুকে স্কুলে টানব, যদি সে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়।

একটি গ্রামের গল্প বলি। গ্রামের পাশে একটি ইটভাটা ছিল। সেখানে অনেক শিশু কাজ করত। একদিন এক শিক্ষক সেখানে গিয়ে শিশুদের সঙ্গে কথা বললেন। তিনি বোঝালেন, শিক্ষা ছাড়া তোমরা কখনও সুখী হতে পারবে না। তিনি গ্রামের মানুষকেও বোঝালেন, শিশুদের কাজ না দিয়ে স্কুলে পাঠাতে হবে। ধীরে ধীরে গ্রামটি বদলে গেল। শিশুরা আবার স্কুলে ফিরল। কয়েক বছর পরে সেই গ্রামের শিশুরাই পরীক্ষায় ভালো ফল করে সবাইকে অবাক করল। কেউ শিক্ষক হলো, কেউ চাকরি পেল। এটি প্রমাণ করে, চাইলে পরিবর্তন সম্ভব।

আমরা চাই প্রতিটি শিশুর মুখে হাসি থাকুক। আমরা চাই তারা বই হাতে নিক, কলমে লিখুক, মাঠে খেলুক, কবিতা গাক। আমরা চাই না তারা কাঁদুক, ক্লান্ত হোক, কাজের ভারে ভেঙে পড়ুক। শিশুরা দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের হাতে বই থাকলেই দেশ এগিয়ে যাবে।

তাই আসুন আমরা সবাই মিলে বলি- আমরা শিশু শ্রম চাই না, পড়তে চাই। আমরা চাই প্রতিটি শিশু যেন শ্রেণিকক্ষে বসে শিক্ষক-শিক্ষিকার কথা শোনে, পরীক্ষায় অংশ নেয়, বড় হয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করে। আমরা চাই না কোনো শিশুর চোখের স্বপ্ন নিভে যাক। শিশুরাই আগামী দিনের নেতা, কবি, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, ডাক্তার। তাদের হাতে কাজের বোঝা নয়, স্বপ্নের বই তুলে দিই।

লেখক : জান্নাতি আক্তার, শিক্ষাথী

জুমারবাড়ী দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়, সাঘাটা, গাইবান্ধা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত