প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১১ অক্টোবর, ২০২৫
ইসলাম আমাদের ন্যায়, সততা, দায়িত্বপরায়ণতা এবং মানবিক সহানুভূতির শিক্ষা দেয়। সমাজে সবচেয়ে দুর্বল মানুষদের প্রতি যত্নশীল হওয়া প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব। বিশেষ করে পিতা-মাতাহীন শিশু, যারা নিজের সম্পদ রক্ষা করতে অক্ষমণ্ড তাদের প্রতি দায়বদ্ধতা আমাদের নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। ইয়াতিমের সম্পদ, যেমন স্বর্ণ, ধন, জমি বা মূল্যবান মালমসলা, তাদের নিরাপদে সংরক্ষণ করা ইসলামিক শাস্ত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এদের সম্পদকে অবৈধভাবে গ্রহণ করা কেবল অপরাধ নয়, বরং এক মহাপাপ।
ইয়াতিমের সম্পদ আত্মসাৎ কী: ইয়াতিমের স্বর্ণ বা ধন তাদের অনুমতি ছাড়া নেওয়া, ব্যবহার করা বা বিক্রি করা ইসলামের দৃষ্টিতে এক ভয়াবহ অপরাধ। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্টভাবে বলেছেন- তোমরা ইয়াতিমদের সম্পদ তাদের ফেরত দাও এবং পবিত্র জিনিসের বদলে অপবিত্র জিনিস গ্রহণ করো না; তাদের সম্পদ নিজেদের সম্পদের সঙ্গে মিশিয়ে খেও না। নিশ্চয়ই এটি এক মহাপাপ। (সূরা আন-নিসা, ২) এখানেই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে- ইয়াতিমের হক হরণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এটি শুধু চুরি নয়, বরং দুর্বল ও নিরপরাধ শিশুদের প্রতি জুলুম। ইসলামে ইয়াতিমের সম্পদকে আল্লাহর দেওয়া পবিত্র আমানত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ইয়াতিমের মাল খাওয়ার শাস্তি : আল্লাহতায়ালা আরও বলেন- যারা ইয়াতিমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, তারা আসলে নিজেদের পেটে আগুন ভরে এবং তারা অচিরেই জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে। (সূরা আন-নিসা, ১০) এটি শুধু শাস্তি নয়, বরং সতর্কবার্তা। ইয়াতিমের সম্পদ নষ্ট করা বা অন্যায়ভাবে গ্রহণ করা মানুষের আখিরাতের জন্য কতটা বিপজ্জনক তা আল্লাহ স্পষ্ট করেছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে, ইয়াতিমের সম্পদ লঙ্ঘন করা মানে শুধু অপরাধ নয়, বরং আগুনে ঘেরা শাস্তি নিশ্চিত।
ইমাম ইবন কাসীর তাফসীরে বলেছেন, যে ব্যক্তি ইয়াতিমের সম্পদ চুরি করে, তার মুখ ও হাত কিয়ামতের দিনে জ্বলন্ত আগুনে পুড়ে যাবে। এটি শুধু শাস্তি নয়, বরং মানবিক ও নৈতিক শিক্ষা, যাতে সমাজে দুর্বলদের প্রতি সহমর্মিতা বজায় থাকে।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সতর্কবাণী: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- সাতটি বড় গুনাহ থেকে বাঁচো, যার মধ্যে ইয়াতিমের সম্পদ খাওয়া অন্যতম। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ২৭৬৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৮৯) এখানেই বোঝা যায়, ইয়াতিমের সম্পদ খাওয়া ধ্বংসাত্মক গুনাহ হিসেবে গণ্য। অন্য হাদীসে বলা হয়েছে, যারা ইয়াতিমের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করে, আল্লাহ তাদের কেয়ামতের দিন আগুনের পর্দায় আবৃত করবেন।
অভিভাবক ও তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব : ইয়াতিমের সম্পদ যদি কারও তত্ত্বাবধানে থাকে, সেই ব্যক্তি মালিক নয়; তিনি শুধু সংরক্ষণ ও ন্যায্য ব্যবহার করতে পারেন। কোরআনে বলা হয়েছে—যে অভাবগ্রস্ত, সে সীমিতভাবে তা থেকে খেতে পারে। (সূরা আন-নিসা: আয়াত ৬)
অর্থাৎ অভিভাবক দরিদ্র হলেও, বিনা অনুমতিতে সম্পদ গ্রহণ করা হারাম। অভিভাবকের দায়িত্ব হলো সততা ও ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে ইয়াতিমের হক রক্ষা করা। এই দায়িত্ব পালন করলে সমাজে শান্তি ও আস্থা বজায় থাকে।
সামাজিক প্রভাব : যে সমাজে ইয়াতিমের হক লঙ্ঘিত হয়, সেখানে সামাজিক অশান্তি, বৈষম্য ও দুঃখ বৃদ্ধি পায়। রাসূল (সা.) বলেছেন- সেরা ঘর হলো যেখানে ইয়াতিমকে সম্মান ও ভালোবাসা দেওয়া হয়; নিকৃষ্ট ঘর হলো- যেখানে তাদের প্রতি অন্যায় করা হয়।
এটি দেখায়, ইয়াতিমদের প্রতি দয়া ও সম্মান প্রদর্শন শুধু ব্যক্তিগত নৈতিকতার বিষয় নয়, বরং সমাজের শান্তি ও সমৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। যারা ইয়াতিমের হক রক্ষা করে, তারা আল্লাহর রহমত ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখে।
ইয়াতিমের সম্পদ রক্ষা করার উপায় : সততা ও ন্যায়পরায়ণতা: ইয়াতিমের সম্পদ সংরক্ষণে অভিভাবক বা তত্ত্বাবধায়কের সততা অপরিহার্য। শুধু প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার: কেবলই সীমিত ও প্রয়োজনমতো সম্পদ ব্যবহার করা যায়। সহানুভূতি ও সহযোগিতা: শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জীবনযাত্রার উন্নতিতে সহযোগিতা করা।
সতর্কতা : সম্পদ চুরি, লোপাট বা অন্যায়ভাবে ভোগ থেকে বিরত থাকা।
পরিশেষে, ইয়াতিমের সম্পদ চুরি করা ইসলামি দৃষ্টিতে এক ভয়াবহ অপরাধ। এটি চুরি, আমানত ভঙ্গ ও জুলুমের সমন্বয়। প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব হলো ইয়াতিমের সম্পদ রক্ষা করা, তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো এবং তাদের উন্নতিতে সহযোগিতা করা।আর ইয়াতিমের নিকটে যেও না, তবে উত্তম পন্থায়। (সূরা আল-আনআম : ১৫২) ইয়াতিমের হক রক্ষা করা শুধু ধর্মীয় কর্তব্য নয়, এটি মানবিক কর্তব্যও। যারা এটি পালন করে, তারা আল্লাহর রহমত ও জান্নাতের আশা রাখতে পারে। আমাদের প্রত্যেকের উচিত ইয়াতিমদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় সচেতন থাকা, যাতে তাদের জীবন হয় নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ।
লেখক : কলাম লেখক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি