প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০১ অক্টোবর, ২০২৫
বাংলাদেশের আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিশেষ করে ১৯৭১-পরবর্তী জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রগঠন, একধরনের একক সংস্কৃতি এবং রাজনীতির শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করেছে। এ শ্রেষ্ঠত্বের কেন্দ্রে রয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যা ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে এবং যার প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছে, বাঙালি মুসলমানের পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতিকে। এ জাতীয়তাবাদ তার শক্তি ও নৈতিক বৈধতা সংগ্রহ করেছে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বর্ণনা থেকে। কিন্তু একইসঙ্গে এটি একধরনের অন্তর্নিহিত বর্ণবাদ তৈরি করেছে, যা মুসলমানপন্থিদের এবং মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত করে।
বছরের পর বছর আমরা দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ বর্ণবাদ কীভাবে কাজ করেছে। ভর্তি প্রক্রিয়ায়, হলে আসন বরাদ্দে, শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে, এমনকি পাঠ্যসূচিতে মাদ্রাসা থেকে আসা শিক্ষার্থীরা বারবার বৈষম্যের শিকার হয়েছে। তাদের ‘গ্রামীণ’, ‘অসভ্য’, ‘অপ্রগতিশীল’ কিংবা ‘জঙ্গি’ হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে। এর ফলে অনেকের উচ্চশিক্ষায় আগ্রহ ভেঙে গেছে, অনেকেই নিজেকে এ মূলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করেছে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, যে বামপন্থি ও প্রগতিশীল সংগঠনগুলো নিজেদের মানবাধিকারপন্থি ও গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে, তারা এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে কখনোই দাঁড়ায়নি। বরং অনেক সময় তারা এ বৈষম্যকে যুক্তি ও তত্ত্ব দিয়ে সমর্থন করেছে। যেমন, তারা বলেছেন, মাদ্রাসা শিক্ষার কারণে শিক্ষার্থীদের ‘চিন্তার স্বাধীনতা’ নাকি সীমিত, তাই তাদের ‘মুক্ত’ করতে হবে। কিন্তু মুক্তির নামে যা হয়েছে, তা আসলে একটি সাংস্কৃতিক দমন।
আজ যখন রাজনৈতিক পালাবদল ঘটছে, যখন বাঙালি মুসলমানের সন্তানরা নতুন করে জনমতের কেন্দ্রে উঠে এসেছে এবং রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ডাক দিচ্ছে, তখন সেই একই বাম সংগঠন ও শিক্ষক নেটওয়ার্ক তাদের আহ্বান জানাচ্ছে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য। তারা বলছে, সবাই মিলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার কথা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যখন বাঙালি মুসলমানের সন্তানরা বছরের পর বছর বৈষম্য ও বিদ্বেষের শিকার হচ্ছিল, তখন এরা কোথায় ছিল?
বাংলাদেশের উদারপন্থি বামদের ভূমিকা অনেকটা দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেত লিবারেলদের মতো। তারা দাবি করে যে, মুসলমানদের জন্য কী ভালো, তা তারা জানে। তারা নির্দেশনা দেয়, পথ দেখায়, নৈতিক শিক্ষা দেয়। কিন্তু মুসলমানদের নিজেদের মতো করে রাজনীতি করার অধিকার দেয় না। তারা চায়, বাঙালি মুসলমান যেন তাদের শর্তে রাজনীতি করে, ভাষা ও তত্ত্বে কথা বলে। যখন কোনো মুসলমানপন্থি দল বা ব্যক্তি নিজস্ব ভাষায়, নিজস্ব রেফারেন্সে রাজনীতি করতে চায়, তখন বামরা বলে ‘তুমি মৌলবাদী হচ্ছো, তুমি প্রগতির শত্রু।’
অর্থাৎ তারা মুসলমানপন্থিদের সঙ্গে সংলাপ চায় কেবল তখনই, যখন এ মুসলমানপন্থিরা তাদের নিয়মে খেলবে। এটি এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ঔপনিবেশিকতা। একদিকে তারা দাবি করে মুক্তচিন্তার পক্ষপাতী, অন্যদিকে মুসলমানদের চিন্তাকে ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন’ বলে বাতিল করে দেয়। তাদের এ মনোভাব সেই দীর্ঘকালীন বর্ণবাদী চিত্রকল্পের অংশ, যা ইসলাম ও বাঙালি মুসলমানকে ‘পশ্চাৎপদ’ এবং ‘অসভ্য’ বলে তুলে ধরে।
এখন প্রশ্ন হলো- বাঙালি মুসলমান কি তবে জাতীয় ঐক্যের বিপক্ষে থাকবে? না। কিন্তু তারা সেই একীকরণ চায়, যেখানে সবাই সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি নির্ধারণ করবে। এটি একধরনের সাংস্কৃতিক গণতন্ত্র, যা কাউকে বাদ দেয় না; কিন্তু কারও ওপর জোরপূর্বক অন্যের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয় না। যারা এখন মুসলমানপন্থিদের ঐক্যবদ্ধ হতে বলছে, তাদের প্রথমে নিজেদের অতীতের ভূমিকার হিসাব দিতে হবে। তাদের স্বীকার করতে হবে, তারা বছরের পর বছর মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীদের ওপর হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরব ছিল। তাদের স্বীকার করতে হবে, তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ছাতার নিচে থেকে একধরনের একচেটিয়া সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার কাজে সহযোগিতা করেছে।
প্রকৃত প্রগতিশীলতার প্রথম শর্ত হলো- নিজের সমাজের ভেতরে বিদ্যমান বর্ণবাদকে চিহ্নিত করা এবং ভেঙে ফেলা। তাই বাম ও শিক্ষক নেটওয়ার্কের কাজ হলো- প্রথমে নিজেদের সমাজে ইসলামবিদ্বেষ ও মুসলমানবিরোধী মানসিকতা দূর করা। তারা যদি সত্যিই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চায়, তবে তাদের উচিত হবে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোকে সমান অংশীদার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া, তাদের কণ্ঠস্বরকে মূল্য দেওয়া। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, যে সমাজে মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে দেখা হয়, সেখানে প্রকৃত গণতন্ত্র সম্ভব নয়। মুসলমানপন্থিদের প্রান্তিকীকরণ শুধু তাদের ক্ষতি করেনি, পুরো রাষ্ট্রকে দুর্বল করেছে। কারণ, এটি জনগণের একটি বৃহৎ অংশকে রাজনৈতিকভাবে অবিশ্বাসী ও ক্ষুব্ধ করেছে।
যদি বাম ও প্রগতিশীল নেটওয়ার্ক সত্যিই ঐক্য চায়, তবে তাদের উচিত অতীতের এ দমননীতির জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং ভবিষ্যতে মুসলমানদের সঙ্গে সমানতালে রাষ্ট্রগঠনে অংশ নেওয়া। তবেই আমরা এমন একটি রাষ্ট্র পাব, যেখানে সব নাগরিকের কণ্ঠস্বর সমান গুরুত্ব পাবে, কেউ আর সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক বর্ণবাদের শিকার হবে না।
এটি কেবল নৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি রাজনৈতিক প্রয়োজনও। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে কোনো রাষ্ট্র স্থিতিশীল হতে পারে না। যে রাষ্ট্র জনগণের আস্থা হারায়, সে রাষ্ট্র অচিরেই দুর্বল হয়। তাই আজকের চ্যালেঞ্জ হলো একটি নতুন সামাজিক চুক্তি তৈরি করা, যেখানে মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচয়, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা এবং মুসলমানপন্থিদের রাজনৈতিক কণ্ঠস্বরকে যথার্থ মর্যাদা দেওয়া হবে। শুধু তখনই বাংলাদেশ একটি সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হবে, যেখানে নাগরিক পরিচয়ের শর্ত হবে না, আপনি কোন মতাদর্শে বিশ্বাস করেন, বরং এই যে আপনি মানুষ এবং এ রাষ্ট্রের নাগরিক।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, কাতার