প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৩ অক্টোবর, ২০২৫
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। এদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য নদ-নদী, যার মধ্যে পদ্মা প্রধান। ১৯৭৫ সালে গঙ্গা নদীর উপর কলকাতার মালদহে ফারাক্কা বাঁধ দেওয়া হয়।
বাঁধ দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল নাব্যতা হারিয়ে যাওয়া ভাগীরথী নদীতে পানিপ্রবাহ ঠিক রাখা। মধ্যযুগ পর্যন্ত ভাগীরথীই ছিল গঙ্গার মূলপ্রবাহ। বিভিন্ন ম্যাপে পদ্মাকে তুলনামূলক সরু রেখা হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু এরপর থেকে গঙ্গার মূল স্রোত পদ্মা নদী দিয়ে প্রবাহিত হওয়া শুরু করে। ১৬৬০ সালের ভনডেনের ম্যাপে পদ্মাকে ভাগীরথীর চেয়ে বড় প্রবাহ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর পর থেকে ভাগীরথী নদী তার নাব্যতা হারাতে থাকে। ফলে, কলকাতা বন্দরের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। গঙ্গা নদীর উপর বাঁধ দিয়ে সে পানি ভাগীরথীতে প্রবাহিত করার পরিকল্পনা শুরু হয় ব্রিটিশ আমল থেকেই। কলকাতা বন্দরকে সচল রাখতে হলে ভাগীরথীতে পানিপ্রবাহ ঠিক রাখা ছিল অত্যন্ত জরুরি। এরপর ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান আলাদা হয়ে গেলে বাঁধ তৈরির প্রয়োজনীয়তা আরও বৃদ্ধি পায়। কারণ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে যে যোগাযোগ পথ ছিল ভারতের সঙ্গে, ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের, তা বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৬১ সালে ফারাক্কা ব্যারেজের নির্মাণকাজ শুরু হয়, যা শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। পরীক্ষামূলকভাবে ১০ দিনের জন্য চালুর কথা বলে ভারত তার প্রথম প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। ফারাক্কা বাঁধের ফলে পদ্মায় পলি জমতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলো তাদের নাব্যতা হারাতে বসেছে। এরইমধ্যে অনেক নদী বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং অনেক নদী বিলুপ্তির পথে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পানি বণ্টন চুক্তি দীর্ঘমেয়াদি না হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার এসব অঞ্চলের জন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে, মাটি আর্দ্রতা হারাচ্ছে, মাটির উর্বরতা শক্তি কমে গেছে।
ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কৃষিক্ষেত্রে। বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। গ্রীষ্মকালে পদ্মা নিজেই পরিণত হয় মরুভূমিতে। দিন ও রাতের তাপমাত্রায় এসেছে বিশাল তারতম্য। পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। ফলে, এসকল অঞ্চল খাওয়ার জন্য ও কৃষির জন্য পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছে না এবং খরার সৃষ্টি হচ্ছে। নদীর পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে মাছের খাদ্য তৈরি ব্যাহত হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের ৫০ লাখ একর জমি আজ হুমকির মুখে।
শুধু বাংলাদেশ নয়, ফারাক্কার ফলে ভারতের উত্তর প্রদেশ ও বিহারে দেখা দিচ্ছে বন্যা। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা থাকে প্রায় পানি শূন্য, আর বর্ষা মৌসুমে পদ্মায় পানি কানায় কানায় পূর্ণ থাকে। ফলে, পদ্মায় দেখা দেয় নদীভাঙন, আর যেসব নদীতে নাব্যতার সৃষ্টি হয়েছে, ওই সকল অঞ্চলে দেখা দেয় বন্যা। বহু আন্তর্জাতিক ও দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পরও বাংলাদেশ তার পানির ন্যায্য অধিকার আজও আদায় করতে পারেনি। ভারতকে সুষ্ঠু পানিবণ্টন নীতি মেনে বাংলাদেশের ন্যায্য পানি দিতে হবে। পানির গতি রোধ করা কখনও প্রকৃতির পক্ষে নয়; এটা বুঝতে হবে। পদ্মাসহ পদ্মার শাখা নদীগুলোতে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে নদী শাসন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
মাওলানা ভাসানী যে লংমার্চ ডাক দিয়েছিলেন, তা পূরণ করার সময় এসেছে। আজ ৫০ বছর পেরিয়েও আমরা আমাদের পানির ন্যায্য অধিকার আদায় করতে পারিনি। গঙ্গার পানিতে মানুষ, জীবজন্তু- সকলের সমান অধিকার রয়েছে।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়