প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৫ অক্টোবর, ২০২৫
আস্থা সংকটে উদ্যোক্তারা, গতি নেই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে- এই বাস্তবতা এখন দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর আগেও যখন দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নতুন কারখানা স্থাপন, ব্যবসা সম্প্রসারণ কিংবা প্রযুক্তি খাতে বড় উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন, তখন অর্থনীতির মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ থেকে সরে আসছেন, পুরোনো বিনিয়োগ ধরে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছেন। আদালত-মামলার জট, প্রশাসনিক হয়রানি, নীতির অস্থিরতা, জ্বালানি সংকট এবং নিরাপত্তাহীনতা- সবকিছু মিলে ব্যবসায়ীরা আস্থাহীনতার এক দুষ্টচক্রে আটকা পড়েছেন। এই অবস্থা থেকে বের হতে না পারলে দেশের প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, রপ্তানি- সবকিছু থেমে যাবে, অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থবিরতার দিকে চলে যাবে।
উদ্যোক্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভয়ের জায়গা হলো মামলা ও হয়রানি। ব্যবসা করতে গিয়ে নানা কারণে ঝুঁকি তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু ঝুঁকি সামলানোর পরিবর্তে উদ্যোক্তাদের ঘাড়ে একের পর এক মামলা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কখনও ব্যাংক ঋণ পরিশোধে সামান্য বিলম্ব, কখনও চেক ডিজঅনার, কখনও কর সংক্রান্ত বিরোধ- সবকিছুতেই মামলা ঠুকে দেওয়া হচ্ছে। একজন উদ্যোক্তা দিনের পর দিন আদালতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, অথচ তার সময় ব্যয় হওয়া উচিত উৎপাদন, বাজার সম্প্রসারণ কিংবা প্রযুক্তি উন্নয়নে। ব্যবসায়ী সমাজে এখন প্রবাদ হয়ে গেছে, ব্যবসার পাশাপাশি মামলা সামলানো আমাদের দৈনন্দিন কাজ। এই সংস্কৃতি উদ্যোক্তাদের আস্থা ভেঙে দিচ্ছে। যারা নতুন উদ্যোগ নিতে চাইছেন, তারাও পিছিয়ে যাচ্ছেন। কারণ তারা জানেন, কোনো জটিলতায় পড়লে ন্যায়বিচার পাবেন কি না তার নিশ্চয়তা নেই, বরং মামলা ও হয়রানির ভয়ে ব্যবসা বিস্তারের আগ্রহ হারাচ্ছেন।
বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়ার সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। বাংলাদেশে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। শিক্ষিত তরুণেরা যেমন চাকরি খুঁজছে, তেমনি কম দক্ষ তরুণেরা শিল্প কারখানায়, নির্মাণ খাতে বা সেবাখাতে কাজের সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু নতুন শিল্প গড়ে না উঠলে, বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলো সম্প্রসারণ না করলে এই বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য কাজের সুযোগ তৈরি হয় না। এরইমধ্যে দেখা যাচ্ছে, অনেক প্রতিষ্ঠান নতুন কর্মী নেওয়া বন্ধ করেছে, কেউ কেউ কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে। এতে বেকারত্ব বাড়ছে, সমাজে হতাশা তৈরি হচ্ছে, তরুণ প্রজন্ম বিদেশে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বিদেশে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন, কেউ কেউ অবৈধ পথে যেতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। অথচ দেশে যদি কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা যেত, তাহলে এই মেধা ও শ্রম দেশের উন্নয়নে কাজে লাগত।
নীতির অস্থিরতা উদ্যোক্তাদের আস্থাহীনতার আরেকটি বড় কারণ। বিনিয়োগকারীরা চান দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা। তারা জানতে চান, আগামী পাঁচ থেকে দশ বছর নীতি কেমন হবে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রায়ই দেখা যায় হঠাৎ করে করহার বদলে যায়, শুল্কনীতিতে উলট-পালট হয়, কখনও ভর্তুকি ঘোষণা করা হয় আবার অল্প সময়ের মধ্যেই তা প্রত্যাহার করা হয়। এর ফলে উদ্যোক্তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। তারা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে সাহস পান না। অথচ বিনিয়োগ এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করার আগে উদ্যোক্তাকে নিশ্চিত হতে হয়, ভবিষ্যতে নীতিগত পরিবেশ তার পক্ষে থাকবে কি না। ভারত কিংবা ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত গত দুই দশক ধরে এক ধরনের স্থিতিশীল নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। ভিয়েতনাম এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শিল্পায়ন ও রপ্তানিমুখী প্রবৃদ্ধির পথে নীতি অপরিবর্তিত রেখেছে। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সেখানে নিরাপদবোধ করেছেন এবং আজ ভিয়েতনাম বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। বাংলাদেশও চাইলে পারত, কিন্তু নীতির অস্থিরতা আমাদের বারবার পিছিয়ে দিচ্ছে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের অনিশ্চয়তা উদ্যোক্তাদের আস্থা সংকটকে আরও তীব্র করেছে। শিল্পকারখানায় উৎপাদন চলতে হলে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হয়। কিন্তু দেশে বারবার লোডশেডিং, গ্যাসের চাপ কমে যাওয়া, হঠাৎ করে দাম বাড়িয়ে দেওয়া- এসব ঘটনায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে এই অনিশ্চয়তা ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। বিদেশি ক্রেতারা এখন বাংলাদেশের পরিবর্তে অন্য দেশে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পে সময়মতো অর্ডার সরবরাহ করা না গেলে বৈশ্বিক ক্রেতারা দ্রুতই বিকল্প দেশ বেছে নেন। এর ফলে বাংলাদেশের বাজার হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সরবরাহ শৃঙ্খলের ভাঙনও উদ্যোক্তাদের আস্থাহীনতার অন্যতম কারণ। যখনই অবরোধ, হরতাল বা রাজনৈতিক সহিংসতা দেখা দেয়, তখন প্রথম আঘাত পড়ে ব্যবসায়ীদের ওপর। ট্রাক ভাঙচুর হয়, গুদামে আগুন লাগানো হয়, বাজারে যেতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েন। এসব ঘটনায় সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়ে, উৎপাদন ব্যাহত হয়, খরচ বেড়ে যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে ডেলিভারি ব্যাহত হলে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকেরা জরিমানা গুনতে বাধ্য হন বা ভবিষ্যতের অর্ডার হারান। এভাবে ব্যবসায়ীরা বারবার আঘাত পেয়ে আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছেন।
উদ্যোক্তাদের আস্থা সংকট কেবল অর্থনৈতিক সূচকে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সমাজের ভেতরেও গভীর প্রভাব ফেলছে। বেকারত্ব বাড়লে সমাজে হতাশা, ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হয়। তরুণরা কর্মসংস্থানের অভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে, মাদকাসক্তি বাড়তে পারে, সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে। অর্থাৎ উদ্যোক্তাদের আস্থার সংকট কেবল অর্থনীতিকে নয়, গোটা সমাজকেই অস্থির করে তোলে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সমাধান কোথায়। প্রথমত, মামলা ও হয়রানির সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। ব্যবসায়ীরা যদি প্রতিটি সমস্যায় আদালতের দৌড়ঝাঁপে পড়েন, তবে বিনিয়োগ এগোবে না। এজন্য বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ বাণিজ্য আদালত গঠন করা যেতে পারে, যা দ্রুত সময়ের মধ্যে রায় দেবে এবং উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় মনোযোগী হতে সাহায্য করবে। দ্বিতীয়ত, কর ও শুল্কনীতিতে ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হবে। ন্যূনতম পাঁচ বছর মেয়াদি করনীতি ঘোষণা করতে হবে, যাতে উদ্যোক্তারা জানেন তাদের সামনে কী আসছে। তৃতীয়ত, জ্বালানি খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ দরকার। স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে বৈচিত্র?্য আনা ছাড়া সমস্যার সমাধান হবে না। চতুর্থত, রাজনৈতিক অস্থিরতা রোধে সরকার ও বিরোধী দল উভয়ের দায়িত্বশীল আচরণ জরুরি। ব্যবসা ধ্বংস করে কোনো পক্ষই লাভবান হবে না, বরং দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
লেখক : কলামিস্ট, রংপুর