ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বিশ্ব শিক্ষক দিবস : ভুখা পেটে মহান ব্রত আর কতদিন

জাকির পারভেজ
বিশ্ব শিক্ষক দিবস : ভুখা পেটে মহান ব্রত আর কতদিন

কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতার কথা আমাদের এখনও মনে পড়ে। ‘আজ হতে চির-উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির, সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।’ বাদশাহ আওরঙ্গজেব যে সম্মান শিক্ষকদের দিয়েছেন তা কি এখনও সমুন্নত রয়েছে? এদেশে একটি প্রচলিত বিশ্বাস হলো, ক্ষমতা ও অর্থের বিচারে ভালো চাকরি না পাওয়ায় মানুষ পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নেয়। জর্জ বার্নার্ড শ’ তার ‘ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান’ নাটকে লিখেছেন, ‘যিনি পারেন তিনি করেন আর যিনি পারেন না তিনি শেখান।’ ঠিক যেন আমাদের সমাজের জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি। আমরা এমন এক সমাজ নির্মাণ করেছি, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছে দুর্নীতি, অন্যায়-অনাচার পরিণত হয়েছে স্বাভাবিক নিত্য ক্রিয়ায়। পুঁজিবাদী গোলকায়নের হাওয়ায় এক অসুস্থ মানসিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছি আমরা। সামাজিক স্তরগুলোর মধ্যে চলছে এক অঘোষিত লড়াই। এই স্তরবিন্যাসের প্রতিযোগিতায় অনেকটাই পিছিয়ে আমাদের শিক্ষক সমাজ। শুধু হৃদয়ের মণিকোঠায় শিক্ষকদের স্থান দিলেই তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায় না। সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য সমাজের অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তাকে টিকে থাকতে হয়। আমাদের শিক্ষক সমাজ এই প্রতিযোগিতায় যথেষ্ট পিছিয়ে। শিক্ষককে শ্রদ্ধা করতে না পারলে শিক্ষার কোনো লক্ষ্যই পূরণ হওয়ার নয়। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে যত উদ্যোগই নেওয়া হোক না কেন; তা শেষ পর্যন্ত সুকুমার রায়ের ‘বিদ্যেবোঝাই বাবুমশায়ের’ মতো ‘ষোলো আনাই মিছে’ হবে, যদি শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধি না করা হয়। একটি জাতি যত চেষ্টাই করুক, সে তার শিক্ষাব্যবস্থার মান কখনওই শিক্ষকের মানের চেয়ে উন্নত করতে পারে না। একটি দেশের শিক্ষকরা যেমন তার শিক্ষাব্যবস্থাও ঠিক তেমন। সবার জন্য বিশ্বজনীন ও মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে শিক্ষকের ভূমিকাই প্রধান। নতুন নতুন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ ও সুযোগকে মোকাবিলা বা সদব্যবহার করার জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মন-মানসিকতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তারাই মূল ভূমিকা পালন করতে পারেন। অর্থাৎ শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থার মান কার্যত সমান। আর কিছু থাক বা না থাক, কেবল ভালো শিক্ষক থাকলেই মোটামুটি মানসম্মত একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।

এখানেই বৈষয়িক বিষয়ের প্রসঙ্গ আসে। এর জন্য শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি ও চাকরির গ্রেডেশনের পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন- শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে অর্থনীতির গাঁটছড়া বাঁধা, তাই অর্থনীতির সঙ্গে শিক্ষকের মানমর্যাদার প্রশ্ন জড়িত। কিছু কিছু দেশে তার সাক্ষাৎ প্রমাণও মেলে। যেমন- চীন। চীনের অর্থনীতি আমরা সবাই কম-বেশি জানি কিন্তু চীনের শিক্ষকদের বেতন-মানমর্যাদা অনেকের কাছেই অজানা। ‘গ্লোবাল টিচার স্ট্যাটাস ইনডেক্স- ২০১৮’ অনুযায়ী, পৃথিবীতে চীনের শিক্ষকদের মর্যাদাই সবচেয়ে বেশি। সেখানে ডাক্তার আর শিক্ষকরা সমান মর্যাদা ভোগ করে। ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ মনে করেন, ছাত্ররা শিক্ষকদের সত্যিকার অর্থে সম্মান করে। অধিকাংশ মানুষ চায় তার সন্তান শিক্ষক হোক। সেখানে শিক্ষকদের গড় বেতন হচ্ছে ১৭৭৩০ ডলার।

শুধু দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিত বিবেচনা করলে আমরা দেখি; আমাদের দেশে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা সবচেয়ে কম। আমাদের শিক্ষার হার এখনও দক্ষিণ এশিয়ার তালিকায় তলানির দিকে। ভালো বেতন-কাঠামো ও সামাজিক মর্যাদা উচ্চণ্ডশিক্ষিত তরুণদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করবে, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা এখনও সে পথে হাঁটতে পারিনি। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা অনেক কম হওয়ায় পেশা হিসেবে শিক্ষকতা তেমন আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারেনি। ভারত ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো শিক্ষকতাকে উচ্চ মর্যাদা দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে, সেখানে আমাদের শিক্ষকদের বেতন অনেক কম।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শিক্ষকরা মাসিক বেতন পান গড়ে ৮ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা (বাংলাদেশী টাকায়), যা বাংলাদেশের একজন শিক্ষকের কয়েক বছরের বেতনের সমান। আমাদের সরকারি ও এমপিওভুক্ত সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের বেতন শুরু হয় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকায়, সেখানে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষকদের বেতন শুরু হয় প্রায় ৩৫ হাজার টাকা থেকে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন সবচেয়ে কম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও একই রকম বৈষম্য বিদ্যমান। ভারতের একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক যে পরিমাণ অর্থ পান, তা বাংলাদেশের তুলনায় ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি।

প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন এত কম কেন? কারণ, শিক্ষা খাতে আমাদের বরাদ্দও অনেক কম। ইউনেসকো’র দাবি ছিল- শিক্ষা খাতের বরাদ্দ হবে জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ, যা জিডিপির হিসাবে ৪ থেকে ৬ শতাংশ। কিন্তু ২০১৮-২০১৯ অর্থবছর থেকে বর্তমান পর্যন্ত আমাদের বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ কখনও ১২ শতাংশের বেশি হয়নি। জিডিপির হিসাবেও একই চিত্র- ১.৬৯ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২.১১ শতাংশ। এত নিম্ন আকারের বাজেট শিক্ষা খাতকে কতটুকু অগ্রসর করতে পারবে- তা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বেসরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দুর্দশার বাস্তব চিত্র আমরা দেখেছি করোনাকালীন সময়ে। রাজধানী শহরের অনেক শিক্ষক ভাড়ার টাকা সংকুলান করতে না পারায় অবশেষে আশ্রয় নিয়েছেন বিদ্যালয়ের কোনো এক কামরায়। কেউবা ছদ্মবেশে হয়েছেন সবজি বিক্রেতা। তাদের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হতে হয় অবসরকালীন সময়ে। মাসিক পেনশন বলতে তো কিছুই নেই, উপরন্ত এককালীন সুবিধার জন্য মাসের পর মাস ঘুরতে হয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে। রাজশাহী শহরের এক শিক্ষক দম্পতি যখন হাসপাতালের বিছানায় চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু পথযাত্রী তখন তাদের পেনশনের ফাইল ঝুলে আছে দপ্তরের টেবিলে। এই খবরগুলো শিক্ষক হিসেবে আমাদেরকে আহত করে। অর্থ উপদেষ্টা একজন বর্ষীয়ান অর্থনীতিবিদ। সমস্যার সমাধান করতে না পারলেও শিক্ষকদের দুর্দশার চিত্রের অন্তত মৌখিক স্বীকৃতি দিয়েছেন। অকপটে সত্য উচ্চারণ করেছেন- ‘ভুখা পেটে আর কতদিন পড়াবেন শিক্ষকরা’। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এরকম বাচনরীতি আমরা বহুদিন পাইনি।

জাতিসংঘের ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৪নং অভীষ্টে মানসম্মত শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। মানসম্মত শিক্ষার জন্য তিনটি বিষয়ের প্রয়োজন- শিক্ষক, শিক্ষাক্রম ও শিক্ষার পরিবেশ। সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষক। শিক্ষকের মান বৃদ্ধি না পেলে শিক্ষা নিম্নমানের হবে এটাই বাস্তব। ২০৩০ সালের মধ্যে এই অভীষ্ট আমরা কতটুকু অর্জন করতে পারব, সেটিই এক ভাবনার বিষয়। শিক্ষকদের শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই মূল কথা নয়, তাদের সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষকতা পেশাকে একটি সহযোগী পেশা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একজন শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণভাবে গড়ে তোলার জন্য শুধু শিক্ষকের কাঁধে ভার অর্পণ করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কারণ, একজন শিক্ষার্থী অধিকাংশ সময় তার পরিবারের সাহচর্যেই থাকে। পরিবার হলো তার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

এ বিষয়টি মাথায় রেখেই ইউনেস্কো বিশ্ব শিক্ষক দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে- ‘Recasting teaching as a collaborative profession’ অর্থাৎ ‘শিক্ষাদানকে সহযোগী পেশা হিসেবে পুনর্গঠন’। শিক্ষকের মর্যাদার দিকে লক্ষ্য রেখেই ১৯৯৪ সাল থেকে ইউনেস্কো এ দিবসটি প্রতি বছর পালন করে আসছে। সমৃদ্ধ জাতি ও আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষকের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করছি, ‘I am indebted to my father for living, But to my teacher for living well’।

লেখক : শিক্ষক, কবি ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত