প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১০ অক্টোবর, ২০২৫
রোহিঙ্গা (Rohingya) হলো- একটি মৌলিকভাবে মুসলিম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী, যারা মায়ানমারের রাখাইন (Rakhine) রাজ্যে বসবাস করত। কয়েক দশক ধরে তারা নাগরিকত্ব, মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত ছিল। নানা সময়ে ধ্বংসযজ্ঞ, নির্যাতন, গণতন্ত্রহীন শাসন ও সামরিক কারচুপি শুরু হলে তারা আশ্রয় খুঁজে বাংলাদেশে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রোহিঙ্গা ধরনের শরণার্থী শিবিরের পোশলা হিসেবে পরিচিত।
মিয়ানমারে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব থেকে বিরত রাখে, ফলে তারা ‘রাষ্ট্রহীন’ হয়ে পড়ে। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা সম্প্রদায় প্রায়শই গণনির্বাচন ও স্থানীয় পরিষেবা, ভূমি অধিকার, শিক্ষা অধিকারে বাধাপ্রাপ্ত হয়। বিশেষ করে ২০১৭ সালের ‘সাফাই অভিযান’ ও অন্যান্য পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী, স্থানীয় মিলিশিয়া ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর হত ঘূর্ণি কর্মসূচি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তীব্র সহিংসতায় রূপ নেয়। মিয়ানমার সরকারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জট, সেনা উত্তেজনা ও জাতীয়তাবাদী নীতির চাপ রোহিঙ্গা সমস্যাকে গভীর করেছে। শান্তি প্রক্রিয়া, আন্তর্জাতিক চাপ, মানবাধিকার সংগঠনের ভূমিকা- এসব দিক থেকে সমন্বয় ও কার্যকর উদ্যোগ দুর্বল থাকায় সমস্যা দীর্ঘায়িত।
২০১৭ সালের আগস্টে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও মীলিশিয়া রোহিঙ্গা গ্রাম দলিল-নাশ, নিহত ও নির্যাতন চালায়- প্রায় ৭৫০,০০০ জন রোহিঙ্গা একসময়ে বাংলাদেশে পালাতে বাধ্য হয়। শরণার্থী হিসেবে তারা কক্সবাজার জেলার প্রায় ৩০-৩৫টি শিবিরে অবস্থান করে, যেখানে অত্যধিক জনসংখ্যা ঘনত্ব, অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও পরিবহন সীমাবদ্ধতা বিরাজ করে। পর্যায়ক্রমে নতুন প্রবাহ চলছেই- গত ১৮ মাসে প্রায় ১,৫০,০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে (UNHCR) অর্থসাহায্য সংকটের কারণে খাদ্য ও সহায়তা কমিয়ে দিতে হয়- যেমন WFP খাদ্য অনুদান অর্ধেক কমিয়েছে। শিবিরগুলোর মধ্যে অগ্নিকাণ্ড, জলাবদ্ধতা, স্বাস্থ্যসংকট, ভ্রমণ সীমাবদ্ধতা ও যৌন নিপীড়ন উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৯ লাখ থেকে ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রিত- বেশিরভাগই কক্সবাজারে। তারা ৩৩টি মূল শিবিরে অবস্থান কর। শরণার্থীকে তারোগণ্য সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হয়- প্রায় সবক’টি ঘরেই তারা মানবিক সহায়তার উপর হাইভাবে নির্ভরশীল। নতুন প্রবাহ: ১৮ মাসে প্রায় ১,৫০,০০০ জন নতুন রোহিঙ্গা এসেছে (UNHCR) মায়ানমার সরকার সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে তারা ১৮০,০০০ জন রোহিঙ্গাকে ফিরে আসতে ‘যোগ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে- তবে এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন এখনও বিতর্কিত। বাংলাদেশ সরকার ‘রোহিঙ্গাদের দেশে কাজ করার অধিকার দেওয়া যায় না’ এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে, কারণ দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য চ্যালেঞ্জের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। ২০২৫ সালের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ সরকার, বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গাসংকট নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।
কক্সবাজার ও আশপাশের এলাকায় জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপ, মৌলিক অবকাঠামোর ঘাটতি, পরিবহন ও বসবাস সীমাবদ্ধতা- এসব স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রাকে চ্যালেঞ্জের মুখে। সীমিত সম্পদ ও সুযোগ পাওয়া, কর্মসংস্থান সংকট ও প্রতিযোগিতা উন্নয়ন কর্মসূচি ও স্থানীয় মানুষের মধ্যে প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। শিবিরের মধ্যে অপরাধ, মাদকের প্রবেশ, সন্ত্রাসমূলক কার্যক্রম বা সন্ত্রাসের আশঙ্কা ও যোগাযোগ পথ হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। শিক্ষাবঞ্চন, স্বাস্থ্যঝুঁকি, খাবার ও পুষ্টি অপর্যাপ্ততা, নারী ও শিশুদের ওপর নির্যাতন ও শোষণ- এসব মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যর সমাধান। বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে চাপ ও সমর্থন সংগ্রহ করতে হয়- অর্থনৈতিক সহায়তা, শান্তি প্রক্রিয়া, পুনর্বাসন ও হস্তক্ষেপের চাহিদা ওঠে। শিবিরে গাছকাটা, মাটি ক্ষয়, পানি ও বায়ুর দেয়ালীয় চাপ বৃদ্ধি পায়- পরিবেশগত অবনতির সম্ভাবনা।
মিয়ানমার ও অরাকান সশস্ত্র গোষ্ঠীদের উপর কার্যকর প্রেসার প্রয়োগ করে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করা। রোহিঙ্গাদের সৎ ও মর্যাদাপূর্ণ পুনর্বাসন রোডম্যাপ নির্ধারণ করা। বাংলাদেশকে এই সংকটে ‘ভুক্তভোগী’ হিসেবে বিবেচনা করে যথোপযুক্ত আন্তর্জাতিক সমর্থন দেওয়া। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান দেওয়ার পরিবর্তে, তাদের দেশে ফিরে যাওয়া ও সেখানকার পুনর্বাসন নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া। দাতারা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থ ও প্রযুক্তি সহায়তা বাড়াতে আহ্বান। অপরাধমূলক কার্যক্রম প্রতিহত করার প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী করা।
রোহিঙ্গা সংকটকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটি অংশ করা যাবে না- অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের অধিকার ফেরানো ও পুনর্বাসন broader রিফর্মের শর্তে বেঁধে দেওয়া যাবে না। ইউনূসের ভাষণ এই সংকটকে ‘বাংলাদেশের ওপর চাপ, সীমাবদ্ধতা ও দায়িত্ব ভাগাভাগি’ করা একটি কূটনৈতিক এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে তুলে ধরে। আমার মতে,
রোহিঙ্গাসংকট কোনো সহজ সমস্যা নয়- এটি মানবিক, রাজনৈতিক, নিরাপত্তাজনিত ও কূটনৈতিক ভাবে জটিল। তবে কিছু ধাপে ধাপে বাস্তব অভিযোজন সম্ভব-
মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের মধ্যে একটি ‘সন্তুলিত সমঝোতা কাঠামো’ তৈরি করা, যাতে প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা যায়। শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয়, একভাবে গ্লোবাল কমিউনিটি (UN, EU, বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) সংগ্রহ করে একটি স্থায়ী তহবিল গড়ে তুলতই হবে। রোহিঙ্গাদের বিষয়কে মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক ন্যায় সমস্যার দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে- চাপ দিতে হবে যে, তাদের অধিকার ও মর্যাদার ওপর পৃথিবীর ন্যায্য দৃষ্টি থাকা উচিত। শিবিরের দুর্বলতা কমানো (অগ্নিসুরক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তা, পানি-নিষ্কাশন)। পুনর্বাসন পরিকল্পনায় স্থানীয় জনসম্প্রদায়ের অংশীদারিত্ব দক্ষতা ও শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখা। তথ্যসেবা ও ডিজিটাল সংযোগ বৃদ্ধি।
আন্তর্জাতিক আদালত বা মানবাধিকার আদালতের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে দায়প্রয়োগ। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। মিয়ানমারের সংবিধান, নাগরিকত্ব ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন কাঠামোর দিকে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানো। রাখাইন রাজ্যে স্বশাসন, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকার সুরক্ষার গ্যারান্টি। রোহিঙ্গা-সংক্রান্ত বিষয়কে মিয়ানমার অভ্যন্তরীণ শান্তি ও সংহতির অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে।
লেখক : সদস্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ফিচার, কলাম এন্ড কনটেন্ট রাইটার্স