ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পাহাড়ে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করতে হবে

পাহাড়ে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করতে হবে

খাগড়াছড়িতে এক স্কুলছাত্রীর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে তুলকালাম চলছে কয়েকদিন ধরে। কথিত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে গত মঙ্গলবার খাগড়াছড়ি সফরের সিঙ্গিনালা এলাকায়। ধর্ষকদের বিচারের দাবিতে পরদিনই ‘জুম্ম ছাত্র-জনতার’ ব্যানারে বিক্ষোভ করে পাহাড়িরা। তারা বৃহস্পতিবার আধাবেলা সড়ক অবরোধ করে। গত শুক্রবার করে সমাবেশ। এ সমাবেশ থেকেই গত শনিবার পূর্ণদিবস অবরোধের কর্মসূচি দেওয়া হয়। শনিবার ভোর থেকেই অবরোধ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে, গাছ ফেলে অবরোধ তৈরি করে। এতে খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা, মহলছড়ি ও পানছড়ির সব সড়ক বন্ধ হয়ে যায়। খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও সাজেকগামী যানচলাচল থেমে যায়। অবরোধে পর্যটকরা আটকা পড়ে। দুপুরের দিকে অবরোধকারীরা খাগড়াছড়ি উপজেলা পরিষদের সামনে অবস্থান নেয়। ওই সময় সেখানে অবস্থানকারী বাঙালিদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ ও ধাওয় পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপে তখনকার মতো পরিস্থিতি শান্ত হলেও বিকালে শহরের মহাজনপাড়া এলাকায় ফের পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। এ সময় বিভিন্ন এলাকায় দোকানপাট ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও অবনতি রোধে সদর উপজেলা ও পৌরসভা এলাকা এবং গুইমারা উপজেলায় ১৪৪ ধারা জারি করতে বাধ্য হয় প্রশাসন। গতকাল এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত খাগড়াছড়ির পরিস্থিতি কোথাও থমথমে, কোথাও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটনা ঘটছে। বিজিবি ও পুলিশ নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছে। নাশকতার অভিযোগে তিন পাহাড়ি যুবককে পুলিশ আটক করেছে। উল্লেখ করা আবশ্যক, কথিত ধর্ষণের জন্য বাঙালিদের দায়ী করা হচ্ছে। ভুক্তভোগীর বাবা খাগড়াছড়ি সদর থানায় তিনজনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেন। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে শয়নশীল নামে একজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। জানা গেছে, কয়েকজন পাহাড়ি যুবক শয়নশীলকে বাড়ি থেকে ধরে এনে পুলিশে সোপর্দ করে। শয়নশীল আদৌ ধর্ষণকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে জানানো হয়েছে, পত্রিকাটির হাতে আসা সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে শয়নকে রাত সাড়ে ৭টা থেকে ৯টা ৫১ মিনিট পর্যন্ত খাগড়াছড়ি বাজারে বিভিন্ন দোকানে পূজার কেনাকাটা করতে দেখা গেছে। অথচ, ভুক্তভোগীর বাবা থানায় যে মামলা করেছেন সেখানে ঘটনার সময় রাত ৯টা বলে জানানো হয়েছে।

কোনো তথ্য প্রমাণ ও উপযুক্ত তদন্ত ছাড়াই বাঙালিদের ওপর ধর্ষণের অভিযোগ আনা এবং তা নিয়ে লাগাতার আন্দোলন-কর্মসূচি নেওয়া কতটা সমীচীন, সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এও উল্লেখের বিষয়, পাহাড়ি ছাত্র-জনতার ব্যানারে বিক্ষোভণ্ডসমাবেশ-অবরোধ কর্মসূচি নেওয়া হলেও এর সঙ্গে সংহতি জানায় ইউপিডিএফের অঙ্গ সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম প্রভৃতি। সংহতি নামে, কার্যত পাহাড়ি প্রায় সকল পক্ষ কর্মসূচিতে অংশ নেয়। পর্যবেক্ষকদের মতে, পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে বিরোধ-সংঘাত বাঁধিয়ে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য ধর্ষণকাণ্ড সাজানো কি না, সে সন্দেহ এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। কারণ, ধর্ষণ একটা স্পর্শকাতর বিষয়। এ অভিযোগে সহজেই উত্তেজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যায়। অতীতেও এরকম ঘটনা ঘটেছে। নজির হিসাবে বলা যায়, দীঘিনালায় কৃত্রিকা ত্রিপুরা নামে এক শিশু নিহত হওয়ার পর বাঙালিরা তার ধর্ষণ ও হত্যার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করা হয় এবং আন্দোলন করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা হয়। এমনকি পুলিশকে বাধ্য করে ঘটনার সঙ্গে জড়িত মর্মে দুই বাঙালির স্বীকারোক্তি পর্যন্ত আদায় করা হয়। পরে পিবিআইয়ের তদন্তে সগ্রোত্রীয়রা জড়িত বলে প্রমাণ হয়। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, ধর্ষণের অভিযোগে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে বিরোধ-সংঘাত বাঁধিয়ে পাহাড়কে অশান্ত করার গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে এর পেছনে। পাহাড়িদের একটি আঞ্চলিক দল, পতিত স্বৈরাচার এবং ভারতের যোগসাজস রয়েছে এতে।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর মোতাবেক, একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও এরূপ তথ্য উঠে এসেছে। কয়েকশ’ বছর ধরে পাহাড়িরা বাঙালিদের সঙ্গে এ ভূখণ্ডে বসবাস করছে। অথচ, উভয়ের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সদ্ভাব কতটা তৈরি হয়েছে তা নিয়ে সংশয় আছে। পাহাড়িরা বিভিন্ন সময় বাঙালিদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, এমনকি স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডের ঐক্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বাইরের, বিশেষ করে ভারতের প্ররোচণায় তারা এটা করেছে। বাঙালিরা পাহাড়িদের পৃথক করে দেখে না। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন দিয়ে এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী সবাইকে এক জাতীয়তায় আবদ্ধ করেন। তিনি পিছিয়েপড়া পাহাড়ের উন্নয়নের পথনকশা প্রণয়ন করেন। তার প্রেক্ষিতে পাহাড়ে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। পাহাড়িদের নজিরবিহীন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তারা শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনীতি, জীবনযাপন সকল ক্ষেত্রেই বাঙালিদের থেকে উঁচুতে অবস্থান করছে। পাহাড়ে তাদের একাধিপত্য রয়েছে। সমতলেও তারা সমান সুবিধাভোগী। অথচ তাদের অনেকে বিচ্ছিন্নতা অভিলাষী, অস্ত্রধারী এবং চাঁদাবাজ। ছোটখাটো কোনো ঘটনা ঘটলেও অভিলাষীরা সোচ্চার হয়ে ওঠে।

বাঙালিদের ওপরে চড়াও হয়। পুলিশ, এমনকি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতেও দ্বিধা করে না। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, তাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী ও আইনশৃঙ্খলা হানিকর যেকোনো তৎপরতা কঠোর হস্তে দমন করার বিকল্প নেই। নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা সুরক্ষায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি মার্কিন রাজধানীতে সৈন্য আনতে পারেন, ভারত যদি বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা দমনে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে, তবে আমরা পাহাড়ি সন্ত্রাসী ও অরাজকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নিতে পারব না?

পাহাড়ি জনপদ দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার সুরক্ষা যেকোনো মূল্যে নিশ্চিত করতে হবে। সেখানে শান্তি-শৃঙ্খলা-নিরাপত্তা বজায় রাখতে হবে সবসময়। প্রয়োজনে সেখানে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাসদস্যদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশি হিসাবে বাঙালি-পাহাড়ির মধ্যে কোনো বিভেদ বা পার্থক্য নেই। তারা সব ক্ষেত্রে সমান অধিকারের দাবিদার। তাদের সমঅধিকারে যাতে ব্যত্যয় না ঘটে, কোনো ক্ষেত্রে যাতে এতটুকু বৈষম্য না হয়, সেটা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ধর্ষণ কোথায় না হয়? দেশের সমতলেও তো হয়। অন্যান্য দেশেও হয়। ধর্ষণের চেয়ে ঘৃণ্য অপরাধ হতে পারে না। ধর্ষক বা ধর্ষকদের উপযুক্ত শাস্তি সব দেশে সমানভাবে কাম্য। আমাদের দেশেও পাহাড়ে বা সমতলে যেখানেই ধর্ষণ সংঘটিত হোক, তার উপযুক্ত শাস্তি হতে হবে। ধর্ষক বা ধর্ষকদের শাস্তির দাবিতে প্রতিবাদণ্ডবিক্ষোভণ্ডআন্দোলন হতে পারে। কিন্তু তা হতে হবে নিয়মতান্ত্রকভাবে, সুশৃঙ্খলভাবে। ধর্ষণের অভিযোগ আন্দোলন হবে, ভাঙচুর হবে, অবরোধ হবে, মানুষের কষ্টের কোনো শেষ থাকবে না, এটা হতে পারে না। আমরা আশা করবও, খাগড়াছড়ির পুরোঘটনার অনুপুঙ্খ তদন্ত হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত